করোনায় রক্ষা পেতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বনাম হাত ধোয়া
করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই অস্থির হয়ে খুঁজছেন স্যানিটাইজার। বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই, সে সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নানান ভাবে তৈরি করছে মানহীন হ্যান্ড স্যানিটাইজার । ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন এবং বিক্রি করছেন। এ জাতীয় পণ্য কতটুকু কার্যকর ? হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিভাবে আমরা বাসায় নিজের জন্য বানাতে পারি? হ্যান্ড স্যানিটাইজার বনাম সাবান দিয়ে হাত ধোয়া কোনটি বেশি কার্যকর? এসব বিষয়ে আলোচনা করবো।
করোনা বা COVID-19 এর মতো সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধ করার ক্ষেত্রে, পুরানো কালের হ্যান্ড ওয়াশিং এর চেয়ে ভাল কিছু হয় না। তবে যদি পানি এবং সাবান পাওয়া না যায় তাহলে আপনার পরবর্তী সেরা বিকল্পটি হতে পারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। আমেরিকার, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর তথ্য অনুযায়ী, এমন ধরনের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে যাতে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল থাকে। কারন এখানে অ্যালকোহলই জীবানু ধংসের মূল উপাদান।
বাজারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এর স্বল্পতা থাকার কারণে নিজেই বানিয়ে নিলাম নিজের হ্যান্ড স্যানিটাইজার। একজন জীববিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে সমস্ত কাঁচামালই আমার কাছে রয়েছে, তাই সেই কাঁচামাল গুলোকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করে নিলাম নিজের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার।
জানিয়ে দেই কিভাবে আপনারা নিজেদের বাসায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করতে পারবেন । তবে একটি বিষয় সবসময় খেয়াল রাখবেন ঘরে তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজার কখনোই শিশুদের হাতে ব্যবহার করবেন না। এতে শিশুর ত্বকের ক্ষতি হতে পারে
অল্প কিছু উপাদান দিয়ে আপনার বাসায় আপনার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করতে পারেন। যেমন আজ আমি তৈরি করলাম। যেসব উপাদান প্রয়োজন:
*আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল যাকে আমরা ইথানল বলে থাকি (99 শতাংশ অ্যালকোহল)
*অ্যালোভেরা জেল
*এসেনশিয়াল অয়েল ( সিট্রোনেলা ইউক্যালিপটাস, ল্যাভেন্ডার, লেমন গ্রাস অয়েল এগুলো পাওয়া না গেলে লেবুর রস ব্যবহার করতে পারেন)
*গ্লিসারিন
#ফোটানো জীবাণুমুক্ত পানি
এক কাপ বা ১০০ মিলিলিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির জন্য রেসিপি
*¾ কাপ 99% ইথানল
*¼ কাপ অ্যালোভেরা জেল, অ্যালোভেরা জেল পাওয়া না গেলে বাজারে যে অ্যালোভেরা পাওয়া যায় তা দিলেও হবে
*৫ ফোটা এসেনশিয়াল অয়েল (যে কোন একটি)
*চার ফোঁটা গ্লিসারিন
*এক টেবিল চামচ পানি
যদি আপনি অ্যালোভেরা বা অ্যালোভেরা জেল জোগাড় করতে না পারেন তাহলে এটি ছাড়াও চলবে। বাকি উপাদানগুলো দিয়ে বানিয়ে নিন।
পরিমান মত উপাদানগুলি ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। একটি খালি বোতলে ভরে রাখুন । যখন বাইরে থাকবেন তখন ব্যবহার করুন।
আপনি যদি ঘরে বসে হাতের স্যানিটাইজার তৈরি করেন তাহলে এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন:
*একটি পরিষ্কার জায়গায় স্যানিটাইজার তৈরি করুন।
*স্যানিটাইজার তৈরির আগে আপনার হাত ভাল করে ধুয়ে নিন।
*মিশ্রিত করতে, একটি পরিষ্কার চামচ ব্যবহার করুন । এই আইটেমগুলি ব্যবহার করার আগে ভালভাবে ধুয়ে নিন।
*নিশ্চিত হোন হ্যান্ড স্যানিটাইজারের জন্য ব্যবহৃত অ্যালকোহলটি নকল বা মিশ্রিত না হয়।
*যতক্ষণ না ভালোভাবে মিশ্রিত হয় ততক্ষণ সমস্ত উপাদান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেশান।
*মিশ্রণটি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত আপনার হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন না।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার কি নিরাপদ?
হ্যান্ড স্যানিটাইজার রেসিপিগুলি আজকাল পুরো ইন্টারনেটে রয়েছে - তবে সেগুলি কি নিরাপদ?
এই রেসিপিগুলি, উপরেরগুলি সহ, বাড়িতে তৈরি হাত স্যানিটাইজারগুলি তৈরি করার জন্য দক্ষতা এবং উপকরণ দুটোই প্রয়োজন। ঘরে তৈরি হাত স্যানিটাইজার কেবল তখনই সুপারিশ করা হয় যখন আপনি পানি বা সাবানের অভাবে আপনার হাত ধুতে পারছেন না।
কিভাবে হাত স্যানিটাইজার ব্যবহার করবেন?
*এটি দেয়ার পর আপনার হাত শুকানো না হওয়া পর্যন্ত ত্বকে এটি ঘষতে হবে।
*যদি আপনার হাতগুলি চিটচিটে বা নোংরা হয় তবে প্রথমে আপনার হাত সাবান এবং পানি দিয়ে ধুয়ে নেওয়া উচিত।
হাতের স্যানিটাইজার কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য করণীয়:
*স্যানিটাইজার এক হাতের তালুতে স্প্রে বা প্রয়োগ করুন।
*আপনার হাত একসাথে ভাল করে ঘষুন। নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনার হাতের সমস্ত পৃষ্ঠ এবং সমস্ত আঙ্গুলে এটি পৌঁছেছে।
*৩০ থেকে ৬০ সেকেন্ডের জন্য বা আপনার হাত শুকানো না হওয়া পর্যন্ত ঘষতে থাকুন। হাতের বেশিরভাগ জীবাণু মারতে এটি কমপক্ষে ৬০ সেকেন্ড সময় নিতে পারে।
স্যানিটাইজার কোন জীবাণু মারতে পারে ?
সিডিসির মতে, অ্যালকোহল-ভিত্তিক হাত স্যানিটাইজার (যাতে অ্যালকোহলের পরিমাণ সঠিক রয়েছে) আপনার হাতে দ্রুত জীবাণুর সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। এটি করোনোভাইরাস, সারস-কোভি -২ সহ আপনার হাতে বিভিন্ন ধরণের রোগ-সৃষ্টিকারী এজেন্ট বা প্যাথোজেনগুলি ধ্বংস করতে সহায়তা করে। কিন্তু সেরা অ্যালকোহল-ভিত্তিক হাত স্যানিটাইজারগুলিরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং সমস্ত ধরণের জীবাণু দূর করতে পারে না। সিডিসির মতে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান থেকে মুক্তি দিবে না। এবং এটি বেশ অনেক (নরোভাইরাস, ক্রিপ্টোস্পরিডিয়াম, ক্লোস্ট্রিডিয়াম) জীবাণুগুলি ধংসের ক্ষেত্রেও কার্যকর নয়। এছাড়াও, যদি আপনার হাত দৃশ্যমান নোংরা বা চিটচিটে হয় তবে স্যানিটাইজার ভাল কাজ করতে পারে না। যদি আপনার হাতটি নোংরা থাকে তবে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের পরিবর্তে হাত ধোয়ার বিকল্পটি বেছে নিন।
হাত ধোয়া (হ্যান্ড ওয়াশিং) বনাম হ্যান্ড স্যানিটাইজার, কোনটি?
সাধারণ সর্দি এবং নভেল করোনভাইরাস বা অন্য অসুস্থতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে কখন হাত ধুয়া উচিত বা কখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার। সিডিসির মতে, সাবান এবং পানি দিয়ে আপনার হাত ধোয়া সর্বদা অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কেবলমাত্র হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন যদি সাবান এবং পানি সহজলভ্য না হয়।
যে সময়ে আপনার হাত ধুয়ে নেওয়া জরুরি:
*টয়লেট থেকে বেরুনোর পরে
*আপনার নাকের ভিতর হাত, কাশি বা হাঁচি দেওয়ার পরে
*খাবার আগে
*দূষিত হতে পারে এমর কোন পৃষ্ঠ স্পর্শ করলে
সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে হাত ধুয়ার জন্য সিডিসির সুনির্দিষ্ট নির্দেশাবলি:
*সর্বদা পরিষ্কার, চলমান পানি ব্যবহার করুন। (এটি গরম বা ঠান্ডা হতে পারে))
*প্রথমে আপনার হাতগুলি ভিজিয়ে নিন, তারপরে কলটি বন্ধ করুন এবং সাবান দিন।
*কমপক্ষে ২০ সেকেন্ডের জন্য সাবান দিয়ে আপনার হাত একসাথে ঘষুন। আপনার হাতের আঙুলের মাঝে এবং নখের নীচে হাতের পিছনে পরিষ্কার করার বিষয়টি নিশ্চিত করুন।
*পানি চালু করুন এবং আপনার হাত ধুয়ে ফেলুন। একটি পরিষ্কার তোয়ালে বা এয়ার ড্রাই ব্যবহার করুন।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার হ'ল সাবান ও পানি পাওয়া যায় না এমন সময় জীবাণুগুলির বিস্তার রোধে সহায়তা করার এক সহজ উপায়। অ্যালকোহল-ভিত্তিক হাত স্যানিটাইজার আপনাকে সুরক্ষিত রাখতে এবং নভেল করোনা ভাইরাস প্রসার কমাতে সহায়তা করতে পারে। যদি আপনার স্থানীয় স্টোরগুলিতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার খুঁজে পেতে খুব সমস্যা হয় এবং হাত ধোয়ার উপায় না থাকে তবে আপনি নিজে তৈরি করার পদক্ষেপ নিতে পারেন।
যদিও স্যানিটাইজারগুলি জীবাণু থেকে মুক্তি পাওয়ার কার্যকর উপায় হতে পারে, তবুও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ রোগজনিত ভাইরাস এবং অন্যান্য জীবাণু থেকে মুক্ত রাখতে হাত ধোয়ার পরামর্শ দেন।
আপনার সচেতনতা এবং পরিচ্ছন্নতাই করোনা মুক্ত রাখতে পারে আপনাকে, আপনার পরিবারকে, সমাজকে এবং দেশকে। সবাই ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন।
লেখক: অধ্যাপক ড. করিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়