স্বীকৃতি চান পদ্মপুরাণ গানের শিল্পীরা
কেউ রিকশা চালান, কেউ দিনমজুর আবার কেউবা বাজারে আলু-পটল বিক্রি করেন, তবে তাদের মিল এক জায়গায়—তারা শিল্পী। গ্রামাঞ্চলে মানুষের মনের খোরাক যোগাতে আয়োজিত হয় পদ্মপুরাণ গানের আসর। রাত জেগে হয় মনসামঙ্গল কাব্যের নাটক পরিবেশন হয় সেইসব অনুষ্ঠানে।
সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি চলে নাচ-গান-নাটকের সম্মিলিত আয়োজন। মানুষের মনে সর্পদংশনের আতঙ্ক তাড়াতেও হয় পদ্মপুরাণ গানের আয়োজন। আবার চর্মজাতীয় ব্যাধি সারানোর উপায়ান্তর না পেয়েও পদ্মপুরান গানের আসর বসান স্থানীয়রা।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চরপাড়া এলাকার পদ্মাপুরাণ গানের দলের নেতা চঞ্চল আলী ফকির বার্তা২৪.কমকে বলেন, পদ্মপুরাণ গানের আসরের জন্য একটা দলে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য প্রয়োজন। প্রতি অনুষ্ঠানের জন্য আমরা ১০/১২ হাজার টাকা নেই। দুই দিন দুই রাত নিরন্তর পরিশ্রম শেষে পারিশ্রমিক পাই। আমরা তো অভিনয়ের মাধ্যমে, নাচে-গানে দর্শকদের বিনোদন দেই। তবু আমাদের শিল্পীর মর্যাদা দেওয়া হয় না। শিল্পী হিসেবে মানুষজন আমাদের স্বীকৃতি দেয় না।
ইউনুস আলী মৃধা নামে আরেক শিল্পী বলেন, পদ্মপুরাণ গানের দলে ১২-১৫ জন থাকে। ঢোলকসহ অন্যান্য বাদকের পাশাপাশি এক দলে অন্তত ৩/৪ জন পুরুষকে শাড়ি পরিয়ে, আলগা চুল লাগিয়ে ও মেকাপ করে নারী সাজানো হয়। দিন-রাত পরিশ্রম করে বেহুলা-লক্ষীন্দরের কাহিনী পরিবেশন হয়। শুধু অভিনয় নয়, অনেক গানও পরিবেশন করি আমরা।
ছাতিয়ান ইউনিয়নের সারুটিয়া গ্রামের তরিকুল ইসলাম মাটির তৈজসপত্র তৈরির পাশাপাশি পদ্মাপুরাণের দলে কাজ করেন। দুই দিন নিরন্তর পরিশ্রম শেষে ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা আয় হয় তার। তবে টাকাটা খুবই নগণ্য বলে মনে করেন তিনি। এই সামান্য টাকায় তার সংসার না চললেও মনের টানেই পদ্মপুরাণের আয়োজনে অংশ নেন বলে জানান তরিকুল ইসলাম।
সদর উপজেলার কবুরহাট এলাকার নয়ন আলী ক্ষেতমজুরের কাজ করেন। শখের বশে পদ্মপুরাণের দলে যোগ দেন তিনি। বার্তা২৪.কমকে নয়ন বলেন, এইসব অনুষ্ঠান করতে এসে আমাদের তেমন আয়-রোজগার না থাকায় ঠিকমত চলতে পারি না।
ভবিষ্যতে আর কেউ পদ্মপুরাণ করতে আসবে না, ঐতিহ্যে এই সাংস্কৃতিক আয়োজন হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন ক্ষেতমজুর নয়ন আলী।
কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মো. আমিরুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, পদ্মপুরাণে আসরে যারা অংশ নেন তারা অধিকাংশই দিনমজুর। রুটিরুজির জন্য অনেক পরিশ্রমের পরও তারা পদ্মপূরাণের মতো কঠিন আসরে অংশ নেন।
পদ্মপুরাণ গানের শিল্পীদের নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি কাজ করছে জানিয়ে আমিরুল ইসলাম বলেন, আদি সংস্কৃতির এই ধারাগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে এগুলোকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আঞ্চলিক লোক উৎসবে গাজীর গান, নসিমন, পদ্মপুরাণ পরিবেশন করা দলগুলোকে শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠান করা ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের উৎসবে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি।
কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সুজন রহমান বলেন, ঢোলক বাদ্যের সঙ্গে আরও কিছু বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কখনো গানের আসর আবার কখনো কথাকাব্য নিয়ে রচিত এই পদ্মপুরাণ গান। শিল্পীরা শখের বসে কিংবা ভালোলাগা থেকেই এসব দলের সদস্য হন। এসব শিল্পীর পরিবেশনা দর্শক-শ্রোতারা বেশ উপভোগ করেন। ঐতিহ্যের এই সংস্কৃতি যেন হারিয়ে না যায় সে জন্য শিল্পকলা একাডেমি উদ্যোগ নিচ্ছে।