শহর কলকাতার উত্থানপর্ব
জব চার্নকের কলকাতা
পরিকল্পনা মতে, জব চার্নক ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৬৯১ সালে আসাদ খাঁর মোহর যুক্ত সম্রাটের যে ফরমান চার্নককে দেওয়া হয়, তাতে শর্ত ছিল যে সর্বপ্রকার শুল্কের পরিবর্তে কেবল বার্ষিক তিন হাজার টাকা জমা দিলে ইংরেজ কোম্পানি বাংলায় নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে।
সুতানুটিতে জায়গা পেয়ে বিচক্ষণ ব্যবসায়ী ও সুকৌশলী জব চার্নক হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। বরং কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়ে তিনি কর্মচারীদের বাসস্থান স্থাপন ও কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে স্থানীয় জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীদের পাকা কাচারি বাড়িটি ক্রয় করেন।
পাশাপাশি ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয়দের ধর্মীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য পর্তুগীজদের কাছ থেকে একটি প্রার্থনাগৃহও ক্রয় করেন। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্য ও অন্যান্য স্বার্থ সদৃঢ় করার সময়কালেই তিনি কলকাতার মাটিতে ১৬৯৩ সালের ১০ জানুয়ারিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কলকাতাতেই তাকে সমাহিত করা হয়। স্বল্প সময়ের অবস্থানকালে তিনি একজন স্থানীয় রমণীকে বিয়ে করেছিলেন।
মৃত্যুর আগে জব চার্নক কলিকাতা কুঠির কর্তৃত্ব ফ্রান্সিস এলিসকে প্রদান করে গিয়েছিলেন। কিন্তু এলিসের তত্ত্বাবধানে কলিকাতা কুঠির অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকায় এদেশে কোম্পানির তৎকালীন সর্বময় প্রধান (Commissary General and Chief Governor of the Company’s Settlement) স্যার জন গোল্ডসবরো মাদ্রাস থেকে কলকাতা পরিদর্শনে এসে উপস্থিত হন। কলকাতায় বাণিজ্য কুঠির হাল ফেরানোর জন্য তিনি কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সে মতে পর্তুগীজদের কাছ থেকে কেনা প্রার্থনা গৃহটি ভেঙে ফেলা হয় এবং কুঠিবাড়ির চতুষ্পার্শ্বে মাটির প্রাচীর গড়ে তোলার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু কুঠিবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাকাপাকি কোনো সামরিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আগেই ১৬৯৩ সালের নভেম্বর মাসে গোল্ডসবরোও কলিকাতাতেই পরলোক গমন করেন। কলকাতার কুঠির ভার অর্পণের জন্য তিনি ঢাকা থেকে চার্নকের জামাতা চার্লস আয়ারকে তলব করলেও তার মৃত্যুর আগে কলকাতায় এসে পৌঁছাতে পারেননি আয়ার।
গোল্ডসবরোর মৃত্যুর দু’মাস পরে ক্যাপ্টেন রবার্ট ডোরিল কোম্পানির একটি হুকুমনামা সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় আসেন এবং ২৫ জানুয়ারি ১৮৯৪ সালে কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের সামনে তা পাঠ করেন। এই আদেশের বলে ফ্রান্সিস এলিসের কাছ থেকে সুতানুটি কুঠির ভার কেড়ে নিয়ে তার স্থলে চার্লস আয়ারকে নিযুক্ত করা হয়। আয়ারের অন্যতম কীর্তি ছিল কলিকাতার সেন্ট জন চার্চের অভ্যন্তরে জোব চার্নকের সমাধির উপর একটি দর্শনীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ।
এদিকে ১৬৯৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ‘কোর্ট অব ডিরেক্টরস’ ইংল্যান্ড থেকে নিদের্শ দেন যে, বাংলায় প্রধান অধ্যক্ষ বা চিফ এজেন্টের বাসস্থান হবে সুতানুটি, তখন পর্যন্ত কলকাতা নামটি প্রতিষ্ঠা পায়নি। এর ফলে ইংরেজ স্বার্থের কেন্দ্র হিসাবে সুতানুটিকে ভিত্তি করে কলকাতার বিকাশ-পথ সুগম হয় এবং তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদ ও প্রাচীন রাজধানী ঢাকার প্রতিদ্বন্দ্বী রপে ইংরেজরা গোপনে কলকাতাকে গড়ে তোলার প্রয়াস পায়।
‘কোর্ট অব ডিরেক্টরস’ -এর নির্দেশে আরও বলা হয় যে, কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তারের জন্য আরও দুই-তিনটি গ্রাম অধিকারের ব্যবস্থা করা হোক। নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চার্লস আয়ার স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে অতিরিক্ত স্থান সংগ্রহের ও তার আইনগত স্বত্ত্ব অধিকারের চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু তার সে চেষ্টা সফল হয়নি।
আপাত ব্যর্থ ইংরেজদের সামনে কিছুদিন পরেই সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় শোভা সিংহের বিদ্রোহ। শোভা সিংহ ছিলেন দক্ষিণ রাঢ়ের বিদ্রোহী জমিদার। তার পিতা রঘুনাথ সিংহ মান্দারণের অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলার চেতুয়া পরগনা ক্রয় করে শাসন করতে থাকেন। শোভা সিংহ জমিদার হবার পর বরদা পরগনার বাগদী রাজাদের পরাজিত করে তাদের রাজ্য অধিকার করেন এবং কিছুদিন পর তিনি মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।
চন্দ্রকোণার রাজা রঘুনাথ সিংহ, বিষ্ণুপুরের দ্বিতীয় গোপাল সিংহ এবং ঊড়িষ্যার পাঠান দলপতি আব্দুর রহিম খাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি ১৬৯৬ সালে বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণ রায়কে পরাজিত ও নিহত করেন। বিশৃঙ্খল এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং সংঘাতের ডামাঢোলের আড়ালে নিজেদের সুসংগঠিত করতে থাকে।
আরও পড়ুন: সুতানুটি থেকে কলকাতা