লকডাউনের প্রভাবে কমেছে ঢাকার বায়ু দূষণ
করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে মহামারি আকারে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। আক্রান্ত প্রায় সকল দেশেই চলছে লকডাউন। নিজেকে সুস্থ রাখতে ঘর থেকে না বের হতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে সকলকে। বন্ধ আছে কল কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, স্কুল কলেজ। নিজ ঘরে আপাতত বন্দী জীবন কাটাচ্ছে মানুষ।
চারিদিকে এতসব দুঃসংবাদের মধ্যেও করোনার প্রভাবে প্রকৃতিতে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন। অল্প কিছুদিন আগেও সারাবিশ্বের সব মেগা সিটির মধ্যে ঢাকা ছিল সবচেয়ে বেশি দূষিত শহর। কিন্তু চলমান লকডাউনে কদিনেই ঘটে গেছে আকস্মিক পরিবর্তন। IQAir AirVisual নামের সাইট—যারা বিশ্বব্যাপী এয়ার পলিউশনের তালিকা নিয়ে কাজ করে, তাদের সূচিতে দেখা যাচ্ছে ঢাকা নেমে এসেছে ২১ নাম্বারে। ঢাকার অবস্থান দখল করে ভারতের গাজিয়াবাদ শহর উঠে গেছে প্রথম স্থানে।
তালিকাটি দেখে নিতে পারেন এখানে ক্লিক করে
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুসারে, বায়ু দূষণের ফলে বিশ্বব্যাপী এক বছরে আনুমানিক ৭ মিলিয়ন অকাল মৃত্যু ঘটে। মূলত হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং শ্বাস প্রশ্বাসের সংক্রমণ থেকে মৃত্যুর হার বাড়ার পেছনে বায়ু দূষনকেই বিশেষভাবে দায়ী মনে করা হয়। বায়ু দূষণের ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত যে নীতিমালা আছে তা যেসকল দেশে ঠিকঠাকভাবে অনুসরণ করা হয় না, সেসকল দেশের জনগণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দেয় বেশি।
লকডাউনের কারণে যেমন কমেছে কল কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া এবং বর্জ্য, পাশাপাশি কমেছে যানবাহনের কালো ধোঁয়া। যানবাহন বন্ধ থাকায় কমেছে শব্দ দূষণও। যে নগরীতে আগে সকলের ঘুম ভাঙত যানবাহনের কর্কশ শব্দে, এখন তাদেরই ঘুম ভাঙাচ্ছে পাখির কিচির মিচির ডাক। এই শহরে পাখিও আছে এমন কথা ভুলতে বসা মানুষের মনে তাই কিছুটা হলেও ফিরে এসেছে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা।
লক ডাউনের কারণে শুধু ঢাকাই নয়, পরিবেশগত উন্নতি হয়েছে ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের বেশ কিছু শহরেরও। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ু দূষণের পরিমাণ সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল—শীর্ষ ত্রিশের মধ্যে ২৭টি মেগাসিটি ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের। যেখানে ভারতেরই রয়েছে প্রায় ২৩টির মতো শহর। গেল কিছুদিন ধরে করোনার বিস্তাররোধে সারা ভারতব্যাপী চলছে কার্ফিউ। আর এর ফলে দেখা গেছে দিল্লি, মুম্বাইসহ তাদের বেশ কিছু শহরের বায়ু দূষণের পরিমাণ নাটয়কীয়ভাবে কমে এসেছে। যার ফলে সে দেশের পরিবেশবিদরা করোনার এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীসময়েও দেশের বায়ু দূষণ কমানোর জন্য সরকারকে এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলছে যার ফলে সার্বিকভাবে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমে আসে।
ঢাকা শহর যদিও বায়ু দূষণের সূচকে বেশ উন্নতি করেছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেশের বায়ু দূষণের পরিস্থিতির এখনো খুব একটা উন্নতি হয়নি। US Air Quality Index এর ২০১৯ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বায়ু দুষণের শীর্ষ দেশ ছিল বাংলাদেশ। এরপর যথাক্রমে পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তান এবং ইন্ডিয়া। তবে এই লকডাউন আরো কিছুদিন চললে এবং এর পরবর্তী সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশের বায়ু দূষণের মাত্রা হ্রাস পেয়ে পরিবেশে ভারসাম্য ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়।
করোনার বিস্তাররোধে লকডাউনের পদক্ষেপে সারাবিশ্বেই পরিবেশগত বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন জায়গায় জনমানবহীন রাস্তায় নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীকে। ভারতের একটি সমুদ্রে সৈকতে পর্যটক না থাকায় ডিম পাড়তে ছুটে আসে লাখো কচ্ছপ দল। বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রায় ত্রিশ বছর পর দেখা গেছে ডলফিন, এমনকি দুর্লভ প্রজাতির গোলাপি ডলফিনেরও মিলেছে দেখা। পর্যটকশূন্য কক্সবাজার সৈকতে ফুটেছে সাগরলতা, আর এ জালে রাশি রাশি বালুরাশি আটকে সৃষ্টি হচ্ছে বালিয়াড়ি।
বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের মাত্রা দিন দিন যেভাবে বাড়ছিল—আসন্ন জলবায়ুগত মহাবিপদকে ঠেকিয়ে দিতে করোনা মহামারি থেকে নিতে হবে শিক্ষা। ইত্যাবসরে প্রকৃতি আরো সবুজ করে সাজিয়ে তুলুক নিজেকে, যেন আমরা চোখ ফেরাতে না পারি—ফিরে না যাই আবার দূষণের পুরনো সংস্কৃতিতে।