গৃহবন্দী জন্মদিনে লকডাউনের কবিতা
ড. মহীবুল আজিজ, কবি, কথাশিল্পী, অধ্যাপক। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক জোতির্ময় ব্যক্তিত্ব। কবি, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্যের একজন নিবিষ্টচিত্ত পাঠক ও গবেষক তিনি।
১৯ এপ্রিল ৫৭ তম জন্মদিনে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধের মধ্যেও সচল, প্রাণবন্ত এবং কর্মময় তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, সাবেক সভাপতি ও কলা অনুষদের বর্তমান ডিন মহীবুল আজিজ তার জীবনের অভাবনীয় নীরবতার জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখলেন সৃজনের সম্ভারে।
এদিন তিনি সম্পন্ন করলেন অষ্টাদশ কাব্যগ্রন্থের (প্রকাশিতব্য) পাণ্ডুলিপি। শিরোনাম ‘লকডাউন ও অন্যান্য কবিতা’। ভোরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই ফোনের অপ্রান্ত থেকে জানান আনন্দ সংবাদ। তারপর আবৃত্তি করেন কাব্যগ্রন্থের 'রোমের ক্যাথিড্রালে একাকি টেনর' কবিতার কিছু অংশ, যা মূলত একটি সনেট:
হে টেনর, কার জন্যে গান গাও তুমি,
পেট্রিসিয়ান প্লেবিয়ান সকলেই মরে।
ভূমিকম্প ছাড়াই কাঁপে পদতলে ভূমি,
তবু তুমি ছড়াও কণ্ঠ বিশ্বচরাচরে।
লাশ-কাটা ঘরে ভিঞ্চি বেড়াতেন খুঁজে,
মানুষেরা সিয়েস্তায় থাকতো চোখ বুঁজে।
সেই রোম সেই দেশ সবটাই মর্গ আজ,
চতুদিকে পরিব্যাপ্ত মৃত্যু কারুকাজ।
কলিসিয়াম খাঁ-খাঁ করে মহাশূন্যতায়,
মৃত দর্শকেরা ভিড় জমায় এরেনায়।
যখন সবটাই এক স্তব্ধ মরুভূমি,
গ্ল্যাডিয়েটর হয়ে ফের জন্ম নিলে তুমি।
হ্যাঁ, টেনর নও তুমি, যুদ্ধজয়ী বীর,
অদৃশ্য শত্রুকে ছোঁড়ো মৃত্যুঞ্জয়ী তীর।
যেভাবে ছুঁড়েছে তীর গল ও রোমান,
লড়েছে প্রতাপশালী লক্ষ এট্রুসকান।
তোমার ডানদিকে সারা বিশ্ব, বামে বিধি,
মৃত্যুভয়ে মানুষের ঘুম নেই চোখে।
মৃত্যুর আলোক জ্বলে দ্যুলোকে-ভূলোকে,
মনুষ্যলোকের তুমি দৃপ্ত প্রতিনিধি।
সন্ধ্যা ধীরে নামে রোমে, আলো নিভে আসে,
অমল প্রাণের হাসি মোনালিসা হাসে।
মৃত্যুহাওয়া বয়ে যায় স্তব্ধ উপত্যকায়,
তারই মধ্যে জীবনের গান ভেসে যায়।
‘লকডাউন ও অন্যান্য কবিতা’ গ্রন্থের প্রসঙ্গে মহীবুল আজিজ বলেন, 'এই চলমান সঙ্কুল পরিস্থিতিকে লিপিবদ্ধ করে রাখার প্রয়াস এই কাব্যগ্রন্থ। আমাদের জীবনে ও পৃথিবীর ইতিহাসে যে ঘোরতম বিরূপতা এসে হানা দিয়েছে, তার অভিঘাতেই রচিত হয়েছে কবিতাগুলো, যা সভ্যতার পরিক্রমায় একটি বিশেষ অবস্থাকে চিত্রিত করে।'
'জন্মদিনেও লিখছি, যেমন আমি সারা জীবনই লেখালেখির মধ্যে যাপন করতে চেয়েছি নিজের মহার্ঘ জীবন', বলেন মহীবুল আজিজ। 'তবে ৫৭ তম জন্মদিন শুধু বৈশ্বিক কারণেই নয় ব্যক্তিগত দিক থেকেও বিশেষত্বে ভরপুর। ঘরবন্দী আছি, স্ত্রী (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. কাজী শামীম সুলতানা) কিছুটা অসুস্থ, একমাত্র সন্তানের দীর্ঘকালীন চিকিৎসা, শুশ্রূষা, শিক্ষার বিষয়গুলো চলমান। কিন্তু চারিদিকে নৈশব্দ। যেন কেউ নেই পাশে কোথাও। তবু আমি যাপিত জীবনের সংগ্রাম ও সংক্ষোভে কবিতাকে নিয়ে আছি অন্তর্গত আনন্দে', বলেন তিনি।
১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণকারী মহীবুল আজিজ রচনা করেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ মিলিয়ে পঞ্চাশাধিক গ্রন্থ। অতিক্রম করেছেন তিন যুগের কাছাকাছি অধ্যাপনা, গবেষণার পেশাজীবন। ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের বহুদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল। মিশেছেন বিশ্বজনীন সাহিত্য প্রতিভাসহ নানা ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাসের বর্ণিল মানুষের সঙ্গে।
ক'দিন আগে (ফেব্রুয়ারি ২০২০) মহীবুল আজিজ তার সর্বশেষ প্রকাশিত 'সোহরাব সেপেহরি ও অন্যান্য ইরানি কবির কবিতা' গ্রন্থে ফরাসি সাহিত্যের সুপ্রাচীন কালপর্ব থেকে সর্বসাম্প্রতিক কাব্যধারার ঐশ্বর্যময় নির্যাস উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক সাহিত্য প্রতিভার মিশেলে তার ব্যক্তিত্বের বিনির্মাণ সম্পন্ন হলেও মৌলিক প্রবণতা ও সত্তায় তিনি কবি এবং স্বাপ্নিক, ঠিক যেন পারস্য কবিতার চরণগুলোর মতো:
চলো আমরা কেবল দেখি
জলের আর্দ্র পদচ্ছাপ পথ ধরে এগিয়ে চলে
ভালোবাসার শেকড়ের অভিমুখে।
এবং হয়তোবা আমাদের কাজ হলো
বরফের শ্বেতপদ্ম আর বছরগুলোর রক্তিম লালের মধ্য দিয়ে
সত্যের সঙ্গীতের পেছনে ছুটে চলা।
[জলের পদধ্বনি/সোহরাব সেপেহরি (অনুবাদ: মহীবুল আজিজ)]