মেঘপাহাড়ের ডাক-৪

মেঘের সঙ্গে মিতালি

  • মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

যাত্রা হলো শুরু মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের দিকে। ডাউকি-শিলং সড়ক ক্রমশ পাহাড় বেয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি বিপজ্জনক সব বাঁক। তবে রাস্তা হালে বেশ চওড়া করা হয়েছে, রাস্তার অবস্থাও ভালো। ডানে বা বাঁয়ে কখনো পাহাড় আসছে কখনো গভীর গিরিখাদ। আমরা গাড়ির মধ্যে রক্ত হিম করে বাইরে তাকিয়ে আছি। একটু অসাবধানতায় ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া মুহূর্তের ব্যাপার।

চালক দেরমান সাংমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে স্বাভাবিকভাবেই কাজটি করে চলেছে। পাহাড়ি পথে নিত্য গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্থ এখানকার বাঙালি, গারো, খাসি, জৈন্তা গাড়িচালকরা। পাহাড়ি রাস্তায় দ্রুত ছুটে চলা চলার সম্ভাব্য বিপদ আমলে না নিয়ে এ মুহূর্তে মেঘের দিকে মনোনিবেশ করে সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। জীবনের প্রতি পদে পদেই তো কতো রিস্ক।

বিজ্ঞাপন

Meghalay

কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা আরও উঁচু উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে থাকি। কখনো পাহাড়ের ভাঁজে, উপত্যকায়, পাহাড়ের শীর্ষ দিয়ে রাস্তাটি চলে গেছে শিলং পর্যন্ত। আমরা উঠছি তো, উঠছিই। সমুদ্র সমতল থেকে ছয় হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় অবস্থিত শিলং।

বিজ্ঞাপন

রাস্তায় কখনো কখনো হুশহাশ করে গাড়ি অতিক্রম করে যাচ্ছে। কখনো ঘনজঙ্গল, কখনো হাতে গোনা বসতি। কদাচিৎ দুয়েকজন খাসি উপজাতিকে জঙ্গল জীবনযাত্রায় দেখা যায়। দূরে কাছে সবুজ পাহাড়ের কোলে তুলোর পেঁজার মতো সাদা সাদা মেঘ ভেসে রয়েছে। মেঘকে আমরা নিচে থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে এরকম দেখি, বিমান থেকে আরেক রকম দেখা যায়, ছোঁয়া যায় না। কিন্তু মেঘালয় মেঘের আলয়, মেঘের বাড়ি, সেখানে এর সঙ্গে মিতালি করা যায়। মেঘের ওপর থেকে মেঘ দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌণিকে। কখনো ছুটে চলা যায় মেঘের সমান্তরালে।

Meghalay

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢুকে পড়ি এক অপার্থিব অপার সৌন্দর্যের পরাবাস্তব জগতে। যেখানে শুধু মেঘেরই ভেলা, মেঘ হাতছানি দেয় না, রীতিমতো সমস্ত বাহু বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে আসে। গাড়ির জানালা দিয়ে অদূরের পাহাড়ি উপত্যকা বা পাহাড়ের কোলে যে মেঘদলকে ভেসে থাকতে দেখেছি- তা এখন আমাদের ছুঁতে কাছে ছুটে এসেছে। কিংবা বলা যায়, আমরা ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়েছি মেঘদলের ভেতর। আবছা আঁধারের মমতা বেষ্টন করে রেখেছে আমাদের। আমি বাস্তবের মধ্যে পরাবাস্তবতা অনুভব করছি। সে অবস্থাটি চাক্ষুষ দেখে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেই কেবল বোঝা যায়, বর্ণনাবহুল রচনা দিয়ে অন্যকে বোঝানো অসম্ভব।

পরাবাস্তবতার মধ্যেই বাস্তবতাটি হলো আমাদের ছুটে চলা। গাড়ির সামনে ভিজিবিলিটি কমে গেছে। তবু দক্ষ চালক সমান গতিতেই মেঘের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমাদের ভ্রমণদলে আমরা যারা এ পথে নতুন, তাদের অনেকে জানালা দিয়ে হাত বের করে মেঘ ছুঁয়ে মুখে ঠেকাচ্ছে, কেউ বাইরে হাত দিয়ে মেঘের স্পর্শ নেওয়ার চেষ্টা করছে। কারও মোবাইল ক্যামেরায় চলছে ছবি তোলা।

Meghalay

কী আশ্চর্য, মেঘের মায়া কাটিয়ে আমরা যখন বেরিয়ে আসছি মাঝে মাঝে, তখন দেখা দিচ্ছে উঁচু পাহাড়ের সৌন্দর্য। কোথাও ঘন জঙ্গলের বেষ্টনী, কোথায় টিলা-মালভূমি। মুহুর্তেই অদূরে পাহাড়ি উপত্যকায় দেখা মিলছে রৌদ্দকরোজ্জ্বল দিনের। আরেক দিকে কালোমেঘ, বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি তো, এই রোদ, এই পরিস্কার তো এই আধারে ছাওয়া। কখনো সামান্য উষ্ণতা তো পরক্ষণেই শীতলতা। আবহাওয়া ও মেঘ রোদ্রের এই্ খেলা মনোরম, প্রাণ জুড়ানো। ‘মেঘ রোদ্র গরম ঠাণ্ডার প্রসঙ্গ উঠতেই বাখিয়ামন বললো, ডাউকি থেকে শিলং আসতে চারটি ঋতু- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীতের সৌন্দর্য-বৈচিত্র্য অনুভব করা যায়।

একই দিনে চার ঋতুর অনুভব অপূর্ব বটে।

Meghalay

এই অপার সৃষ্টি বৈভবের মধ্যে কদাচিৎ বিচ্যুতিও ঘটেছে সৌন্দর্যের। পাথুরে পাহাড় কেটে পাথর সংগ্রহ করা হয়েছে কোথাও। রাস্তার পাশেই এর দেখা মেলে। সবুজের মধ্যে কাটা পাহাড় সাদা শরীরে লাজুক ভঙ্গিতে বিসদৃশ হয়ে দণ্ডায়মান। আমরা মনে পড়লো পবিত্র কোরআনের অমর বানী- ‘জাহারাল ফাসাদে ফিল বার্রি ওয়াল বাহরি বিমা কাসাবা আইদিন নাস’- জলে স্থলে যে অনাসৃষ্টি তা মানুষের হাতেই সৃষ্টি। আমাদের ভ্রমণ গাইড কাম হোস্ট স্ট্রিমলেট জানালেন, পাথর সংগ্রহ করে বাংলাদেশে রফতানি করা হয়। আয়ের এক অপার উৎস এই প্রকৃতি।

এদিকে গাড়ির ভেতর চলছে বাংলা, ইংরেজি, খাসি ভাষায় নানা আলাপচারিতা। সাইডটকে বাংলা বা খাসি ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। স্ট্রিমলেট, বাখিয়ামন, ইভানিশা ও গাড়ি চালক খাসিতে আলাপ করছে। চালক দেরমান সাংমার ভাষা গারো হলেও খাসি ভাষা জানে পুরো দস্তুর। আমি, জলি, কবি কামরুল, তুসু বলছি বাংলায়। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলা কথা হচ্ছে ইংরেজিতে। চলন্ত গাড়িটি যেন হয়ে উঠেছে বহু ভাষাভাষীর এক পাঠশালা। কারণ আমরা ইতোমধ্যে আমাদের মেজবানদের কাছ থেকে শিখতে শুরু করেছি খাসি ভাষার নানা শব্দ। যেমন-‘খুবলেই’ হচ্ছে খাসি ভাষার স্বাগত জানানো বা ধন্যবাদ জ্ঞাপনের শব্দ। বাম অর্থ খাওয়া। নাম জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে, কেরতেয়াং ইউ য়া, ইত্যাদি।

Meghalay

অবলোকন, আলাপ আলোচনার মধ্যই ইতোমধ্যে কেটে গেছে ঘণ্টা তিনেক। পাহাড় মেঘ পেরিয়ে এসেছি পড়েছি খাসি, বাঙালি, গারোদের কোলাহল মুখর এক ছোট্ট শৈল শহরে। মেঘের রাজ্য মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে। করতে চাই দিনকয়েকের শৈলবাস।

আরও পড়ুন: শৈলতলে ঝরনার কলধ্বনি-লিভিং রুট ব্রিজ