বিড়ালের জন্য বিরল ভালবাসা



মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
বিড়ালের জন্য বিরল ভালবাসা

বিড়ালের জন্য বিরল ভালবাসা

  • Font increase
  • Font Decrease

বিড়ালের প্রতি ভালবাসার অসামান্য নজীর গড়েছেন নারায়ণগঞ্জ সদরের পশ্চিম মাসদাইর এলাকার বিড়ালপ্রেমী জাহানারা খানম মুক্তা। স্থানীয়ভাবে তিনি ‘বিড়ালের মা’ হিসাবেও পরিচিত। সকালে তার ঘুম ভাঙ্গে বিড়ালের মিউ মিউ ডাকে, রাতে ঘুমাতে যান বিড়ালের মিউ মিউ মিউজিক শুনতে শুনতে।

ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে মুক্তার বিড়ালপ্রেম সমন্ধে জানতে পারি। ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায় তার সাথে কথা হলে তিনি মিডিয়ার সামনে আসতে অস্বীকৃতি জানান। পরে অনুরোধে ২ নভেম্বর তার বাসায় সময় দিতে রাজি হন।

নির্ধারিত দিনে সকাল পৌনে দশটায় তার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাচ্চাদের পৌনে এগারটায় খাবার দিতে হবে। আপনি আসলে তার আগে আসবেন নতুবা অন্য একদিন আসুন। আমি এক্ষুণি আসছি বলে যে অবস্থায় ছিলাম সে অবস্থায়ই পড়িমরি করে মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলাম। অবরোধের দিন হওয়ায় শাপে বর হলো। রাস্তাঘাট ফাঁকাই ছিল। ঢাকা থেকে নির্ধারিত সময়েই নারায়নগঞ্জের মাজদাইর কবরস্থানের কাছে গিয়ে পৌছলাম। স্থানীয়দের কাছে ‘বিড়াল পালে মুক্তার আপার বাসা’র কথা জিজ্ঞাসা করতেই পথ দেখিয়ে দিল।


বাসার নিচে গিয়ে ফোন দিতেই তিনি বাসার সহকারী আনোয়ার হোসেনসহ নিচে নেমে আসেন। সাথে তিনটি ব্যাগে ভাসমান বিড়ালদের জন্য তিন পদের খাবার।

বাড়ির চারিদিকে ৫টি স্থানে প্রায় ৩৫-৪০ ছিন্নমূল বিড়ালদের তিনি প্রতিদিন একবেলা তিন পদের খাবার দেন। যেহেতু তারা প্রকৃতিতে থাকে আর সেখান থেকেও তারা খাবার সংগ্রহ করতে পারে তাই তাদের অন্তত একবেলা পেটপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেন তিনি।

বিড়ালদের খাবার দিতে দিতে বার্তা২৪.কমের প্রতিনিধি কথা বলেন জাহানারা খানম মুক্তার সাথে। তিনি বলেন, ‘শহরের প্রকৃতিতে বন-জঙ্গল আর নেই। ফলে প্রকৃতিতে বিচরণ করা প্রাণীদের খাবার সংকট তৈরি হচ্ছে। তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত প্রকৃতিতে বিচরণ করা প্রাণী যেমন কুকুর, বিড়াল পাখিদের জন্য অন্তত একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু মানুষ তাদের প্রতি সদয় না হয়ে নির্দয় আচরণ করে।’

তাদের তিন পদের কী খাবার দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি জানান, চাপিলা মাছ, যে কোন এক পদের দেশী মাছ যেমন, নলা, সরপুঁটি, মৃগেল ইত্যাদি ও মুরগির মাংস। সবগুলোই সাদা ভাতের সাথে মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করে দেওয়া হয়। যদিও রাস্তার ধারে খাবার দেওয়া হয় কিন্তু তাতে যেন পরিবেশ নষ্ট না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখেন তিনি।

এরপর তার বাসায় যাই। বাসায় ঢুকতেই গোটা কতক বিড়াল মিউ মিউ করে আমাদের স্বাগত জানালো। আমি ভেবেছিলাম হয়তো ফ্ল্যাটে গন্ধ হবে। কিন্তু কোন খারাপ গন্ধ না পেয়ে অবাক হলাম। জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন, তার বাচ্চারা সবাই বাথরুমে কাজ সারে। কেউ কেউ আবার কমেডও ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে পানি ঢেলে দিলে আর কোন গন্ধ থাকে না।


শুরু যেভাবে-

মুক্তার দুই মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মিফতি ও আফিয়া জাহান মাহিয়া। মেয়েরা বর্তমানে আমেরিকায় থাকেন। স্বামী আমজাদ তালুকদার গত আগস্টে ক্যান্সারে মারা যান।

মুক্তা বলেন, আমাদের পুরো পরিবারটিই ছিল অ্যানিমেল লাভার। ছোটবেলা থেকেই কুকুর-বিড়ালের প্রতি আলাদা টান ছিল। বাড়িতে ৮-১০টা বিড়াল ছিল। তবে ধর্মীয় কারনে কুকুরকে বাড়িতে আনতে পারি না। পথে ঘাটে তাদের দেখলে সেখানেই কিছু কিনে তাদের খেতে দিতাম। তবে বিয়ের পর সেভাবে বিড়ালে পোষা হয়নি।

২০১৬ সালের দিকে তিনি একটি মেয়ে বিড়ালকে অসহায় দেখতে পেয়ে বাসায় নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে সে আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে। সে ছয়টি বাচ্চা দেয়। তারাও আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে যায়। তখন নিউটার করা বুঝতাম না। আস্তে আস্তে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় তা ৮০তে গিয়ে ঠেকে। তিনি দাবী করেন, কোন বিড়ালকে জোর করে ধরে এনে এখানে রাখা হয়নি। তারা বিভিন্ন সময় আহত, অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে বাসায় এনে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তারা এখানে আদর, ভালবাসা, খাবার ও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পেয়ে তারপর আর ফেরত যায়নি।

খাবার ব্যবস্থাপনা-

প্রতিদিন নিয়ম করে তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়। আর বাসার বাইরের ভাসমান বিড়ালদের দেওয়া হয় পেট পুরে এক বেলা খাবার। খাবারের মধ্যে থাকে চাপিলা মাছ, দেশী যে কোন এক ধরণের মাছ ও মুরগির মাংস। বাসার সদস্যদের বিকালে অল্প পরিমানে ক্যাট ফিড দেওয়া হয়। বাজার সদাই করে আনোয়ার। মুক্তা মেয়েদের কাছে আমেরিকায় গেলে বাচ্চাদের সমস্ত দায়িত্ব এই আনোয়ারের কাঁধেই বর্তায়। আর রান্না বান্নার জন্য রাশেদা নামে একজন বুয়া রাখা আছে।

মুক্তা বলেন, ‘আমার বাচ্চাদের খাবার না দিয়ে আমি কখনও আগে খাবার খায় না।’ মাছ সংরক্ষণের জন্য একটি ডিপ ফ্রিজ রয়েছে। ফ্রিজ খুলে দেখলাম মাছ মাংসে ভরা আছে ফ্রিজটি। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে গরম করার জন্য আছে মাইক্রোওভেন।

শোবার ব্যবস্থাপনা-

বাচ্চাদের জন্য ১৩৫০ স্কয়ার ফিটের টাইলস করা দুটো ফ্ল্যাট ভাড়া নেন মুক্তা। তাদের শোবার জন্য আছে পর্যাপ্ত দোতলা তিনতলা চৌকি। চৌকির উপর নরম বিছানায় পরিস্কার চাদর বিছানো থাকে। এ ছাড়া অসংখ্য র‌্যাক ও কাঠের কেবিন করা আছে। বারান্দায় যাতে বসে রোদ পোহাতে পারে তার জন্যও ব্যবস্থা করা আছে। ঘরের এমন কোন আসবাবপত্র, ফার্নিচার নাই যার উপরে কিংবা চিপায় চাপায় বিড়াল নাই। খেলাধুলার জন্য প্লাস্টিকের বল ছড়ানো আছে। সেগুলো নিয়েই তারা খেলা করে।

একটি রুমে এসি আছে। মুক্তা জানান, বাচ্চারা অতি গরমে হাঁপিয়ে উঠলে এসি ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার শীতকালে অতি শীত পড়লে রুম হিটার দিয়ে রুম গরম রাখা হয়। যেহেতু ৭ম তলায় ফ্ল্যাটে থাকেন মুক্তা। তাই বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি জানালা ও বারান্দার গ্রীলে নেট দেওয়া রয়েছে। যাতে তারা উপর থেকে পড়ে না যায়।


চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা-

মুক্তার বাসা ছোট খাট একটা ভেট ফার্মেসি। তার প্রতিটি বাচ্চা নিউটার করা, ভ্যাকসিন দেওয়া। ছোট খাট অসুখ বিসুখের জন্য মুক্তা নিজেই চিকিৎসা করতে পারেন। মুক্তা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বাচ্চাদের পায়খানা, গায়ের তাপমাত্রা, খাওয়ার অনীহা, খেলাধুলা কম দেখেই বলে দিতে পারি কার কি অসুখ। কাকে কি ঔষধ দিতে হবে।’ ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে তিনি নিজেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। তবে বড় কোন অসুখ তিনি বুঝতে পারলে পশু ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। তিনি জানান, ‘গতকাল ১ নভেম্বর চারটি বাচ্চাকে নিয়ে পূর্বাচলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাদের এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাফি ও রক্ত পরীক্ষা করিয়েছি। প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া ভিডিও করে ডাক্তার দেখিয়ে তার কাছ থেকে প্রেসক্রিপসন নিয়ে নিজেই চিকিৎসা করতে পারি। বলতে পারেন আমি একজন হাতুড়ে পশু ডাক্তার।’

নামকরণ-

প্রত্যেক বিড়াল সদস্যের একটি করে বাহারী নাম আছে। মুক্তা জানান, যারা পুরনো সদস্য তারা নাম ধরে ডাকলে রেসপন্স করে। আর নাম থাকলে তাদের আইডেন্টিফাই করা সহজ হয়। তাদের কী কী নাম রেখেছেন জানতে চাইলে মুক্তা জানান, কারও নাম হোজো, তোজো, নিকো, পিকো, বুলবুলি, আইজাক, শ্যাডে, পিনাট, অ্যালিজা, ক্যাথিজা, নুদু প্রভৃতি। তারা অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে তাদের নিজ নিজ নামেই প্রেসক্রিপশন করা হয়।

দায়বদ্ধতা-

মুক্তা বলেন, সমাজের কাছে আমাদের সবারই কম-বেশী দায়বদ্ধতা আছে। সেই দায়বদ্ধতা ও ভালবাসা থেকেই বিড়াল পোষা। তাদের খাইয়ে, সেবাযত্ন করে তিনি পান এক স্বর্গীয় আনন্দ। শুধু শখ থেকেই বিড়াল পোষা নয়। তাহলেতো বিদেশী বিড়াল পুষতাম।

তিনি শুধু নিজের বিড়ালেরই যত্ন নেন না। খবর পেলে প্রতিবেশীর বিড়ালকে চিকিৎসা দিয়ে আসেন। খোঁজ খবর নেন। হাসপাতালে নিতে হলে তার ব্যবস্থা করেন। যারা অসহায় কিন্তু বিড়াল পুষতে আগ্রহী তাদের বিড়ালের খাবারের জন্য ডোনেট করেন।

প্রতিদিন প্রায় শতাধিক বিড়ালকে খাবার যোগাতে মাসে প্রায় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা তার খরচ হয়। প্রতিবেশীর কটু কথা শুনতে হয়। অনেক আত্মীয় তার বাড়ি আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে তার বিড়ালের প্রতি তার ভালবাসা কমেনি। তিনি বলেন, শহরের মানুষ ব্যাগ ভর্তি করে উচ্ছিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলে। সেখান থেকে পরিচ্ছন্নতা কর্মী তা ট্রাকে করে বহুদূরে নিয়ে ফেলে। তাহলে কুকুর বিড়াল খাবে কি। মানুষ হিসাবে সমাজের কাছে সবার দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।

তবে এতোদিন যত্নে থাকলেও এবার বুঝি বিড়ালদের কপাল মন্দ হতে চলেছে। স্বামী মারা যাবার পর তিনি আমেরিকায় মেয়েদের কাছে স্থায়ী হতে চান। সেক্ষেত্রে বিড়ালগুলো তাদের অভিভাবক হারাবে। যতদিন একটা ব্যবস্থা না হয় যদিও আনোয়ার তাদের দেখভাল করবে। তবুও আমেরিকা যাওয়ার আগে ভাল কোন পরিবার বিড়াল নিতে আগ্রহী হলে তাদের জিম্মায় দিয়ে তিনি শান্তিতে দূর দেশে গিয়ে থাকতে পারেন। নতুবা সেখানে থেকেও তার মন কাঁদবে তার আদরের ভালবাসার বাচ্চাদের জন্য।

যারা নিতে আগ্রহী-

ইতোমধ্যে প্রায় ৩০টি বিড়াল বিভিন্ন পরিবার নিয়ে গেছেন। আমেরিকা যাওয়ার আগে তিনি স্বচ্ছল বিড়ালপ্রেমী পরিবার যারা বিড়ালকে সন্তানতুল্য মনে করবেন তাদের জিম্মায় দিয়ে যেতে চান জাহানারা খানম মুক্তা। তবে এ জন্য কিছু শর্ত পালন করতে হবে।

-বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য জানালা ও বারান্দার গ্রীলে নেট লাগাতে হবে। ভিডিও কলে তাকে দেখাতে হবে

-বিড়ালে খাবার, চিকিৎসার বিষয়ে যত্নশীল হতে হবে।

-তাদের মারা যাবে না কিংবা তাদের প্রতি নির্মম আচরণ করা যাবে না।

-একসাথে অন্তত দুটো বিড়াল নিতে হবে।

যারা বিড়ালপ্রেমী তারা বিড়াল নিতে জাহানারা খানম মুক্তার সাথে ০১৭১৮০৩৪১৩৪ নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন।

   

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: রসে সেরা, স্বাদে সেরা!



আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, টাঙ্গাইল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

চমচমের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে! তারপরে যদি হয় সেই টাঙ্গাইলের চমচম! তাহলে তো কথাই নেই! ছোট-বড় সব বয়েসি মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকে- টাঙ্গাইলের চমচম।

কথায় আছে, ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা তো সবারই জানা। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস।

ইতিহাস বলছে, দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই।

বর্তমানে ‘টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্টি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাচঁআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চম চম, স্বাদে সেরা, মানে সেরা, ছবি-বার্তা২৪.কম

এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে, চমচমের দোকান। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন-২০১৩ অনুয়ায়ী, চলতি বছরের (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত শত শত কারিগর কাজ করছেন। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্বাল হচ্ছে চমচমের। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় কারিগররাও খুশি।

বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে, মান ভেদে তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে।

মিষ্টি কিনতে আসা সাগর বার্তা২৪.কমকে বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি আমাদের ঐতিহ্য ও আমাদের গর্বের। টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারে আসলে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। ছোট বড় সবাই টাঙ্গাইলের মিষ্টি পছন্দ করেন।

মিষ্টি কিনতে আসা আরেকজন হরিপদ সরকার বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আমি যেমন টাঙ্গাইলের মিষ্টির জন্য এসেছি, আমার মতো অনেকেই টাঙ্গাইলের মিষ্টি নিতে এসেছেন। এই মিষ্টির স্বাদ অন্যরকম! না-খেলে বোঝা যাবে না।

মিষ্টি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ কর্মকার বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য পোড়াবাড়ির চমচম। প্রায় দুইশ বছর আগে থেকেই টাঙ্গাইলে পোড়াবাড়ির মিষ্টি তৈরি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের মিষ্টির সুনাম দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে। আমাদের পোড়াবাড়ির চমচমে ভেজাল কোনো কিছু যুক্ত করা হয় না। চমচম স্বাদ হওয়ার কারণ খাঁটি দুধ, ছানা ও ময়দা দিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করা হয়। এজন্য এত স্বাদ! প্রতিদিন দোকানগুলিতে ৫ থেকে ১০ মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়।

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা, ছবি- বার্তা২৪.কম 

মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ বলেন, আমি ৪০-৪৫ বছর ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মিষ্টি স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। মিষ্টির স্বীকৃতি পাওয়ায় আমাদের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের মিষ্টি দেশের বাইরে পাঠাতে পারবো। আমাদের মিষ্টি চাহিদা আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে আমাদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।

সরকারের কাছে দাবি, বিদেশে এই মিষ্টি রফতানি করার ব্যবস্থা করলে আমাদের বিক্রি আরোও বাড়বে। তখন আমরা আরো বেশি বেশি মিষ্টি তৈরি করতে পারবো।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, সারাদেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অনেক খুশি। এই মিষ্টি যদি বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে আমাদের ব্যবসা আরো প্রসার পাবে।

তিনি বলেন, আমার বাবা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই মিষ্টির ব্যবসায় আসা। আমি করছি। আমার ছেলেও এই পেশায় আছে। পোড়াবাড়ির চমচমের ইতিহাস প্রায় দুইশ বছরের। টাঙ্গাইলের চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে, গাভির দুধ চরাঞ্চল থেকে আসে। এখানকার দুধ অনেক ভালো হয় আর জলেরও একটা বিষয় আছে! দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয় অন্যরকম। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। এই মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

;

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;