রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্র ও কিবোর্ড বাংলাকরণে একজন মুনীর চৌধুরী
‘কবর’ নাটকের কথা মনে আছে? ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’-এর কথা? সাবলীল রচনার মধ্য দিয়ে সময়কে কিভাবে গেঁথে রাখতে হয়—এরচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে? ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে সেই নাট্যকার ছিলেন পূর্ব বাংলায় সবচেয়ে আলোচিত নাম। পর্বতপ্রমাণ অটল ব্যক্তিত্ব, দেশি-বিদেশি সাহিত্যে পাণ্ডিত্য এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার সচেতনতা তাকে দিয়েছে অনন্য উচ্চতা। মৃত্যুও যাকে পরাজিত করতে পারেনি; তিনি মুনীর চৌধুরী।
১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর মানিকগঞ্জ শহরে জন্ম নেন মুনীর চৌধুরী। চিন্তার ভিত্তি রচিত হয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পিতা আব্দুল হালিম চৌধুরীর মাধ্যমে। ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। আলীগড় থেকে আইএসসি শেষ করে আবার ফিরে আসেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে অনার্স এবং ১৯৪৭ সালে মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এবং ১৯৫৮ সালে হার্ভার্ড থেকে ভাষাতত্ত্বে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। খুলনা বিএল কলেজে শিক্ষকতার মধ্যদিয়ে কর্মজীবনের শুরু ১৯৪৭ সালে। সেখানে তিন বছর কাটিয়ে জগন্নাথ কলেজে যোগ দেন। অবশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তাকে নেওয়া হয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এখানেই ছিলেন।
বিদেশি সাহিত্যের সাথে তার যোগাযোগ ছিল ছোটবেলা থেকেই। পিতা আবদুল হালিম চৌধুরীর আরবি এবং ইংরেজিতে অসাধারণ দক্ষতা ছিল। অন্যদিকে বড় ভাই কবীর চৌধুরীও তাকে পরিচয় করিয়ে দেন আধুনিক চিন্তার সাথে। আস্তে আস্তে বামপন্থী রাজনীতি এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন মুনীর। কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ
১৯৫২ সাল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জ্বলে উঠল ঢাকার রাজপথ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র-জনতার মিছিলে দলকানা পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা করা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেখানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় তাকে। জেলে ছিলেন ১৯৫৪ সাল অব্দি। জেলে বসে পরীক্ষা দিয়েও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান নিয়ে এমএ সমাপ্ত করেন। জেলে থাকা অবস্থাতেই রচনা করেন বিখ্যাত নাটক ‘কবর’। কিছু ছোটগল্প লিখে গেলেও প্রধান বিচরণ ছিল নাট্যজগতে। সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে যেন একেকটা প্রতিবাদের ইশতেহার তার নাটকগুলো। যেন সাম্প্রদায়িকতা, নিম্নবিত্তের চিৎকার এবং প্রত্যাশিত বিপ্লবের সাইরেন। ‘কবর’-এর বাইরেও আছে ‘দণ্ডকারণ্য’, ‘পলাশী ব্যারাক’ ও অন্যান্য।
‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা গ্রন্থটিতে সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে এসেছে নরনারীর প্রেম। অন্য নাটক ‘চিঠি’তে দেখানো হয়ে আন্দোলনের নামে এক শ্রেণীর লোকের স্বার্থের আখ্যান। অনুবাদেও তার মুন্সিয়ানা প্রমাণিত। উদাহরণ হিসাবে সামনে আনা যায় ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’, ‘রূপার কৌটা’, ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ প্রভৃতি। তারপরেও নাটকে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি নিজের চিন্তাধারাকে। ‘মীর মানস’, ‘তুলনামূলক সমালোচনা’ এবং ‘বাংলা গদ্যরীতি’ তাকে ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সাহিত্যের অন্যতম অগ্রনায়কে পরিণত করে।
মুনীর অপটিমা কিবোর্ড
মুনীর চৌধুরীর অনন্য অবদান বাংলা বর্ণলিপির সংস্কার এবং আধুনিক টাইপ রাইটার। টাইপ রাইটারের জন্য ১৯৬৫ সালে তার উদ্ভাবিত কিবোর্ড মুনীর অপটিমা নামে খ্যাত। একান্তই মৌলিক আবিষ্কার তার। ইচ্ছে করলেই নিজেকে আগলে রেখে নিশ্চিত করতে পারতেন ভবিষ্যত। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসার জন্য আপোষ করেননি কোনো কিছুর সাথেই। পাকিস্তানি বৈষম্যমূলক ব্যবহার তাই চোখে ধরা পড়েছিল স্পষ্টভাবেই। নিপীড়নমূলক প্রতিটি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন নির্ভয়ে এবং অকুণ্ঠচিত্তে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়লে পাক সরকারের দেওয়া ‘সেতারা-ই-ইমতিয়াজ’ বর্জন করেন নির্দ্বিধায়।
অন্ধকার সেই দিন
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী টের পেয়েছিল বাঙালি জাতির সাথে আর পেরে ওঠা যাবে না। তাই পরাজয়ের ঠিক দুইদিন আগে সাজালো ভয়ানক এক পরিকল্পনা। দেশের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত এবং বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে এনে হত্যা করা হলো জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করে দেবার জন্য। সেই সব ত্যাগী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী একজন। তার মৃত্যুর অনেক দিন পরেও অনেকেই প্রশ্ন করেছে, “মুনীর চৌধুরীকে ওরা হত্যা করেছে কেন?” সেই প্রশ্নের সবচেয়ে যথার্থ উত্তরটা দিয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বলেন, “কারণ আপনাদের চেয়ে ওরা তাঁকে ভালো চিনেছিল বলে।”