শাহেনশাহ-ই-কাওয়ালি

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অপূর্ব গায়কী ভঙ্গিতে নুসরাত ফতেহ আলি খান, ছবি: সংগৃহীত

অপূর্ব গায়কী ভঙ্গিতে নুসরাত ফতেহ আলি খান, ছবি: সংগৃহীত

জন্মনাম পারভেজ কেউ মনে রাখে নি। পিতা ও পূর্বপুরুষের নামের অংশ যুক্ত করে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত নুসরাত ফতেহ আলি খান হিসেবে। যার অন্য নাম শাহেনশাহ-ই-কাওয়ালি বা কাওয়ালি গানের রাজাধিরাজ।

ভারত বিভাজিত হয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরের বছর (১৯৪৮) ১৩ অক্টোবর তিনি জন্ম নেন খণ্ডিত পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদের লায়লপুর এলাকায়। মাত্র ৪৯ বছর বেঁচে তিনি যখন ১৯৯৭ সালের ১৬ আগস্টে লন্ডনে মারা যান, তখন তিনি সমগ্র বিশ্বে অসাধারণ কণ্ঠের ক্ষমতার জন্য সমাদৃত। তাকে কণ্ঠের জোর, দম, স্ট্যামিনা ও অসামান্য নৈপুণ্যের জন্য বিবেচনা করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠদের একজন সংগীতকার রূপে।

বিজ্ঞাপন
কাওয়ালি গানের শাহেনশাহ নুসরাত ফতেহ আলি খান

 

জীবৎকালেই নুসরাত ফতেহ আলি খান পরিণত হয়েছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। প্রায় ৬০০ বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী মরমী-সুফিবাদী সংগীত ঘরানা কাওয়ালিকে তিনি নিয়ে যান আন্তর্জাতিক উচ্চতায়। পারস্যে দ্বাদশ শতকে যে আধ্যাত্মিক সংগীত ধারা সৃষ্টি হয়ে তুরস্ক, আরব জাহান ও মুঘল ভারতে ছড়িয়ে গিয়েছিল, তাকে বৈশ্বিক শ্রোতার হৃদয়ের মর্মমূলে পৌঁছে দেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

ইসলামের মরমী সাধন মার্গ বা সুফিবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ আধ্যাত্মিক সঙ্গীতধারা কাওয়ালিকে আধুনিক বিশ্বে নন্দিত ও জনপ্রিয় করেন নুসরাত ফতেহ আলি খান। তার অসাধারণ কণ্ঠের ক্ষমতার জন্য তাকে কাওয়ালি গানের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের সর্বশ্রেষ্ঠদের একজন গণ্য করা হয়। রেকর্ড ও লাইভ কনসার্টে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে সুরের ইন্দ্রজাল তৈরি করে শ্রোতাদের বিমোহিত করতে পারতেন। সুর, তাল, লয়ে অপূর্ব পারঙ্গমতায় তিনি গানের বাণী ও বক্তব্যকে উচ্চতর অনুভূতির স্তরে নিয়ে যেতেন। একবাক্যে তিনি সকলের কাছে ওস্তাদ নামে সম্মানিত হন।

শুধু উপমহাদেশ বা মুসলিম শ্রোতাদের মধ্যেই নয়, নুসরাত ফতেহ আলি খান প্রেম ও বেদনার গান কাওয়ালিকে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চলের সীমানা ডিঙিয়ে বিশ্বসঙ্গীতে পরিণত করেন। মধ্যযুগের সাধক-কবি-ধর্মাত্মাদের দ্বারা রচিত কাওয়ালিকে আধুনিক যন্ত্র-অনুষঙ্গ আর গায়কীর বৈশিষ্ট্যে নবরূপে উপস্থাপন করেন তিনি। ফিউশনের শৈল্পিক সংযোজনে বিভিন্ন খানকা, মাজার, দরগা, দরবার ও ধর্মস্থানের কাওয়ালিকে তিনি বিশ্বসভায় মর্যাদার সঙ্গে হাজির করেন। একবিংশ শতকের তাপিত হৃদয় ও জর্জরিত মানবাত্মা তার গানের স্পর্শে সঞ্জীবিত হয়েছে জীবন ও মানবতার সুরের সাগরে।

ফলে পাকিস্তানের শিল্পী হলেও তিনি ছিলেন বিশ্বনাগরিক ও মানবতার কণ্ঠস্বর। ইউরোপ ও আমেরিকায় বিপুল শ্রোতা ছিল তার অনুরক্ত ভক্ত। আর উপমহাদেশের নিরিখে তার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি ছিল ভারতে। যে কয়জন মানুষ ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবেশেও সার্বজনীন শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সমাদর ও সম্মান পেয়েছিলেন, নুসরাত ফতেহ আলি খান তাদের নেতৃস্থানীয়। ভারতীয় সংগীত ও চলচ্চিত্র জগতকেও তিনি সমৃদ্ধ করেছেন তার কণ্ঠ ও সংগীত পরিচালনার বাহাদুরিতে। বিভক্ত পাঞ্জাবের অখণ্ড সংগীত আইকন হয়ে তিনি রূপান্তরিত হন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের দক্ষিণ এশীয় সংগীত ব্যক্তিত্বে।

নুসরাত ফতেহ আলি খান মরমী গানের মায়াবী রোমাঞ্চকর ধারার মতোই সংগীতে আসেন ভাগ্যের অলৌকিক ইঙ্গিতে। তার অনুনাসিক কণ্ঠস্বর গানের উপযুক্ত নয় মনে করে তার পিতা ও প্রাচীন-ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবার তাকে গানের জগতে আসতে নিরুৎসাহিত করেন। সবাই মনে করেছিলেন, কাওয়ালির জগতে জনপ্রিয়তা ও সাফল্য তিনি পাবেন না। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় তিনি বিশ্বব্যাপী সাফল্যের পাশাপাশি কাওয়ালি গানের আন্তর্জাতিক বিস্তার সাধন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি পরিণত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কাওয়ালি গানের অন্যতম একজনে।

এক পাঞ্জাবী পরিবারে জন্মগ্রহণকারী নুসরাত ছিলেন সংগীত-বিশেষজ্ঞ পিতা ফতেহ আলি খানের পঞ্চম সন্তান এবং ছেলে সন্তানদের মধ্যে প্রথম পুত্র সন্তান। তিনি খান পরিবারে চার বড় বোনসহ এক ছোট ভাই ফররুখ ফতেহ আলীকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ফয়সালাবাদে বেড়ে ওঠেন। প্রথমদিকে, তার পিতা চাননি যে নুসরাত পারিবারিক পেশায় আসুক। তিনি চেয়েছিলেন নুসরাত অনেক সম্মানিত একটি পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করুক এবং একজন ডাক্তার হোক। কারণ তিনি মনে করতেন, কাওয়ালি শিল্পীরা নিম্ন সামাজিক মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু নুসরাত কাওয়ালির প্রতি এমন এক প্রবণতা ও আগ্রহ দেখালেন যে তার পিতা অবশেষে নিজের ইচ্ছা ত্যাগ করেন। নুসরাতও তার আগ্রহে সংগীত পেশায় এসে তাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেন।

নিজের অদম্য আগ্রহে ও পারিবারিক ঐতিহ্যে তিনি ১০ বছর বয়সেই পিতা ও চাচাদের সঙ্গে কাওয়ালির আসরের সদস্য রূপে মঞ্চে আসেন। পিতার মৃত্যুর পর দুই চাচা ওস্তাদ মোবারক আলি খান ও ওস্তাদ সালামত আলি খানের সঙ্গে থেকে কাওয়ালি জলসায় অংশ নিতে থাকেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তিনি তাদের পারিবারিক কাওয়ালি গ্রুপের নেতৃত্বে আসেন এবং দুই বছর নিজের ভাইদের নিয়ে নতুনভাবে সংঘবদ্ধ হন। তারপর ১৯৬৬ সালে নবরূপে তিনি যখন সদলবলে মঞ্চে আবির্ভূত হন, তখন পুরো পৃথিবী অবাক হয়ে দেখে এক শাহেনশাহের আগমন। পাশ্চাত্যর অর্কেস্ট্রারের মতো তিনি প্রাচ্যের ঐন্দ্রজালিক সংগীত ভুবন তৈরি করেন তার দল নিয়ে।

আধুনিক জগতের গসপেল মিউজিকের মতো কাওয়ালিকে একটি সমন্বিত সংগীত অবয়বে নিয়ে এসে নুসরাত ফতেহ আলি খান পুরো দলের নেতৃত্ব দেন। নিজের অসামান্য দক্ষতা ও শক্তিমত্তায় তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুরের খেলায় অবরোহণ ও আরোহণ করতে থাকেন। ধ্যানমগ্ন শ্রোতা কাওয়ালি গানের আত্মিক গভীরতার স্পর্শে জাগতিক অবস্থানে থেকেও স্নাত হন মরমীবাদের পরম সম্মোহনে।

সমকালের সকল বিশ্বসেরা সংগীত প্রতিভা তার বন্ধুজনে পরিণত হন। অনেকে তার সংগে সংগীত অনুষঙ্গ দেন। উপমহাদেশ তো বটেই সমগ্র পশ্চিমাজগত উন্মুখ হয়ে থাকে তার কনসার্টের জন্য। বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি তাকে নিয়ে বায়োপিক বানায়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা তার জীবনী লিপিবদ্ধ করে। জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিসরে নুসরত ফতেহ আলি খান সংগীতের সাফল্য ও জনপ্রিয়তার শীর্ষতম বিন্দু স্পর্শ করে যখন মারা যান, তখন শুধু কাওয়ালি নয়, সংগীত জগতে হিমালয়ের মতো বিশাল উপস্থিতিতে তিনি অবস্থান করছিলেন। যথার্থ শাহেনশাহ বা রাজাধিরাজের মতোই তিনি ছিলেন ঐতিহ্যবাহী কাওয়ালি গানের সুর সাগরে।