কলকাতা আছে কলকাতাতেই

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, কলকাতা থেকে ফিরে
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

১৭৫৬ সালে গঙ্গার খাঁড়ি বা ‘ক্রিক’। কাছেই জোব চার্নকের সমাধি

১৭৫৬ সালে গঙ্গার খাঁড়ি বা ‘ক্রিক’। কাছেই জোব চার্নকের সমাধি

নগরের ভেতরে লুকিয়ে থাকে নগর। একদার রমণীয় মুঘল নগরী ঢাকা লুকিয়ে আছে বিকাশমান আধুনিক ঢাকার মধ্যেই। ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ বললে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত, সবই চলে আসে।

ঔপনিবেশিক কলকাতার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কবি বলেছেন, ‘কলকাতা আছে কলকাতাতেই’। কলকাতারও অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে তবু সব রয়েছে কলকাতাতেই।

বিজ্ঞাপন

পথে ও মহল্লায় হাঁটতে হাঁটতে মেলাতে চেষ্টা করেছি ইতিহাসের ধূসর পাতায় হারিয়ে যাওয়া কলকাতাকে। চাঁদপাল ঘাট থেকে হেস্টিংস স্ট্রিট, ওয়াটারলু স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, প্রিন্সেপ স্ট্রিট হয়ে ধর্মতলার উত্তর ছুঁয়ে ক্রিক রো বেয়ে সল্টলেক অভিমুখী ছিল একটি খাল। যা পরে বিদ্যাধরীতে মিশে যায়। বিদ্যাধরীও এখন মজে গিয়েছে। একমাত্র বেলেঘাটা খাল সেই স্রোতের অংশ হয়ে আছে।

যদিও কলকাতার নামকরণ নিয়ে আছে অনেক মত। তবুও কলকাতার রাজপথের খুঁটিনাটির ইতিহাসকার পরমেশ্বরন থনকপ্পন নায়ারের মতে, এই ‘খাল কাটা’ থেকেই কলকাতা নামকরণ। ১৭৩৭ সালের এক ভয়াল ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড় সেই খালের বড় অংশ বুজিয়ে দেয়।

বিজ্ঞাপন

১৭৩৮-এর জুনে বিলেতের ‘লন্ডন’ ম্যাগাজিনে ঝড়, ভূমিকম্প, বন্যায় ধ্বস্ত কলকাতার সঙ্গে জেরুসালেমে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ভূমি গলগথার তুলনা করা হয়েছিল। সে কালের কলকাতার জনসংখ্যার নিরিখে লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হয়। বর্তমান মহাকরণের রোটান্ডার জায়গায় শহরে ব্রিটিশদের আদি গির্জা সেইন্ট অ্যানের চার্চ চুরমার হয়ে যায়।

ইংরেজ আমলে কলকাতার নাগরিক সমাজে চলছিল দোর্দণ্ডপ্রতাপ গোবিন্দরাম মিত্রের আমল। কুমারটুলিতে সেই গোবিন্দরামের মন্দির বা ব্ল্যাক প্যাগোডার মূল পঞ্চরত্ন চূড়া সেই ঝড়ে ভেঙে পড়ে। তার ভগ্নাংশটুকু আজও টিকে আছে। অক্টারলোনি মনুমেন্টের থেকেও নাকি উঁচু ছিল তা!

◤ শিল্পীর তুলিতে গোবিন্দরামের মন্দির বা ব্ল্যাক প্যাগোডা ◢


জলোচ্ছ্বাসে ব্রিটিশ-ওলন্দাজ-ফরাসিদের ভাসমান জাহাজগুলোর দফারফা হয়। জোব চার্নকের সমাধিসৌধ ও আজকের রাইটার্স বিল্ডিংস-এর মধ্যবর্তী পরিসরের খালটি পলিতে ঢাকা পড়ে যায়।

ইতিহাসকারগণের মতে, একদা গঙ্গা ছিল আজকের নব মহাকরণ অবধি বিস্তৃত। প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার পেরিয়ে তার খাঁড়িটি ধরে একটি বড় বার্জ ক্রিক রো এলাকার খালে আটকে পড়ে। ঠিক কিভাবে কোন স্রোত ধরে গঙ্গা থেকে এত ভিতরে বার্জটা এসে পড়ে, তার কারণ অজ্ঞাত।

বিশেষজ্ঞদের মত, ভূমিকম্পের দাপটে এই ওলটপালট অসম্ভব নয়। কলকাতা যে ভূমিকম্পপ্রবণ তা বলাই বাহুল্য। ২০১১-২০১৬ সালে কলকাতার ‘গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রেডার’ নামের পাঁচ বছরব্যাপী সমীক্ষায় আইআইটি খড়্গপুরের ভূতত্ত্ববিদ এবং ভূপদার্থবিদেরা শহরের ভূমিকম্প-প্রবণতার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, কলকাতার জমির নিচে ৪-৫ কিলোমিটার পুরু পলিস্তর। তার পরে অজস্র ‘প্যালিয়ো চ্যানেল’ বা সাবেক জলখাত। তার সঙ্গে শহরের সাড়ে তিন কিলোমিটার নিচেই দুই বাংলাকে জুড়ে ভূমিকম্পপ্রবণ কলকাতা-ময়মনসিংহ হিঞ্জ জোন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শহরে রিখটার স্কেলে ৬.১ থেকে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটবার আশঙ্কা প্রবল। এমন হলে ভূগর্ভস্থ ফাঁপা পকেটগুলো ফাটবে। কারণ, কলকাতার মাটি আসলে ‘চোরামাটির স্তর’, যা ভর ও ভার সহনীয় নয়।

◤ বাংলাদেশ অংশে কলকাতা-ময়মনসিংহ হিঞ্জ জোন ◢


যেজন্য বৌবাজারের সেকরাপাড়া বা দুর্গা পিতুরী লেনের বাড়িগুলোর নিচে দুর্ঘটনা ঘটেছে মেট্রোরেল নিয়ে কাজের সময়, জানালেন কলকাতার ট্যুর অপারেটর খোকন মন্ডল।

কলকাতার মাটির বুকের ভিতরে জলখাতের উপস্থিতির নিরিখে বিশেষজ্ঞগণ আরো মনে করেন, ডিঙাভাঙার পুরনো খালের মুখে ইডেন গার্ডেন্সের নিচেও এমন বিপজ্জনক ভূস্তর রয়েছে। বৌবাজারের মতোই বিপজ্জনক পরিস্থিতি পার্ক স্ট্রিট, পার্কসার্কাস, নিকো পার্ক, সল্টলেক, রাজারহাট, নিউটাউন, বেলগাছিয়াসুদ্ধ বহু তল্লাটেই। শ্যামবাজার, যাদবপুর, বেহালা, কালীঘাটসহ কলকাতার বহু এলাকাই নিরাপদ নয়, এমন অভিমত ভূতাত্ত্বিকদের।

প্রখ্যাত অতীত-সংগ্রাহক নির্মলচন্দ্র কুমারের পুত্র, কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশনস বিভাগের শিক্ষক অলোক কুমারের সংগ্রহে কলকাতার ভূগর্ভ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জমা ১৯০৫-এর রিপোর্টও কলকাতার ভূগর্ভে খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ে সাবধান করছে। ঊনিশ শতকে লন্ডনে মাটির তলায় রেললাইন পাতার পরে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞেরা কলকাতার অবস্থাও খতিয়ে দেখেন। শহরের নিচে বিপজ্জনক নরম পলি ও অন্তঃসলিলা খালের আঁকিবুকি নিয়ে তখনই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এসব তথ্য জানান যাদবপুরে এমফিল গবেষণারত সুহাসিনী হালদার।

পূজার আগে আগে কলকাতার দুর্গা পূজার আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ, এনআরসি ইত্যাদির পাশাপাশি হাওড়া থেকে শিয়ালদহ হয়ে সল্টলেক-নিউটাউনের মেট্রোরেলের কাজকারবার নিয়েও কথা হয় কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে। পূর্ব-পশ্চিমে মেট্রোরেল প্রসারিত হলে মহানগরের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত অগ্রগতি হবে।

তবে এ কাজে কলকাতার ভূগর্ভস্থ পরিস্থিতি নিয়ে আছে নানা উৎকণ্ঠা। বৌবাজারের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে সেকরাপাড়া লেন বা দুর্গা পিতুরী লেনকে বাঁয়ে রেখে হিদারাম ব্যানার্জি লেন ধরে মিনিট দশের হাঁটাপথ ক্রিক রো, যা বিস্মৃত খালের স্মারক। মাটি এখানে পোক্ত নয়।

আরো জানা গেল, আশি বছর আগে কলকাতা পুরসভা নাম পাল্টে রাজা সুবোধ মল্লিকের নাম বসাতে গেলে এলাকাবাসী রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। পুর কর্তৃপক্ষকে লেখা প্রতিবাদপত্রে ইতিহাসের নানা নথি পেশ করে তারা বলেন, শহরের একটি প্রাচীন নৌপথের ইতিহাস মুছে দেওয়া যাবে না।

শুধু ইতিহাস নয়, লোকবিশ্বাস মতে, লখিন্দরের শব নিয়ে বেহুলাও ওই খাল ধরে ভেসেছিলেন। আবার কলকাতার চালু মেট্রোরেলের লাইনের নিচে গড়িয়া-বৈষ্ণবঘাটা লাগোয়া আদিগঙ্গার খালকেও বেহুলার ভেসে চলার গাঙুর বলে মনে করেন অনেকেই।

কলকাতার বৌরানি খালটিও বিখ্যাত। ১৮৪০-এ প্রকাশিত ‘নটী এল নৌকা’য় গল্প জুড়েও রয়েছে বৌরানির খালে আখ্যান। কারো কারো অনুমান, এটাই ক্রিক রো বা ডিঙাভাঙা খাল। ১৭৩৭-এর বিপর্যয়ের পরেও টিকে ছিল তা। বোজানোর সিদ্ধান্ত হয় ভিক্টোরিয়ার আমলে। যখন শহরে সদ্য মাটির তলার নর্দমার লাইন তৈরি হচ্ছে, রেললাইন বসছে শিয়ালদহে।

বৌবাজারের জনপদও তখন থেকেই সুপরিচিত। পলাশির যুদ্ধের পরে কোম্পানির নতুন গড়ের ঠিকাদার, লবণ কারবারের দাপুটে দেওয়ান দুর্গা পিতুরীর ভাগ্নে বিশ্বনাথ মতিলালের এক বিধবা বৌমার নামেই বৌবাজারের নামমহিমা, এমনই লোকশ্রুতি এলাকার নামকরণ প্রসঙ্গে।

এমনই শত পাড়া, মহল্লা জমাট হয়ে আছে কল্লোলিনী কলকাতার বুকে। এক কলকাতার মধ্যে আছে অনেক কলকাতা। এমনকি, কলকাতার মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া কলকাতা; কলকাতার নদী, খাল, পুকুর, ডোবা ও আধুনিকায়নের তোড়ে লুপ্ত জনপদ।

মধ্য কলকাতা থেকে উত্তর ও দক্ষিণে ক্রমাগত প্রসারিত ও বিকশিত কলকাতা বুকে ও বুকের গভীরে ধারণ করে আছে পুঞ্জিভূত স্মৃতি, লুপ্ত জলাধার, বিপন্ন জনপদ। শহরের সবচেয়ে চওড়া যে রাস্তাটিকে সেন্ট্রাল এভিনিউ নামে ডাকা হয়, এক সময় কী ছিল এখানে, তা বলতে পারবে না অনেকেই।

মারাঠা বর্গিদের ঠেকাতে নবাব আলীবর্দি যে পরিখা খনন করেছিলেন, তা কোথায় গেল? মারহাট্টা ডিচ নামে কেউ কেউ স্মৃতি থেকে কিছু বিবরণ দিলেও সেই কাঠামো কত রূপান্তরের মাধ্যমে পথ, ঘাট, অট্টালিকায় ছেয়ে গেছে, তা বলতে পারা আজ প্রায়-অসম্ভব।

কলকাতার মধ্যে অভিজাত-সংস্কৃতিবান উপশহর গড়ে উঠেছে দক্ষিণের নদী তীরে, সে এলাকার নাম কেন হলো ‘মেটিয়াবুরুজ’? মেটিয়াবুরুজ শব্দের অর্থ কী? পাশের অভিজাত এলাকা গার্ডেনরিচের নাম এমন কেন এবং কেমন করে এমন হলো? এসব প্রশ্ন কলকাতায় পা দিলেই আঁকড়ে ধরে।

পায়ে পায়ে পথচলে কলকাতার প্রসিদ্ধ স্ট্রিটফুড চেখে যতই এগিয়ে যেতে থাকি, জিজ্ঞাসার পাহাড় সামনে এসে ভিড় করে। জানতে মন চায়, ফুচকা ও রোল, কলকাতার এই দুটি স্ন্যাক্স আইটেম এখন পাওয়া যায় ভারতের প্রায় সব বড় শহরেই। কে, কবে প্রথমবারের মতো কলকাতায় শুরু করেছিল এ খাবারের প্রচলন?

ভাতে-মাছের বাঙালির পাতে কে প্রথম এনেছিলেন বিরিয়ানি? গজল, ঠুমরী, কাওয়ালীর স্রোতে উজ্জ্বল করেছিলেন কলকাতার সাংস্কৃতিক ভূগোল?

কলকাতার হারিয়ে যাওয়া কিংবা কলকাতায় সংযোজিত বিষয়ের তালিকা যেমন দীর্ঘ, তার ইতিহাসও তেমনি বর্ণাঢ্য। বাবুঘাটের বেঞ্চিতে বসে নদীর বহমান স্রোতের দিকে তাকিয়ে পড়ন্ত বিকেলে মনে হলো, কলকাতা যেন জীবন্ত সত্তায় অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতে প্রবহমান এক বিচিত্র চরিত্র।