বিড়ালের জন্য বিরল ভালবাসা
বিড়ালের প্রতি ভালবাসার অসামান্য নজীর গড়েছেন নারায়ণগঞ্জ সদরের পশ্চিম মাসদাইর এলাকার বিড়ালপ্রেমী জাহানারা খানম মুক্তা। স্থানীয়ভাবে তিনি ‘বিড়ালের মা’ হিসাবেও পরিচিত। সকালে তার ঘুম ভাঙ্গে বিড়ালের মিউ মিউ ডাকে, রাতে ঘুমাতে যান বিড়ালের মিউ মিউ মিউজিক শুনতে শুনতে।
ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে মুক্তার বিড়ালপ্রেম সমন্ধে জানতে পারি। ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায় তার সাথে কথা হলে তিনি মিডিয়ার সামনে আসতে অস্বীকৃতি জানান। পরে অনুরোধে ২ নভেম্বর তার বাসায় সময় দিতে রাজি হন।
নির্ধারিত দিনে সকাল পৌনে দশটায় তার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাচ্চাদের পৌনে এগারটায় খাবার দিতে হবে। আপনি আসলে তার আগে আসবেন নতুবা অন্য একদিন আসুন। আমি এক্ষুণি আসছি বলে যে অবস্থায় ছিলাম সে অবস্থায়ই পড়িমরি করে মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলাম। অবরোধের দিন হওয়ায় শাপে বর হলো। রাস্তাঘাট ফাঁকাই ছিল। ঢাকা থেকে নির্ধারিত সময়েই নারায়নগঞ্জের মাজদাইর কবরস্থানের কাছে গিয়ে পৌছলাম। স্থানীয়দের কাছে ‘বিড়াল পালে মুক্তার আপার বাসা’র কথা জিজ্ঞাসা করতেই পথ দেখিয়ে দিল।
বাসার নিচে গিয়ে ফোন দিতেই তিনি বাসার সহকারী আনোয়ার হোসেনসহ নিচে নেমে আসেন। সাথে তিনটি ব্যাগে ভাসমান বিড়ালদের জন্য তিন পদের খাবার।
বাড়ির চারিদিকে ৫টি স্থানে প্রায় ৩৫-৪০ ছিন্নমূল বিড়ালদের তিনি প্রতিদিন একবেলা তিন পদের খাবার দেন। যেহেতু তারা প্রকৃতিতে থাকে আর সেখান থেকেও তারা খাবার সংগ্রহ করতে পারে তাই তাদের অন্তত একবেলা পেটপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেন তিনি।
বিড়ালদের খাবার দিতে দিতে বার্তা২৪.কমের প্রতিনিধি কথা বলেন জাহানারা খানম মুক্তার সাথে। তিনি বলেন, ‘শহরের প্রকৃতিতে বন-জঙ্গল আর নেই। ফলে প্রকৃতিতে বিচরণ করা প্রাণীদের খাবার সংকট তৈরি হচ্ছে। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত প্রকৃতিতে বিচরণ করা প্রাণী যেমন কুকুর, বিড়াল পাখিদের জন্য অন্তত একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু মানুষ তাদের প্রতি সদয় না হয়ে নির্দয় আচরণ করে।’
তাদের তিন পদের কী খাবার দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি জানান, চাপিলা মাছ, যে কোন এক পদের দেশী মাছ যেমন, নলা, সরপুঁটি, মৃগেল ইত্যাদি ও মুরগির মাংস। সবগুলোই সাদা ভাতের সাথে মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করে দেওয়া হয়। যদিও রাস্তার ধারে খাবার দেওয়া হয় কিন্তু তাতে যেন পরিবেশ নষ্ট না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখেন তিনি।
এরপর তার বাসায় যাই। বাসায় ঢুকতেই গোটা কতক বিড়াল মিউ মিউ করে আমাদের স্বাগত জানালো। আমি ভেবেছিলাম হয়তো ফ্ল্যাটে গন্ধ হবে। কিন্তু কোন খারাপ গন্ধ না পেয়ে অবাক হলাম। জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন, তার বাচ্চারা সবাই বাথরুমে কাজ সারে। কেউ কেউ আবার কমেডও ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে পানি ঢেলে দিলে আর কোন গন্ধ থাকে না।
শুরু যেভাবে-
মুক্তার দুই মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মিফতি ও আফিয়া জাহান মাহিয়া। মেয়েরা বর্তমানে আমেরিকায় থাকেন। স্বামী আমজাদ তালুকদার গত আগস্টে ক্যান্সারে মারা যান।
মুক্তা বলেন, আমাদের পুরো পরিবারটিই ছিল অ্যানিমেল লাভার। ছোটবেলা থেকেই কুকুর-বিড়ালের প্রতি আলাদা টান ছিল। বাড়িতে ৮-১০টা বিড়াল ছিল। তবে ধর্মীয় কারনে কুকুরকে বাড়িতে আনতে পারি না। পথে ঘাটে তাদের দেখলে সেখানেই কিছু কিনে তাদের খেতে দিতাম। তবে বিয়ের পর সেভাবে বিড়ালে পোষা হয়নি।
২০১৬ সালের দিকে তিনি একটি মেয়ে বিড়ালকে অসহায় দেখতে পেয়ে বাসায় নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে সে আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে। সে ছয়টি বাচ্চা দেয়। তারাও আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে যায়। তখন নিউটার করা বুঝতাম না। আস্তে আস্তে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় তা ৮০তে গিয়ে ঠেকে। তিনি দাবী করেন, কোন বিড়ালকে জোর করে ধরে এনে এখানে রাখা হয়নি। তারা বিভিন্ন সময় আহত, অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে বাসায় এনে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তারা এখানে আদর, ভালবাসা, খাবার ও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পেয়ে তারপর আর ফেরত যায়নি।
খাবার ব্যবস্থাপনা-
প্রতিদিন নিয়ম করে তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়। আর বাসার বাইরের ভাসমান বিড়ালদের দেওয়া হয় পেট পুরে এক বেলা খাবার। খাবারের মধ্যে থাকে চাপিলা মাছ, দেশী যে কোন এক ধরণের মাছ ও মুরগির মাংস। বাসার সদস্যদের বিকালে অল্প পরিমানে ক্যাট ফিড দেওয়া হয়। বাজার সদাই করে আনোয়ার। মুক্তা মেয়েদের কাছে আমেরিকায় গেলে বাচ্চাদের সমস্ত দায়িত্ব এই আনোয়ারের কাঁধেই বর্তায়। আর রান্না বান্নার জন্য রাশেদা নামে একজন বুয়া রাখা আছে।
মুক্তা বলেন, ‘আমার বাচ্চাদের খাবার না দিয়ে আমি কখনও আগে খাবার খায় না।’ মাছ সংরক্ষণের জন্য একটি ডিপ ফ্রিজ রয়েছে। ফ্রিজ খুলে দেখলাম মাছ মাংসে ভরা আছে ফ্রিজটি। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে গরম করার জন্য আছে মাইক্রোওভেন।
শোবার ব্যবস্থাপনা-
বাচ্চাদের জন্য ১৩৫০ স্কয়ার ফিটের টাইলস করা দুটো ফ্ল্যাট ভাড়া নেন মুক্তা। তাদের শোবার জন্য আছে পর্যাপ্ত দোতলা তিনতলা চৌকি। চৌকির উপর নরম বিছানায় পরিস্কার চাদর বিছানো থাকে। এ ছাড়া অসংখ্য র্যাক ও কাঠের কেবিন করা আছে। বারান্দায় যাতে বসে রোদ পোহাতে পারে তার জন্যও ব্যবস্থা করা আছে। ঘরের এমন কোন আসবাবপত্র, ফার্নিচার নাই যার উপরে কিংবা চিপায় চাপায় বিড়াল নাই। খেলাধুলার জন্য প্লাস্টিকের বল ছড়ানো আছে। সেগুলো নিয়েই তারা খেলা করে।
একটি রুমে এসি আছে। মুক্তা জানান, বাচ্চারা অতি গরমে হাঁপিয়ে উঠলে এসি ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার শীতকালে অতি শীত পড়লে রুম হিটার দিয়ে রুম গরম রাখা হয়। যেহেতু ৭ম তলায় ফ্ল্যাটে থাকেন মুক্তা। তাই বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি জানালা ও বারান্দার গ্রীলে নেট দেওয়া রয়েছে। যাতে তারা উপর থেকে পড়ে না যায়।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা-
মুক্তার বাসা ছোট খাট একটা ভেট ফার্মেসি। তার প্রতিটি বাচ্চা নিউটার করা, ভ্যাকসিন দেওয়া। ছোট খাট অসুখ বিসুখের জন্য মুক্তা নিজেই চিকিৎসা করতে পারেন। মুক্তা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বাচ্চাদের পায়খানা, গায়ের তাপমাত্রা, খাওয়ার অনীহা, খেলাধুলা কম দেখেই বলে দিতে পারি কার কি অসুখ। কাকে কি ঔষধ দিতে হবে।’ ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে তিনি নিজেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। তবে বড় কোন অসুখ তিনি বুঝতে পারলে পশু ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। তিনি জানান, ‘গতকাল ১ নভেম্বর চারটি বাচ্চাকে নিয়ে পূর্বাচলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাদের এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাফি ও রক্ত পরীক্ষা করিয়েছি। প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া ভিডিও করে ডাক্তার দেখিয়ে তার কাছ থেকে প্রেসক্রিপসন নিয়ে নিজেই চিকিৎসা করতে পারি। বলতে পারেন আমি একজন হাতুড়ে পশু ডাক্তার।’
নামকরণ-
প্রত্যেক বিড়াল সদস্যের একটি করে বাহারী নাম আছে। মুক্তা জানান, যারা পুরনো সদস্য তারা নাম ধরে ডাকলে রেসপন্স করে। আর নাম থাকলে তাদের আইডেন্টিফাই করা সহজ হয়। তাদের কী কী নাম রেখেছেন জানতে চাইলে মুক্তা জানান, কারও নাম হোজো, তোজো, নিকো, পিকো, বুলবুলি, আইজাক, শ্যাডে, পিনাট, অ্যালিজা, ক্যাথিজা, নুদু প্রভৃতি। তারা অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে তাদের নিজ নিজ নামেই প্রেসক্রিপশন করা হয়।
দায়বদ্ধতা-
মুক্তা বলেন, সমাজের কাছে আমাদের সবারই কম-বেশী দায়বদ্ধতা আছে। সেই দায়বদ্ধতা ও ভালবাসা থেকেই বিড়াল পোষা। তাদের খাইয়ে, সেবাযত্ন করে তিনি পান এক স্বর্গীয় আনন্দ। শুধু শখ থেকেই বিড়াল পোষা নয়। তাহলেতো বিদেশী বিড়াল পুষতাম।
তিনি শুধু নিজের বিড়ালেরই যত্ন নেন না। খবর পেলে প্রতিবেশীর বিড়ালকে চিকিৎসা দিয়ে আসেন। খোঁজ খবর নেন। হাসপাতালে নিতে হলে তার ব্যবস্থা করেন। যারা অসহায় কিন্তু বিড়াল পুষতে আগ্রহী তাদের বিড়ালের খাবারের জন্য ডোনেট করেন।
প্রতিদিন প্রায় শতাধিক বিড়ালকে খাবার যোগাতে মাসে প্রায় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা তার খরচ হয়। প্রতিবেশীর কটু কথা শুনতে হয়। অনেক আত্মীয় তার বাড়ি আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে তার বিড়ালের প্রতি তার ভালবাসা কমেনি। তিনি বলেন, শহরের মানুষ ব্যাগ ভর্তি করে উচ্ছিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলে। সেখান থেকে পরিচ্ছন্নতা কর্মী তা ট্রাকে করে বহুদূরে নিয়ে ফেলে। তাহলে কুকুর বিড়াল খাবে কি। মানুষ হিসাবে সমাজের কাছে সবার দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।
তবে এতোদিন যত্নে থাকলেও এবার বুঝি বিড়ালদের কপাল মন্দ হতে চলেছে। স্বামী মারা যাবার পর তিনি আমেরিকায় মেয়েদের কাছে স্থায়ী হতে চান। সেক্ষেত্রে বিড়ালগুলো তাদের অভিভাবক হারাবে। যতদিন একটা ব্যবস্থা না হয় যদিও আনোয়ার তাদের দেখভাল করবে। তবুও আমেরিকা যাওয়ার আগে ভাল কোন পরিবার বিড়াল নিতে আগ্রহী হলে তাদের জিম্মায় দিয়ে তিনি শান্তিতে দূর দেশে গিয়ে থাকতে পারেন। নতুবা সেখানে থেকেও তার মন কাঁদবে তার আদরের ভালবাসার বাচ্চাদের জন্য।
যারা নিতে আগ্রহী-
ইতোমধ্যে প্রায় ৩০টি বিড়াল বিভিন্ন পরিবার নিয়ে গেছেন। আমেরিকা যাওয়ার আগে তিনি স্বচ্ছল বিড়ালপ্রেমী পরিবার যারা বিড়ালকে সন্তানতুল্য মনে করবেন তাদের জিম্মায় দিয়ে যেতে চান জাহানারা খানম মুক্তা। তবে এ জন্য কিছু শর্ত পালন করতে হবে।
-বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য জানালা ও বারান্দার গ্রীলে নেট লাগাতে হবে। ভিডিও কলে তাকে দেখাতে হবে
-বিড়ালে খাবার, চিকিৎসার বিষয়ে যত্নশীল হতে হবে।
-তাদের মারা যাবে না কিংবা তাদের প্রতি নির্মম আচরণ করা যাবে না।
-একসাথে অন্তত দুটো বিড়াল নিতে হবে।
যারা বিড়ালপ্রেমী তারা বিড়াল নিতে জাহানারা খানম মুক্তার সাথে ০১৭১৮০৩৪১৩৪ নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন।