মেঘপাহাড়ের ডাক-২

মাওলিননংয়ের পথে....

  • মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মেঘপাহাড়ের ডাক/ ছবি: বার্তা২৪.কম

মেঘপাহাড়ের ডাক/ ছবি: বার্তা২৪.কম

উমগট বিধৌত ডাউকি সীমান্ত অতিক্রম করতেই ‘খুবলেই’ ‘খুবলেই’ সমস্বরধ্বণি। প্রথমপ্রহর থেকে এতোক্ষণ ভ্রমণঘোরের মধ্যে ছিলাম। সম্বিত ফিরতে বুঝতে পারি পৌঁছে গেছি খাসি গারো জৈন্তাদের মেঘ-পাহাড়ের রাজ্য মেঘালয়। স্বাগত জানাতে তিনঘন্টা ড্রাইভ করে ছুটে এসেছেন খাসি মেজবান স্ট্রেমলেট ডেখার, বাখিয়া মন, ইভানিশা পাথাও। এই ট্রিপের অন্তত তিনদিন থাকবো স্ট্রিমলেটের বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে, তাঁর সরাসরি আতিথ্যে।

এর আগে সাতসকালে বিমানের ফ্লাইট বিজি জিরো সিক্স ফাইভ আমাদের ঠিকঠাক মতোই নামিয়ে দিয়েছে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর থেকে আমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে সিলেটের পাকা ড্রাইভার দীপক দেবনাথ সাতসকালে পৌঁছে দিয়েছে তামাবিল। নানা ঝক্কি করে দু’পারের ইমিগ্রেশন-কাস্টমস অতিক্রম করেই পেয়ে গেছি মেজবান গ্রুপ ডেখার গংকে। খয়েরি রঙের টাটা সুমো ও দক্ষ গারো গাড়ি চালক দামরেন সাংমাকে নিয়ে তারা সময়মতো হাজির। জীবনে প্রথম ভ্রমণযাত্রা শুরু বিমানে, সীমান্ত অতিক্রম হেঁটে, গন্তব্য গাড়িতে। শানে নুযুল হচ্ছে, ভ্রমণ রুট ঢাকা-সিলেট-তামাবিল-ডাউকি-শিলং। মোড অব ট্রান্সপোর্ট উড়োজাহাজ, মাইক্রোবাস, টাটা সুমো।

বিজ্ঞাপন

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jun/09/1560062721306.jpg

মেঘের বাড়ি মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের পথে আমাদের প্রথম যাওয়ার কথা এশিয়ার সবচে’ পরিচ্ছন্ন গ্রাম ‘মাওলিননংয়ে’। ডাউকিতনয়া উমগট পাড়ি দিয়ে পাহাড়ি পথে যেতে হবে মাউলিননং। যাওয়ার পথে দ্রষ্টব্যটি স্পর্শ করে গেলে ভ্রমণের হাফ পয়সা উসুল। কারণ বাংলাদেশ-ভারতে সোস্যাল মিডিয়াভিত্তিক যতোগুলো ভ্রমণ গ্রুপ আছে ডাউকিতে তাঁদের অন্যতম গন্তব্য এই গ্রাম। গুগলের ভ্রমণ রিভিউয়ে ক্লিক করলেই মাউলিননং আর মাউলিননং। সে মতে, শিলংয়ের পথে এখন ছুটে চলেছি গ্রামটি এক্সপ্লোরে। ভ্রমণসঙ্গীরা রাতের প্রথমপ্রহর থেকে যাত্রার ধকলে এখন অনেকটা ক্লান্ত। পাহাড়ি রাস্তার ঝাঁকুনিতে তাদের চোখ ঘুম ঢুলুঢুলু। গুরুবাক্য শিরোধার্য করে জোর করে হলেও নির্নিমেষ তাকিয়ে আছি। আমার ভ্রমণ ও ভ্রমণগদ্য আইডল সৈয়দ মুজতবা আলী বা হালের বুদ্ধদেব গুহ বলেছেন, ক্যামেরার লেন্সে দুনিয়া না দেখে চোখের ক্যামেরায় দেখতে। চোখের থ্রি পয়েন্ট ফাইভ লেন্সে সব জায়গার ছবি তুলে মস্তিষ্কের ডার্করুমে রেখে দাও। যখন খুশি সেই ছবি ডেভেলপ করে নাও। পাহাড়-মেঘ-ঝর্ণার সৌন্দর্য দু’চোখের ক্যামেরায় ধরে রাখতে আমি আর কবি কামরুল হাসান তাকিয়ে আছি। এটা, ওটা দেখে ওই ওই বলে চেঁচিয়ে উঠছি। হাতের মোবাইল ক্যামেরাও সচল হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

বিজ্ঞাপন

মাউলিননং ভিলেজ এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসাবে তকমা পেয়েছে। এ ধরণের তকমার মাপকাঠি বা তকমাদাতা নিয়ে খুব বেশি জানা না গেলেও গ্রামের এই পরিচিতিতে পর্যটকরা ছুটে আসছে, গ্রামের মানুষও সন্তুষ্টচিত্তে এক অভিনব গ্রাম্যসমাজের আওতায় গ্রাম পরিচালনা করছে, পরিচ্ছন্নতাই যার মূল কথা। নিজস্ব উদ্যোগেই এই গ্রামসমাজের সদস্যরা নিয়মিত গ্রাম পরিস্কার করে আবর্জনা নির্দ্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলে। এ গ্রামে কিছু ঘরবাড়ি, হোমস্টে, রিসোর্ট, কিছু দোকানপাট আছে। প্রতিমুহুর্তে পরিব্রাজক-পর্যটকের স্রোত গ্রাম পর্যটনে আসছে। পর্যটনশিল্প গ্রামবাসীর আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে। এর মাঝে গ্রামের জীবনযাত্রা হারিয়ে গিয়ে মাউলিননং হয়ে উঠেছে ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র। গ্রামের আঁকা বাঁকা প্রতিটি রাস্তার পাশে চমৎকার বাহারি ফুলগাছে। বাড়িতে বাড়িতে নানা পসার নিয়ে বসেছে স্থানীয়রা। মাউলিননং এখন গ্রাম কি গ্রাম না, এ নিয়ে ভাবার সময় পরিব্রাজকদের কারও নেই। তারা এই গ্রামটির নানা আঁকাবাঁকা পথে ছবি সেলফি তুলে, বাঁশ দিয়ে বানানো ভিউপয়েন্টে উঠে এবং নানারকম হস্তজাত সামগ্রীতে ব্যাগ পুরে পাহাড়ি দৌড়াচ্ছে আরেক গন্তব্যে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jun/09/1560062741768.jpg

ডাউকি থেকে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা মাউলিননংয়ে পৌঁছেছি। মেজবানগণ এখানে যাতায়াতে আগে থেকেই অভ্যস্থ। সৌন্দর্যের আঁধারের মধ্যেই তাঁদের বসবাস, তাই পরিচ্ছন্ন গ্রামে পৌঁছে তাঁদের প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না। ভ্রমণসঙ্গী গৃহবন্ধু জলি, সদ্য কিশোরউত্তীর্ণ তুসু গাড়ি থেকে নেমেই ওয়াও, ওয়াও করতে লাগলো। গ্রামের ভেতরের কোন রেস্টুরেন্টে বসে আমরা চা-কফির বিরতি নিতে চাইলাম। লাস্যময়ী কিশোরী জেস্টারওয়েলের পৈত্রিক রেস্টুরেন্ট বসলাম। রেস্টুরেন্টের নাম কিউ শাপরাঙ। স্থানীয় ভ্রমণসঙ্গী কাম গাইড স্ট্রিমলেট ডেখার জেস্টারওয়েলের কাছে জানেত চাইলেন, এখানে বাইরের খাবার এলাউড কি না। হ্যাঁ সূচক জবাব আসতেই আমাদের অবাক করে দিয়ে তারা তাদের ব্যাকপ্যাক থেকে একের পর এক খাবার বের করতে লাগলেন। দেখলাম,তারা পুরো সকালে নাস্তার জোগারজন্তু করে নিয়ে এসেছেন। স্ট্রিমলেট ওয়ানটাইম প্লেট একেক করে সবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে একের পর এক বের করলেন রুটি, আলু ভাজি, ডিম সেদ্ধ ও আচার। কিছুক্ষণের মধ্যে অমৃতসম একপেয়ালা করে চা এনে হাজির করলো কিশোরী জেস্টারওয়েল। আমরা খেয়ে রীতিমতো, পরিতৃপ্ত। কিশোরীর নামটি বিশেষভাবে উল্লেখ হচ্ছে এই কারণে যে, সে শুধু দর্শনধারীই নয়। গরীবঘরের মেয়ে হয়েও নিজেকে সুশ্রী রাখতে নিজের প্রয়োজনীয় যত্ন যে নেয় তা তার চেহারা দেখে বোঝা যায়। এই পাহাড়ের দেশে সে কোথায় বিউটিশিয়ান পায় তা ভেবে অবাক হতে হয়।

আমরা নাস্তা করে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চাইলাম। চারদিকে পর্যটকরা হৈ হৈ করছে। গ্রামের পার্কিংয়ে লটে অনেকগুলো দোকানে বসেছে গারো খাসিদের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের মেলা। সেই সম্ভার থেকে আগ্রহীরা কিনছে পছন্দের জিনিসপত্র। আমাদের কয়েকজন সেদিকে মনোযোগী। কবি কামরুল হাসান আর আমি মনযোগ দিলাম গ্রামের অন্দর-বাহিরের তত্ত্বানুসন্ধানে। ভ্রমণবিদরাই বলেছেন, ভ্রমণে সব ভ্রামণিকের আগ্রহ এক নয়। আমরা যখন নোটবুকে তথ্য লিখতে ব্যস্ত, আমাদের অন্যসঙ্গীরা তখন ব্যস্ত কেনাকাটায়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jun/09/1560062759057.jpg

মাওলিননং থেকে শিলং যাওয়ার আগে আরও বেশ কয়েকটি পর্যটনস্পট দেখে যাওয়া যায়। অনেকে ট্যাক্সি নিয়ে এগুলো দেখে সন্ধ্যা বা রাতের দিকে শিলংয়ে গিয়ে হোটেলে ওঠে। অনেক ডাউকি হয়ে চেরাপুঞ্জির হোটেল-রিসোর্টকে কেন্দ্র বানিয়ে পরে শিলংয়ে যায়। সরাসরি শিলং পৌঁছালে চেরাপুঞ্জি, ডাউকির স্পটে আসতে উল্টো আসার প্রয়োজন পড়ে। আমরা চেরাপুঞ্জি থাকছি না, আবার ভোররাতে পথে বের হওয়ার ধকলে আগেভাগেই শিলং পৌঁছানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। সে পরিকল্পনা কেড়ে নিল মাউলিননংয়ের অদূরেই লিভিং রুট সেতুর নিচ দিয়ে প্রবাহিত নজরকাড়া জলঝর্ণা। হাজার ফুট ওপর থেকে যে ঝর্ণার অবিরাম কলধ্বণি, কাছেই টানে, দূরে যেতে দেয় না।