দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সৌন্দর্য ও দ্রৌপদী মুর্মুর অভূতপূর্ব আতিথেয়তা



এম এ আমিন রিংকু
দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সৌন্দর্য ও দ্রৌপদী মুর্মুর অভূতপূর্ব আতিথেয়তা

দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সৌন্দর্য ও দ্রৌপদী মুর্মুর অভূতপূর্ব আতিথেয়তা

  • Font increase
  • Font Decrease

হেমন্তে দিল্লির আকাশ মোহনীয় থাকে। অক্টোবরের চোদ্দ তারিখ সেদিন। ফ্রেন্ডস কলোনির হোটেল সুরিয়ায় সকালে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে টিভিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে নিচ্ছিলাম। সারাদিনের আবহাওয়া বেশ উপভোগ্য থাকবে বলে জানলাম। আবহাওয়া দারুণ হলেও সহযাত্রীদের মধ্যে একটা চাপা উদগ্রীবতা দেখতে পেলাম। উদগ্রীবতা থাকারই কথা। আমরা একশ তরুণ ভারতে এসেছি ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন প্রকল্পের আওতায় ভারতের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে। আমাদের ট্যুর শিডিউল অনুসারে আজ রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হওয়ার কথা।

পড়ন্ত বিকেলে আমাদেরকে বহনকারী গাড়ি বহর এসে থামল ফোরকোর্টে। গাড়ি থেকে নেমে বামে ঘুরতেই চোখে পড়ল ক্লাসিক ইউরোপিয়ান ও ভারতীয় স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন; রাষ্ট্রপতি ভবন! হলুদাভ বেলে পাথরে নির্মিত এ ভবনের সৌন্দর্য আর বিশালতা দেখে বিস্ময়ে আমার মত সতীর্থ অনেকেরই মুখ 'হা' হয়ে গিয়েছিল।

এডউইন লুটিয়েনস ও হার্বার্ট বেকারের নকশায় তৈরি এ প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসটি পৃথিবীর সুন্দরতম ভবনগুলোর অন্যতম। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সবচাইতে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সাংবিধানিক প্রধানের এই বাসভবনটি আকারে আয়তনে সারা দুনিয়ার যে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের বাসভবনের চাইতে বড়। রাষ্ট্রপতি ভবন কমপ্লেক্সটি ৩৩০ একরের সুবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত। চারতলা ভবনটিতে কামরা আছে ৩৪০টি। এ কমপ্লেক্সের ১৯০ একরের বাগানে আছে হাজারও প্রজাতির গাছ।

১৯২৯ সালে যখন ভবনটি তৈরি হয়, তখন এর নাম ছিল ভাইসরয়’স হাউস। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই ভবনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় গভর্নমেন্ট হাউস। পরে রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সময় এর নাম হয় রাষ্ট্রপতি ভবন। ২৯ হাজার লোক ১৭ বছর ধরে এই ভবনটি তৈরি করেন। সাম্রাজ্যিক আধিপত্য এবং ক্ষমতার প্রতীক থেকে, ভবনটি আজ ভারতীয় গণতন্ত্র এবং এর ধর্মনিরপেক্ষ, বৈচিত্র্যময় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ঐতিহ্যের প্রতীক।

বাংলাদেশ থেকে আগত ইয়ুথ ডেলিগেটসদের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হবে দরবার হলে। ফোরকোর্ট থেকে দরবার হলে ঢোকার জন্য মাড়াতে হবে প্রশস্ত ৩১ খানা সিঁড়ি। লাল বেলে পাথরের সিঁড়িতে গালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে আমাদের জন্য। জীবনের প্রথম লাল গালিচা দিয়ে হেঁটে যাবার অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। ভবনের বেদীতে উঠে খানিকটা হেঁটে গেলেই দরবার হল। এই বৃত্তাকার দরবার হলেই রাষ্ট্রপতি উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান করা হয় এ দরবার হলেই।

দরবার হলে পা রেখেই একটা অন্যরকম প্রশান্তির পরশে যেন বুকটা শীতল হয়ে গেল। ভবনের সুউচ্চ ছাদ থেকে ঝোলানো মখমলের লাল পর্দার নিচে পাতা আছে রাষ্ট্রপতির জন্য আসন। তার সামনে সারি ধরে পাতা হয়েছে আমাদের জন্য চেয়ার। রাজকীয় চেয়ারে টান হয়ে বসলাম আমরা। কিছুক্ষণ পরেই আসল রাজকীয় ইউনিফর্ম পরা প্রেসিডেন্ট গার্ড। এরপরে পিন পতন নীরবতা। খানিক পরেই ঘোষণা করা হল 'মহামান্য রাষ্ট্রপতি দরবার হলে প্রবেশ করছেন'। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্মান জানালাম। প্রবেশদ্বারের পরে দ্বিতীয় সারিতে আমার আসন। ঠিক পাশ দিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু হেঁটে গেলেন; এ অনুভূতিটা একেবারেই ভিন্নরকম।

আমাদের এ সফরের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত ছিল চমকে পরিপূর্ণ। রাষ্ট্রপতি ভাষণ শুরুর পূর্বে বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন 'কেমন আছেন'। ছোট দুটি শব্দ। প্রতিদিন শতবার শুনি আমরা। কিন্তু রাষ্ট্রপতি মুর্মুর মুখে থেকে শব্দ দুটি শুনে আবেগপ্রবণ হয়েছি। কর্ণ ইন্দ্রিয় যেন পুলকিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণের পুরোটা সময় জুড়ে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির প্রশংসা করলেন। জানালেন বাংলাদেশের তরুণদের অগ্রযাত্রায় তার মুগ্ধতার কথা।আগামীতে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় যাবে দৃঢ়তার সাথে সে আশাবাদও ব্যক্ত করলেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিনয়ী মানুষটির বক্তব্য শুনছিলাম। আট মিনিটের মোহনীয় বক্তব্য যেন নিমেষে শেষ হয়ে গেল।

দরবার হলের অনুষ্ঠান শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় অশোকা হলে। লং ড্রইংরুম আর ব্যাঙ্কুয়েট হলের সামনের করিডোর দিয়ে যাওয়া যায় অশোকা হলে। রাষ্ট্রপতি ভবনে যতগুলো করিডোর আছে তা একসাথে হিসেব করলে লম্বায় হবে আড়াই কিলোমিটার! করিডোরের দুপাশের দেয়াল জুড়ে বিখ্যাত সব শিল্পীদের চিত্রকর্ম ঝোলানো। পৃথিবীতে কিছু অভিজ্ঞতা নিজে পরখ না করলে সেই অভিজ্ঞতার সুখানুভূতি অন্যকে ঠিকঠাক বোঝানো যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা ঠিক এমনই। করিডোরের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা প্রেসিডেন্ট গার্ড। মিষ্টি করে মুচকি হেসে আমাদের সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন তারা।

আশোকা হলে প্রবেশের পরে হলের দেয়ালে আর ছাদের সুনিপুণ কারুকার্য ও শিল্প কর্ম দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমাদের। রাষ্ট্রপতি ভবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সুসজ্জিত হলগুলোর মধ্যে একটি এই অশোকা হল। সুবিশাল ও শৈল্পিকভাবে তৈরি হলটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হয়। এখানেই ভারতে অবস্থিত বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস প্রধানেরা রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের পরিচয়পত্র পেশ করেন। এছাড়াও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আয়োজিত রাষ্ট্রীয় ভোজ শুরুর আগে সফররত বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি এবং ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পরিচিতির জন্য আনুষ্ঠানিক স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই আশোকা হল। এই হলেই রাষ্ট্রপতির সাথে ছবি তোলার সুযোগ পেলাম আমরা! হলের দুপাশে একসারি চেয়ার আর তার পেছনে দাঁড়াবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। সামনের সারির ঠিক মাঝে রাষ্ট্রপতির জন্য আসন, তার দুপাশের দুই চেয়ারে বসবেন দুজন সচিব। আমাদের মেয়েরা প্রথমে সামনের সারিত বসল পরে বাকি ফাঁকা চেয়ারে বসল ছেলেরা। পেছনের সারিতে দাঁড়ালাম আমরা বাকি ছেলেরা। দু গ্রুপের দাঁড়ানো শেষ হলে রাষ্টপতি এলেন। ছবি তোলা শেষে সামনে দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করলেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে ব্যাঙ্কুয়েট হলে বিকেলের নাস্তার আমন্ত্রণ করে জানতে চাইলেন আমাদের এই সফরে কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। মানুষের সুখস্মৃতি নাকি ব্রেনের হিপ্পোক্যাম্পাসে সংরক্ষিত হয় পরবর্তী সময়ে বারবার মনে করে পুলকিত হওয়ার জন্য। আমাদের এ ক্ষণটা যেন হিপ্পোক্যাম্পাসের বড় একটা অংশ দখল করে নিল মুহূর্তেই।

অশোকা হলে থেকে বেরিয়ে লুটিয়েনস গ্র্যান্ড স্ট্যায়ারের পাশের করিডোর ধরে খানিক হাঁটলেই আসে ব্যাঙ্কুয়েট হল। লম্বায় ১০৪ ফুট, ৩৪ ফুট চওড়া আর ৩৫ ফুট উচ্চতার এ হলের জৌলুষ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। বার্মিজ সেগুন কাঠের প্যানেলিং কার্নিশ থেকে মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। আর দেয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড: রাজেন্দ্র প্রসাদ, ড: সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, ড: জাকির হোসেন, ভি.ভি. গিরি, ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ, সঞ্জীব রেড্ডি, গিয়ানি জৈল সিং, আর ভেঙ্কটারমন, ড: শঙ্কর দয়াল শর্মা এবং কে আর নারায়ণন এর বিশাল আকৃতির তৈলচিত্র।

রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রিত রাষ্ট্রপ্রধান ও তাদের সফর সঙ্গীদের জন্য ভোজসভার আয়োজন করা হয় এখানেই। হলের মাঝ বরাবর পাতা আছে লম্বা টেবিল। দুপাশে পাতা রাজকীয় চেয়ার। একসাথে ১০৪ জন এ টেবিলে খেতে পারেন। রানী এলিজাবেথসহ বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্র প্রধানেরা ভারতের আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসে খেয়েছেন এ টেবিলেই। আজ আমাদের জন্য এ টেবিল-জুড়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা ধরণের খাবার! ব্যাঙ্কুয়েট হলে পুরোটা সময় রাষ্ট্রপতির সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের অমায়িক ও বন্ধুবৎসল ব্যাবহারে বিমোহিত হয়েছে আমাদের সকলেই।

ইয়ুথ ডেলিগেশনের ফ্ল্যাগ অফ ইভেন্টে পূর্বে ভ্রমণ করে যাওয়া ডেলিগেটরা বলেছিলেন, 'জীবনের সেরা অভিজ্ঞতার অর্জন করতে যাচ্ছেন আপনারা'। তাদের প্রতিটি কথার মিল পেয়ে যাচ্ছি নিখুঁতভাবে । এ ট্যুরের প্রতিটি ধাপে যে সন্মান আর সমীহ পেয়েছি সেটা কোন কিছুর সাথে তুলনা হয় না।

খাবার পরে আমরা আট দশজন মিলে ব্যাঙ্কুয়েট হল ঘুরে দেখছি এমন সময় এগিয়ে এলেন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাঞ্জিভ রাই। হাত বাড়িয়ে কুশল বিনিময় করলেন। বিনয়ের সাথে জানতে চাইলেন কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। শুনতে চাইলেই ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। জমে উঠল দারুণ আড্ডা। উঠে এলো দু-দেশের অভিন্ন কৃষ্টি - সংস্কৃতি আর ইতিহাস - ঐতিহ্যের চমৎকার মেলবন্ধনের কথা। প্রাণবন্ত এ আলোচনা ছেদ পড়ল সন্ধ্যায়। ফেরার সময় হয়েছে। চারপাশে চোখ মেলে দেখলাম ভবনের বাসিন্দাদের চোখগুলো যেন বলছিল ' আর কিছুক্ষণ থেকে যাও'।

'অতিথি দেব ভব' তথা অতিথি দেবতার মত। এ কথাগুলো শুধু ভারতীয় শাস্ত্রে নয় বাস্তবে প্রমাণ পাওয়া যায় সারা ভারত জুড়েই। ভবন থেকে বের হবার সময় করিডোর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার সময় অনুভব করতে পারছিলাম মানুষ গুলোর সাথে এ অল্প সময়ে তৈরি হওয়া আত্মার সম্পর্ক। শুধু দুটি লাইনই মনে পড়ছিল বারবার, 'একটি মুহূর্ত বেঁচে থাকে একটি ক্ষণের তরে, স্মৃতি থেকে যায় আবহমান কাল ধরে'। রাষ্ট্রপতি ভবনের এই সুখ স্মৃতি চিরসবুজ থাকবে আজীবন।

লেখক: সাংবাদিক ও পরিবেশ কর্মী

   

আমার হাতের পাখা যেন তাদের আরাম দিচ্ছে!



মৃত্যুঞ্জয় রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাতক্ষীরা
ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

  • Font increase
  • Font Decrease

আবু বক্কর (৬২)। বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে তিনি এখন পাকা বিক্রেতা। প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষ যখন ঠান্ডা বাতাসের প্রশান্তি খুঁজছে, তখন তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন।

আবু বক্কর বার্তা২৪.কমকে বলেন, স্ত্রীসহ ছয় মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। তবে মেয়েদের বিয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু বয়সের ভারে ঠিকই আমরা একা থেকে গেলাম। শেষ বয়সে গ্রামে গ্রামে তালপাতা পাখা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। শুধু সংসার না, এই টাকায় আমার পায়ের শিরার ব্যথার ওষুধও কিনতে হয়। একবেলা ওষুধ না খেলে চলতে পারি না।

এদিকে, পুরনো ব্যবসার ঋণের বোঝা আর অন্যদিকে অসুস্থ হয়ে ওষুধসহ সংসারের খরচ। শেষ বয়সে তালপাতার পাখাই আমার একমাত্র জীবনসঙ্গী বলেন আবু বক্কর।

তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন আবু বক্কর, ছবি- বার্তা২৪.কম

বুধবার (২৪ এপ্রিল) সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কলাগাছি গ্রামের কবিগানের অনুষ্ঠানে সরেজমিন দেখা যায়, একপাশে তালপাতার পাখা বিক্রি করতে ব্যস্ত ছোট্ট পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ। এই গরমে যখন তার ঘরে থাকার কথা, তখন সে নানা-নানীর সঙ্গে এসে তালপাতার পাখা বিক্রি করছে। কবিগানে বসে থাকা সব শ্রোতার কাছে গিয়ে বলছে, পাখা লাগবে, পাখা! কথা বলতে চাইলেও এ পাশ ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, ক্রেতার কাছে।

এক ফাঁকে তাকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই বয়সে পাখা বিক্রি করছো কেন! এ প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে মাহমুদুল্লাহ বলে, প্রচণ্ড গরমে স্কুল ছুটি। তাই, নানা-নানীর সঙ্গে চলে এসেছি মেলায় পাখা বিক্রি করতে। মানুষজন আমার কাছ থেকে যেন বেশি পাখা কেনে (ক্রয়), তাই আমি মেলায় তাদের সঙ্গে এসেছি।

অনেক উৎসাহের সঙ্গে সে বলে, গরমে আমার হাতের পাখায় যেন তাদের আরাম দিচ্ছে! মেলা হলে আমি সেখানে চলে যাই পাখা বিক্রি করতে। ঘোরাঘুরিও হয় আর টাকা ইনকামও হয়। টাকার জন্য বের হয়ে পড়েছি। আমরা পাখা বিক্রি করে পেট চালাই। নানা-নানী বুড়ো হয়ে গেছে। তাই, আমি সঙ্গে এসে তাদের কষ্টটাকে একটু ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।

যেখানে প্রচণ্ড তাপে মানুষজন নাজেহাল, সেখানে ছোট্ট মাহমুদুল্লাহ ছুটে চলেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাখা বিক্রি করতে। ছোট্ট শিশু হলেও গরম যেন তার কাছে কিছু না, পেটের তাগিদে!

আরেক পাখা বিক্রেতা তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা ভদ্রকান্ত সরকার (৭০)। ১২-১৪ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি।

চলছে তালপাতার পাখার বিকিকিনি, ছবি- বার্তা২৪.কম

শেষ বয়সে পাখা কেন বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে ভদ্রকান্ত বলেন, চাল কিনে খেতে হয়। খুব কষ্টের সংসার! ছেলে-মেয়ে আছে। তারা তাদের মতো কাজ করে খায়। মা বাবার বয়স হয়ে গেলে ছেলে আর আমাদের থাকে না। আমরা বৃদ্ধ বয়সে কেমন আছি, সেটা জানার সুযোগ তাদের থাকে না। শেষজীবনটা এভাবে পাখা বিক্রি করে কাটিয়ে দেবো। কী আর করবো! কপালে যা আছে, শেষপর্যন্ত তাই হবে। কপালে ছিল, এমন বৃদ্ধ বয়সে গ্রামে গ্রামে পাখা বিক্রি করতে হবে!

;

৪ লাখ বছর আগে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

  • Font increase
  • Font Decrease

৪ লাখ বছর আগে রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে নতুন এক গবেষণা থেকে জানা গেছে। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে এই গোত্রের মানুষ পরে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায়।

নতুন এক গবেষণা জানাচ্ছে, সাইবেরিয়ায় নতুন একটি এলাকার সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে ৪ লাখ ১৭ হাজার বছর আগে হোমিনিনস (Hominins) গোত্রের মানুষের উপস্থিতি ছিল। এই গোত্রের মানুষ ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বাস করতেন। সেখান থেকে তারা উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায় বলে জানিয়েছেন চেক প্রজাতন্ত্রের এক গবেষক।

১৬ এপ্রিল চেক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষক জন জেনসেন এক সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এ তথ্য প্রকাশ করেন। গবেষণাবিষয়ক সংবাদ সাময়িকী নিউ সায়েন্সটিস্ট এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে জন জেনসেন বলেন, আমরা আগে যে ধারণা করতাম, তারও আগে থেকে হোমিনিনস গোত্রের মানুষ সাইবেরিয়ার ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বসবাস করতেন। ৪ লাখ ১৭ বছর আগে থেকেই তারা এই এলাকায় বসবাস করতে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের অবস্থান ছিল উত্তর অক্ষাংশে।

তিনি বলেন, আরেকটি আদিম গোত্রের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা আর্কটিক অঞ্চলে বাস করতেন। ৪৫ হাজার বছর আগে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 

;

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা



মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

  • Font increase
  • Font Decrease

উদাল, সোনালি হলুদ সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়ানো মাঝারি সাইজের বৃক্ষ। পত্রঝরা উদাম শরীরে পুরো গাছজুড়ে শুধুই সোনালি হলদে রঙের ফুল। বসন্তে হলদে পাপড়ি ঝরে রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা। প্রকৃতির এক অপর সৌন্দর্য উদাল বৃক্ষ ও তার ফুল।

উদাল আমাদের দেশীয় উদ্ভিদ। এদের প্রিয় আবাস পাহাড়ি এলাকা হলেও আগে সারাদেশেই কমবেশি দেখা যেত। নির্বিচারে গাছ উজাড় হতে থাকায় অন্য গাছের সাথে এ দেশী গাছটিও বিপন্ন। ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলা একাডেমি, ঢাকার রমনা পার্ক, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কসহ সমতলের অনেক স্থানে উদাল দেখা যায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পাতাঝরা শালবনের স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে উদাল গাছ দেখা যায়।


উদালের বৈজ্ঞানিক নাম স্টারকুলিয়া ভেলোসা। ইংরেজিতে এটিতে হেয়ারি স্টারকুলিয়া বা এলিফ্যান্ট রোপ ট্রি নামে ডাকা হয়। এ গাছের বাকল থেকে এক প্রকার উন্নতমানের তন্তু পাওয়া যায়। এ তন্তু দিয়ে হাতি বেঁধে রাখার দড়ি বানানো হতো বলেও ইংরেজিতে এমন নামকরণ। আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে এটি চান্দুল নামেও পরিচিত। এই উদ্ভিদ মগ ও মারমাদের কাছে ফিউ বান, গারোদের কাছে উমাক এবং ম্রোদের কাছে নাম সিং নামে পরিচিত।

উদাল ২০ মিটার বা ততোধিক লম্বা হয়। এদের বাকল সাদাটে রঙের। এদের পাতার বোঁটা লম্বা, ফলক বড় ও পাতা খাঁজকাটা, পাতার প্রশাখার আগায় পাতা ঘনবদ্ধ। ফুলগুলি সোনালি হলুদ রঙের, ফুলের ভেতর বেগুনি। এর ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও পাকলে গাঢ় লাল রঙের হয়। বীজের রং কালো। বীজ স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাবার। তবে মানুষও এর ফল খেয়ে থাকে। বাকল থেকে আঁশ পাওয়া যায়। এ আঁশ দিয়ে দড়ি তৈরি হয়। কাঠ বাদামি রঙের, সাধারণত নরম ও হালকা হয়। এই গাছের কাঠ দিয়ে চায়ের বাক্স বানানো হয়।

উদাল ফল খাচ্ছে ইরাবতী কাঠবিড়ালি। ছবি: তবিবুর রহমান

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বার্তা২৪.কম-কে জানান, এ গাছ দেশের বন-জঙ্গলে প্রচুর হতো। এ গাছের পাতার বোঁটা দিয়ে শরবত বানানো হয়। উঁচু গাছ থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়। এরপর এর গোড়া থেকে অনেক নতুন নতুন ডালপালা গজালে সেখান থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও উদাল গাছ থেকে স্বচ্ছ আঠা পাওয়া যায়। যা দিয়ে কনফেকশনারিসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এ উদ্ভিদ বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ তিনশ উদাল গাছের চারা বিভিন্ন স্কুল কলেজে বিতরণ করেছে। এবারও প্রায় পাঁচশ চারা বিতরণ করা হবে।


ড. জসীম বলেন, উদলের বাকলের শরবত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। ফুলের বৃন্ত ছেঁচে জলের সঙ্গে চিনি দিয়ে শরবত করে খেলে প্রস্রাবের সমস্যা ও বাতের ব্যথা দূর হয়। তবে খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রাঙ্গামাটি বনবিভাগের এসিএফ তবিবুর রহমান জানান, উদালের বীজের স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালির খুব প্রিয়। তবে এ বীজ মানুষও খেয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী উদালকে বাংলাদেশের ‘মহাবিপন্ন’ প্রজাতির তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

;

বরিশালের শত বছরের ঐতিহ্যের স্মারক শীতলপাটি



এস এল টি তুহিন, করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের পাটিকররা তাদের নিপুণ হাতের তৈরি শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত।

উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের কাজলাকাঠী গ্রাম, রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঠালিয়া, রাজাপুর গ্রাম ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো তৈরি হয়, ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক দেশ বিখ্যাত শীতলপাটি।

এই উপজেলায় এখন এক হাজারের বেশি পরিবার শীতলপাটি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছে।

উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে প্রবেশ করে যতদূর দু’চোখ যায়, দেখা মেলে পাইত্রাগাছের বাগান। গ্রামীণ সড়কের দুই পাশে দেখা মেলে বড় বড় পাইত্রা বা মোর্তাগাছের ঝোপ। বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত ফসলি জমি, পুকুর পাড়, সব জায়গাতেই বর্ষজীবী উদ্ভিদ তরতাজা পাইত্রাগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের আভিজাত্যের স্মারক শীতলপাটি তৈরি হয়, এই পাইত্রাগাছের বেতি দিয়ে।

জানা গেছে, এসব গ্রামে পাইত্রাগাছের আবাদ হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। পাটিকরদের পূর্বপুরুষেরা যে পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, আজও সেই পেশা ধরে রেখেছেন বাকেরগঞ্জের পাটিকররা।

এখনো এই সব গ্রামে ‘পাটিকর’ পেশায় টিকে আছে প্রায় এক হাজার পরিবার। আর তাদের সবার পেশাই শীতলপাটি বুনন। ফলে, উপজেলার এসব গ্রাম এখন ‘পাটিকর গ্রাম’ নামে পরিচিত।

সরেজমিন দেখা যায়, কাঁঠালিয়া, রাজাপুর ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো গ্রামীণ সড়ক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ছোট ছোট টিনশেড ও আধাপাকা ঘরগুলোর বারান্দায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা মিলে নানান রঙের শীতলপাটি বুনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কাঁঠালিয়া গ্রামের সবিতা রানীর পরিবারের সবাই মিলে দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটান শীতলপাটি তৈরি করতে। একটু সামনে এগুতেই কথা হয়, প্রিয়লাল পাটিকরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, পরিবারের পাঁচ সদস্য মিলে একটি পাটি তৈরি করতে কয়েকদিন চলে যায়। প্রতিজনের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা করেও আসে না। তারপরেও কিছু করার নেই। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এখনো শীতল পাটি বুনে যাচ্ছি। একদিকে, এখন গরম বেড়েছে, অপরদিকে, বৈশাখ মাস চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বৈশাখী মেলায় শীতলপাটির চাহিদা থাকে। তাই, পাইকাররা এসে আমাদের এলাকা থেকে পাটি কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করেন।

স্থানীয় পাটিকররা জানান, এখানকার তৈরি শীতলপাটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু প্লাস্টিক পাটির কারণে বাজারে শীতলপাটির চাহিদা কমে গেছে। সে কারণে সরকারিভাবে বিদেশে শীতলপাটি রফতানির কোনো ব্যবস্থা করা হলে পাটিকরদের জীবন-জীবিকা ভালো চলতো।

পাশাপাশি শীতলপাটি টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা। নয়ত এই পেশায় টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসন, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাসহ জাইকা সংস্থার মাধ্যমে উপজেলার পাটিকরদের মধ্যে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। ফলে, নতুন নতুন ডিজাইনের শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা তাদের সরকারি বিভিন্ন রকম সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

;