আওকিগাহারা—জন্ম যেখানে মৃত্যুর চেয়ে বেদনাদায়ক
পৃথিবীতে অনেক অদ্ভুতুড়ে-রহস্যজনক জায়গা রয়েছে যা আমাদের প্রভাবিত করে মনে আর ইন্দ্রিয়ে। ‘দ্য ল্যান্ড অব রাইজিং সান’ বা জাপানের আওকিগাহারা তাদের অন্যতম। ফুজি পর্বতমালার শরীর ঘেঁষে চলে গেছে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বন। এই বনের আরেক নাম ‘সি অফ ট্রিজ’ বা গাছের সমুদ্র। তবে এই দুই নামের চেয়ে জনপ্রিয় নামটি হলো ‘সুইসাইড ফরেস্ট’ বা ‘আত্মহত্যার বন’। ঠিক শুনেছেন, মানুষ এখানে নিভিয়ে দিতে আসে জীবনের শেষ আলোটুকু, জীবনের শেষ কৌতুকটুকু। শুধু জাপানেরই না, সারাবিশ্ব থেকে মানুষ আসে এখানে পতঙ্গ হয়ে আগুনে ঝাপিয়ে পড়তে।
একটা পরিসংখ্যান দিই—
১. আওকিগাহারা জাপানিদের সবচেয়ে জনপ্রিয় আত্মহত্যার জায়গা এবং সারাবিশ্বে দ্বিতীয়। আমেরিকার সান ফ্রান্সিস্কোর গোল্ডেন ব্রিজের পর এর অবস্থান।
২. গড়ে প্রতিবছর ১০০ জন মানুষ এখানে আত্মহত্যা করেন।
৩. ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫০০’র অধিক জাপানি এখানে আত্মহত্যা করেছে এবং আত্মহত্যার হার বেড়ে চলছে প্রতি বছর।
৪. ২০০৩ সালে এক বছরে ১০০’র বেশি মানুষ আত্মহত্যা করলে এরপর থেকেই মূলত জাপান সরকার আত্মহত্যার সংখ্যা প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়।
৫. ১৯৭০ সালে পুলিশ, সাংবাদিক এবং স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে একটা দল গঠন করা হয়। যাদের কাজ ছিল মৃতদেহগুলি সংগ্রহ করা এবং মানুষকে আত্মহত্যায় নিরুৎসাহিত করা।
আগ্নেয়শিলা, অদ্ভুত কিছু পাথর আর অসংখ্য গাছের মিলিত ছোঁয়ায় তৈরি নিস্তব্ধতার এই বনে প্রবেশের শুরুতেই আপনার চোখে পড়বে সুইসাইড প্রিভেনশন এসোসিয়েশনের একটা সতর্কতামূলক বাণী—পিতা-মাতার কাছ থেকে পাওয়া মহামূল্যবান উপহার তোমার এই জীবন। নিজের ভাইবোন ও পরিবারের অন্য সকলের কথা একবার ভাবো। তাদের সঙ্গে তোমার সমস্যাগুলো নিয়ে একটিবার আলোচনা করো। আত্মহত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না।
এই বনে প্রবেশ করলেই আপনার মনে হবে এইমাত্র নিস্তব্ধতা ভেঙে আপনি অন্যায় করেছেন। যেন গাছের পাতারা একে অন্যের গায়ে স্পর্শ করার নামে কিছু একটা হুঁশিয়ারি বার্তা দিচ্ছে। কিংবা এই যে বিস্তীর্ণ সবুজ, যার শেষেরও শেষ নেই তার সমস্ত না দেখে ফিরবার উপায় নেই। যেন এই পথে কোন ইউ-টার্ন নেই। স্থানীয়রা এই বনের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন। কোন গাইডও এই বনে আসতে চায় না। বনের প্রথম এক কিলোমিটার রাস্তায় যারা যায় তারা গাছের গায়ে কাপড় কিংবা চকের দাগ দিয়ে এগোয় যাতে ফেরার রাস্তাটা চেনা থাকে। পথে যেতে যেতে আপনি দেখবেন একটা গাছের গায়ে আধভাঙা জিন্স প্যান্ট দাঁড়িয়ে আছে, পচে যাওয়া পায়ে স্যু, হাড়-কঙ্কাল। এক কিলোমিটার পরে আর সহজে কেউ যেতে রাজি হয় না, এরপরের পথটা আরো বেশি আদিম আর রোহমর্ষক।
১৯৬০ সালের দিকে জাপানি লেখক সেইচো মাতসুমোতোর ‘কুরোই জুকাই’ নামে একটি উপন্যাস বের হয়। সেই উপন্যাসের নায়ক নায়িকার করুণ সমাপ্তি ঘটে এই আওকিগাহারা বনে এসে একসাথে আত্মহননের মাধ্যমে। ওই সময়ে বইটি জাপানি সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এরপর এই বনে প্রেমে ব্যর্থ যুবক-যুবতীদের আত্মহত্যার মাত্রা বেড়ে যায়।
১৯৯৩ সালে আরেক জাপানি লেখক ওয়াতারু তসুরুমুই লিখেন ‘দ্য কমপ্লিট সুইসাইড ম্যানুয়াল’, বইটি বিতর্কিত এবং একই সাথে বেস্টসেলার হয়। বোঝাই যাচ্ছে বইটিতে ছিল সুইসাইডের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে কথা, এই বইয়ে আওকিগাহারাকে উল্লেখ করা হয় আত্মহত্যার সেরা স্থান হিসেবে। এমন নিস্তব্ধ সুন্দর জায়গা আর নেই। এই বনে আত্মহত্যা মানে পুনর্জীবন, ধীরে ধীরে সবুজে মিশে যাওয়া। বলাই বাহুল্য এরপর আত্মহত্যার সংখ্যা আরো বাড়ে। কথিত আছে অনেক মৃতদেহের পাশেই তসুরুমুইয়ের বইটি পাওয়া যায়।
তবে স্থানীয়রা বিশ্বাস করে আরেকটি কাহিনীতে। অনেক আগে জাপানে যখন দুর্ভিক্ষ নামে তখন ক্ষুধাতৃষ্ণায় ধুঁকতে ধুঁকতে পরিবারের সব সদস্যরা মিলে একটি করুণ সিদ্ধান্ত নেয়, বয়স্কদের আওকিগাহারা বনে রেখে আসা হবে। স্বভাবতই তারা না খেতে পেয়ে, পথ হারিয়ে কিংবা ফিরতে চাইলেও গোলকধাঁধায় জড়িয়ে মারা যায়। অনেকে বলেন তাদের সেই অতৃপ্ত আত্মারাই মানুষকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করে। এই ধারণা সত্যি হোক আর না হোক অন্তত অনেক বয়স্ক লোকেরা আওকিগাহারা এসে আত্মহত্যা করে এই ধারণায় যে, তাদের মৃত্যুর কারণে তাদের সন্তান-সন্ততিরা ভালো থাকবে।
এই বনকে নিয়ে মানুষের আগ্রহে তবু ভাটা পড়েনি বরং বেড়েছে বহুগুণ। এই বন নিয়ে নির্মিত হয়েছে দুইটি চলচ্চিত্র। একটি ‘দ্য সি অব ট্রিজ’ অন্যটি ‘দ্য ফরেস্ট’।
আত্মহত্যা কেন করে মানুষ? তারা কাপুরুষ নাকি সাহসী? তারা কি জীবন থেকে পালাতে চাইল নাকি মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখাল? আত্মহত্যা নিয়ে অনেক কন্ট্রোভার্সি আছে। আছে পক্ষে বিপক্ষে মত। আওকিগাহারা হয়তো সঠিক উত্তরটা জানে। মানুষ খেলতে খেলতে বড় হয়, আচমকা বুঝতে পারে ফাঁদে আটকে যাবার আগ অব্দি পৃথিবীর সমস্ত রাস্তাই সুন্দর। এই ধাক্কা সে নিতে পারে না, অনেকে পারেও হয়তো বারবার ধাক্কা সামলাতে পারে না। যেহেতু মানুষের কষ্ট আছে, অনুভব করবার ক্ষমতা আছে। হিউম্যান ডিল্যুশন। হয়তো এই ডিল্যুশনই সুন্দর, দুঃখ আছে বলেই সুখকে তেতো লাগে না। একটা সিস্টেম, সুনিয়ন্ত্রিত। এই সিস্টেম যে ভাঙতে পারে সে আপাত চোখে অপরাধী, আরো দূর তাকালে কি সাহসী?