পৃথিবী স্মৃতির নগরী যেন করোনার দাপটে
বলা হচ্ছিল, ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী’। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় সারা পৃথিবীকে ডাকা হচ্ছিল ‘ভুবন গ্রাম’। ইন্টারনেটে হাতের মুঠোয় চলে আসা পৃথিবীকে মনে হতো ঠিক যেন পাশের বাড়ি। পৃৃথিবীতে পরিভ্রমণ করাও সহজ ছিল সুপারসনিক যাতায়াত ব্যবস্থার সুবাদে। সেই একই পৃথিবীকে এখন মনে হচ্ছে, বহুদূরের, অচেনা। আমাদের বসবাসের সুন্দর-সবুজ ভূগোল করোনার দাপটে যেন হয়ে গেছে বিবর্ণ, জনমানুষ শূন্য, প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতির নগরী।
সুন্দরতর পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে, কোণে কোণে কত শহর, নগর, নদী, বন, সমুদ্র, সৈকত, পাহাড়। অনেক জায়গায় নিজে গিয়েছি, জানিনা, আবার যাওয়া হবে কিনা! বহু জায়গায় যাওয়া হয়নি, কে জানে, কোনো দিনও আর যাওয়া হবে, না হবেনা!
দার্জিলিং গিয়েছিলাম, আজ অবিশ্বাস্য মনে হয় হিমালয়ের শরীরে গা এলিয়ে দেওয়া হিলস্টেশনকে। শৈলশহর হয়তো আগের সৌন্দর্য নিয়েই আছে। মল চত্বর, টাইগার হিল আর কাঞ্চনজঙ্ঘাও অপেক্ষমাণ। শুধু নেই মানুষের আনাগোনা।
কক্সবাজারে, দীঘায়, রাঁচিতে, চিল্কায়, ফয়'স লেকে কাটিয়েছি বাঙ্ময় সময়। প্রকৃতির কাছাকাছি সব কিছুই তো অন্যভাবে উন্মোচিত হয়। যেমন হয়েছিল কাঠমান্ডু, নাগরকোট, ললিতপুর, ভক্তপুর, পোখরায়। বাঘমতি নদীটি ঠিক যেখানে হিমালয় থেকে ছিটকে বের হয়ে আসে, নেপালের সেই পাকদণ্ডীতে দাঁড়িয়ে জেনেছিলাম প্রত্যেকের মধ্যে আছে এরকম কত নদী ও পাহাড়।
যেসব নদী দেখিনি, নীল, টাইগ্রিস বা দজলা, ফোরাত, আমাজন, সীন, দানিয়ুব কিংবা পাশের ময়ূরাক্ষী, কাবেরি এমন কত নাম। কে জানে, সেইসব নদীতে নেমে জলে পা ভিজিয়ে দেখা হবে কিনা নিজের ভেতরের নদীটিকে!
কিংবা সাগর? বঙ্গোপসাগরের সাথে আরব সাগরের তুলনা করেছি আস্ত একটি দিন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখে। দাদির শহর নামে সবাই যাকে চেনে, সেই জেদ্দায়। ওপারে প্রসারিত কৃষ্ণ আফ্রিকা তবু আমি তারচেয়েও কালোজলে নিজের প্রলম্বিত ছায়া দেখে চমকে পিছনের ধূ ধূ বালুকাবেলায় তাকাই। মনে হয় আটলান্টিক, প্যাসিফিক, আড্রিয়াটিক, মর্মর সাগর ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিজেকে দেখি। দেখা সম্ভব হবে কখনো?
‘পাথরসময়’ বলে একটি শব্দ আছে। এক সময় জনপ্রিয় কলাম ছিল এক নামজাদা অধ্যাপকের। কেউ গল্প, উপন্যাসও লিখে থাকবেন ‘পাথরসময়’ নিয়ে। মেঘ কেটে গেলে আকাশে যেভাবে তারা জেগে উঠে আবার, সেভাবে পাথরেরও বুক ফুঁড়ে জেগে উঠতে পারে বৃক্ষ-ঘরবাড়ি। ঘরবন্দী হয়ে সেই জাগৃতির ছবি কল্পনা করি বুক পকেটের অ্যালবামে।
তারপর চলে যাই পৃথিবীর পথে, প্রান্তরে, না-দেখা জনপদে। রাহুলের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ স্পর্শ করি ভূপেনের কণ্ঠে। চলে যাই সেখানে, যেখানে ঘুমিয়ে শেক্সপিয়র, হোমার, ফেরদৌসী, রুমী সুপ্রাচীন খ্রিস্টাব্দের অতল ঘুমে, তারা শুনছেন শব্দহীন পৃথিবীর জমাট নৈশব্দ? হাজার বছরের নিদ্রা ভাঙেনি পৃথিবীর তীব্রতম কোলাহলেও, পিরামিডের সেই মমি শুনতে পায় আদিঅন্তহীন, নগ্ন, শীতল, নীরবতা?
'স্ট্যাচু অব লিবার্টি'র তলায় অপেক্ষায় থাকি, কেউ এসে হার্লেম থেকে নিয়ে যাবে ব্রডওয়েতে। তারপর অফুরন্ত নিউইয়র্ক করতলে নিয়ে আমি ঠিক পৌঁছে যাবো আটলান্টা সিটিতে, সল্টলেকে, তোমার কাছে। আরেকটু পেরিয়ে, গ্রেট লেকসের ওপাশে কানাডায়। সাসকাচুয়ানের সুশীতল রাতগুলো কাটিয়ে বসে থাকবো মহার্ঘ বসন্তের জন্য। পৃথিবী সঙ্গী হবে?
আমাদের বন্ধু, সহকর্মী, কবি ও অধ্যাপক মহীবুল আজিজ খুবই সাচ্চা ভাষায় প্রায়শই বলেন, ‘সকলেরই আছে স্ব-স্ব পর্যটন’। সত্যিই তো, নইলে কেমনে চলে আসে অদেখা রূপসী প্যারিস একান্ত অনুভবে! নোত্রদাম, সঁজেলিজে। এহেন করোনার ক্ষণে দিন যায় দেখা-অদেখার স্মৃতির বৃষ্টিতে ভিজে গ্রিক-রোমান ভাস্কর্যগুলো ছড়িয়ে-ছটিয়ে দেয় বেদনার অশ্রুবিন্দু!
একই সমতলে, একই সঙ্গে, আমি পরিণত হই টুরিস্ট ও ট্র্যাভেলারে। টুরিস্ট, যে ঘর থেকে বের হয় ঘরে ফিরে আসবে বলে। আর ট্র্যাভেলার, ঘর থেকে বের হয়, কিন্তু জানেনা, কবে ফিরে আসবে। আমি তাহলে কোন জন? টুরিস্ট? ট্র্যাভেলর? আমি তো সঙ্গরোধে ঘরবন্দী, তবু কেন ঘুরে বেড়াই সেই পৃথিবীতে, যা এখন দূরতম স্মৃতির নগরী!
হয়তো হয়ে গেছি আক্রান্ত, আমাদেরই কুকর্মের দোষে অথবা শাপগ্রস্তে, তবুও মানব শ্রেষ্ঠত্বের অনিবার্য স্থিরতাতে, স্থিতিতে, গৃহস্থ অচল প্রহরে মনোলোকে জাগাই গতি অন্তরে-বাহিরে। ঘরে থেকেও চলে যাই ধূলি ধূসরিত পৃথিবীতে। মান্না দে এমন করেই বলেছিলেন, ‘ধরণীর পথে পথে ধূলি হয়ে রয়ে যাবো এই কামনা, আর কিছু না।’
পৃথিবী, এখন স্মৃতির নগরী, তারই নস্টালজিক স্মৃতি নিয়ে বাঁচি। মনে মনে গুনগুন করে বলি: 'কথা ছিল দেখা হবে, দেখা হলো না, না বলা কথা তাই বলা হলো না।'
আজকাল এরকম কিছু লাইন বার বার মনে পড়ে। কোনো কবিতার লাইন? বা গানের? জানিনা। শুধু লাইনগুলো মনে পড়ে আর প্রাণের দোসর পৃথিবীর সঙ্গে দেখা হওয়ার তীব্র আকুতি জাগে।