রেমডেসিভির বিতর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ১ মে গুরুতর করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) রোগীর চিকিৎসায় রেমডেসিভির ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। কিন্তু, বিতর্ক শুরু হয় কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এর কার্যকারিতা নিয়ে। কারণ, এর তিন দিন আগে কোভিড-১৯ রোগীদের রেমডেসিভির প্রয়োগে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি বলে ল্যানসেটের এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন হলো— রেমডেসিভির কী ধরনের ড্রাগ, এটি কীভাবে কাজ করে এবং কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এটি কি আসলেই কার্যকরী?
১। রেমডেসিভির (GS-5734) একটি বিস্তৃত বর্ণালীর অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ, যা করোনাভাইরাসের কয়েকটি প্রজাতি, যেমন: সার্স, মার্স, সার্স-কোভ-২সহ (বর্তমান মহামারির কারণ) আরও কয়েকটি আরএনএ ভাইরাস, যেমন: ইবোলা, মারবার্গ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কার্যকরী।
রেমডেসিভির একটি সংশ্লেষিত (সিনথেটিক) অ্যান্টিভাইরাল রাসায়নিক। এটির আবিষ্কারক আমেরিকার বিখ্যাত জীবপ্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি গিলিয়াড সায়েন্সেস। গিলিয়াড বলছে, এ ওষুধ আবিষ্কার করতে তাদের প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করতে হয়েছে। আবিস্কারের পর ২০০৯ সালের দিকে কোম্পানিটি প্রথমে হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস এবং রেস্পিরেটরি সিঙ্কশিয়াল ভাইরাসের বিরুদ্ধে এটির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস রোগে আক্রান্তদের নিয়ে প্রথম ধাপের (ফেইজ-১) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়।
কিন্তু, ২০১৮ সালে এসে ইবোলা ভাইরাস রোগে এটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ রেমডেসিভিরের চাইতে আরও দুটি ওষুধ (রেজেনেরন ও মনোক্লনাল অ্যান্টিবডি ১১৪) ইবোলা ভাইরাস রোগে অধিক কার্যকরী বলে প্রমাণ পায়। তাই, ইবোলা ভাইরাস রোগে এর ব্যবহারের অগ্রগতি সেখানেই থেমে যায়। ২০১৬ সালে গিলিয়াড সায়েন্সেস ইবোলার পাশাপাশি সার্স ও মার্স ভাইরাসের প্রাইমেট মডেলের ওপর এর কার্যকারিতা পরীক্ষা শুরু করে। সার্স ও মার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাইমেট মডেলের কার্যকারিতা ভালো বলে প্রমাণিত হলেও এ দুটি ভাইরাসে ঘটিত রোগে ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে পারেনি গিলিয়াড।
২। রেমডেসিভির এক প্রকারের প্রো-ড্রাগ। এর কেমিক্যাল ফর্মুলা: C27H35N6O8P এবং আণবিক ওজন ৬০২ দশমিক ৫৮৫ গ্রাম/মোল। প্রাণীদেহে প্রবেশের পর এই নিস্ক্রিয় উপাদানটির মূল গঠন দেহের এস্টারেজ এবং ফসফোরামাইডেজ এনজাইমের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে GS-441524 নামক সক্রিয় উপাদান তৈরি হয়। যেটি আবার নিউক্লিওটাইড কাইনেজ এনজাইমের মাধ্যমে GS-441524 ট্রাইফসফেটে রূপান্তরিত হয়। GS-441524 নামক নতুন এই সক্রিয় উপাদানটির কেমিক্যাল ফর্মুলা: C12H13N5O4 ও আণবিক ওজন ২৯১ দশমিক ২৬ গ্রাম/মোল। GS-441524 ট্রাইফসফেট ভাইরাসের আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ নামক এক এনজাইমের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। যার ফলে ভাইরাসের আরএনএ’র কপি তৈরি করার ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়।
৩। রেমডেসিভির ইবোলা, সার্স এবং মার্স ভাইরাসঘটিত রোগের চিকিৎসায় আশা জাগালেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে চীনের উহানে নতুন এক ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়। যা খুব দ্রুত সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আজ পর্যন্ত (৩ মে ২০২০) প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ এই ভাইরাসঘটিত রোগ কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত হয়েছেন এবং এর মধ্যে আড়াই লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। জানুয়ারিতে উহানে যখন করোনাভাইরাসের নতুন এ প্রজাতিটি হাজারো মানুষকে আক্রান্ত করে, তখন গিলিয়াড সায়েন্সেস রেমডেসিভির নিয়ে এগিয়ে আসে এবং আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজের হাসপাতালে উহানফেরত কোভিড-১৯ আক্রান্ত একজন আমেরিকান নাগরিকের ওপর পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়। চমকে দেওয়ার মতো ফল দেয় রেমডেসিভির।
এরপর ফেব্রুয়ারিতে গিলিয়াড চীনের দুটি হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করার জন্য রেমডেসিভির পাঠায়। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসা আশাব্যঞ্জক হওয়ায় ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বিশ্বের ছয়টি দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি ও যুক্তরাজ্য) ১ হাজার ৬৩ জন রোগীর ওপর শুরু হয় তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেসের পরিচালক অ্যান্টনি এস ফাউসি, যিনি এ ওষুধটির তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি গত ২৯ এপ্রিল দাবি করেছিলেন, রেমডেসিভির কোভিড-১৯ আক্রান্তদের দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে কাজ করছে এবং রেমডেসিভির প্রয়োগে সেরে ওঠার সময় ১৫ দিন থেকে ১১ দিনে নেমে এসেছে।
এর দুদিন পরেই মে মাসের ১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ‘ইমারজেন্সি ইউস অথোরাইজেশন’ স্কিমের আওতায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন, তাদের জন্য ‘রেমডেসিভির’ ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এটিই প্রথম অনুমোদিত কোনো ওষুধ।
রেমডিসিভিরের আপাতত মুখে খাওয়ার কোনো ডোসেজ ফর্ম নেই। এটি শুধুমাত্র ইন্ট্রাভেনাস ইঞ্জেকশন (শিরায় ইঞ্জেকশন) হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, এটি পাঁচ দিনেই বেশ আশাব্যঞ্জক ফল দেয়। প্রথম দিনে ২০০ মিলিগ্রাম করে দিনে একবার এবং পরবর্তী চার দিন ১০০ মিলিগ্রাম করে দিনে একবার করে ইন্ট্রাভেনাস রুটে দিতে হবে এ ওষুধ। শুধুমাত্র গুরুতর আক্রান্ত অর্থাৎ যাদের নিউমোনিয়া দেখা দিবে এবং রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিবে (অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৪ শতাংশ বা তার চেয়ে কম) এরকম রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে রেমডেসিভির। গিলিয়াড বলছে, রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার ১০ দিনের মধ্যে রেমডেসিভির ব্যবহার শুরু করলে বেশি ভালো ফল পাওয়া যায়।
৪। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শুরু থেকে রেমডিসিভির বেশ আশাব্যাঞ্জক ফল দিলেও, গত ২৩ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে ভুলভাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন সারাবিশ্বে ঝড় তুলে। অবশ্য দুই ঘণ্টার মধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওয়েবসাইট থেকে সেই রিপোর্টে সরিয়ে ফেলে। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছিল, চীনে যে রেমডেসিভিরের ট্রায়াল চলছিল, সেটি ব্যর্থ হয়েছে।
পরে ২৯ এপ্রিল বিশ্বের নামকরা প্রভাবশালী জার্নাল ‘ল্যানসেটে’ প্রকাশিত হয় সেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল। চীনের ১৫৮ জন গুরুতর অসুস্থ রোগীর শরীরে দেওয়া হয় ওষুধটি। পাশাপাশি ৭৯ জনকে রাখা হয় প্লাসেবো কন্ট্রোল গ্রুপে, যাদের ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শুধু দ্রাবক দেওয়া হয়, কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি। দুই গ্রুপের রোগীদেরই ২৮ দিন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তাতে দেখা যায়, এটি রোগীদের অবস্থার কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটায়নি এবং প্লাসেবো গ্রুপের তুলনায় রক্তে ভাইরাসের সংখ্যাও কমাতে পারেনি।
ল্যানসেটে এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশের একই দিনে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করে, তারাসহ ছয়টি দেশে ১ হাজার ৬৩ জন রোগীর ওপর চালানো তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল। যা আমি ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি। চীনের এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের এ বিপরীত ফলাফল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। এ নিয়ে গিলিয়াডের ভাষ্য হলো, ল্যানসেট জার্নালে চীনের ট্রায়ালের যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তাতে রোগীর সংখ্যা ছিল অনেক কম (১৫৮ জন) এবং রোগীরা ছিল শুধু একটিমাত্র দেশের।
বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত ট্রায়ালে ছয় দেশের মোট ১ হাজার ৬৩ জন রোগী অংশ নিয়েছে, তাই, এই ফলাফলটাই বেশি নির্ভরযোগ্য। গিলিয়াড শিগগিরই তাদের গবেষণার বিস্তারিত ফলাফল জার্নালে প্রকাশ করবে বলে জানায়। পাশাপাশি সবমিলিয়ে ১৫টি দেশের ১৮০টি হাসপাতালে ৫ হাজহার ৬০০ জন গুরুতর অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীর ওপর এই ওষুধের কার্যকারিতার পরীক্ষাও চলমান বলে জানায় গিলিয়াড। সেই প্রসারিত ট্রায়ালের ফলাফলই বলে দেবে— কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এর ভবিষ্যৎ।
ড: মো: আজিজুর রহমান শামীম, সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (ইমেইলঃ [email protected])