করোনার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা ওষুধের উৎপাদন, ব্যবহার ও বিক্রয়মূল্য নিয়ন্ত্রণ জরুরি
করোনাভাইরাস গোত্রের সার্স-কোভ-২ নামক ভাইরাসের প্রজাতিটি ইতোমধ্যে সারা বিশ্বকে প্রায় অচল করে ফেলেছে। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি কার্যকরী কোনো প্রতিষেধক। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ উন্নত অনেক দেশেই চলছে কোভিড-১৯-এর কার্যকরী প্রতিষেধক আবিষ্কারের জোর প্রচেষ্টা।
১। বেশ কয়েকটি ওষুধ ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ভালো ফল পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিভিন্ন দেশের গবেষকগণ। এর মধ্যে কয়েকটি ওষুধ আছে যেগুলো অন্য ভাইরাসঘটিত রোগের চিকিৎসার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ না থাকায় সেগুলো পরীক্ষামূলক ভাবে এ রোগে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন- ইনফ্লুয়েঞ্জার পরীক্ষামূলক গবেষণাধীন ওষুধ ফাভিপাইরাভির, এইডসের ওষুধ লোপিনাভির এবং রিটোনাভির-এর কম্বিনেশন এবং ইবোলা, সার্স, মার্স, মারবার্গ ইত্যাদি ভাইরাসঘটিত রোগের জন্য পরীক্ষামূলক গবেষণাধীন ওষুধ রেমডেসিভির। অন্যান্য যেসব ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে তার মধ্যে আছে ম্যালেরিয়া, রিউমাটয়েড আর্থরাইটিস (rheumatoid arthritis) এবং লুপাস রোগের ওষুধ ক্লোরোকুইন/হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন; পলিআর্টিকুলার জুভেনাইল ইডিয়োপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস (পিজেআইএ) এবং সিস্টেমিক জুভেনাইল ইডিয়োপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস (এসজেআইএ) রোগের ওষুধ “টোসিলিযুমাব” এবং ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ফুসফুস, ত্বক, কান ও যৌনঘটিত রোগের সংক্রমণে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক “অ্যাজিথ্রোমাইসিন”।
২। ফাভিপাইরাভির (ব্র্যান্ড নাম অ্যাভিগান) হলো জাপানিজ কোম্পানি ফুজি ফিল্ম তোয়ামা কেমিক্যালের আবিষ্কৃত একটি ওষুধ যা জাপান সরকার ২০১৪ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা চিকিৎসার জন্য অনুমোদন দেয়। ফাভিপাইরাভির এবং রেমডেসিভির রাসায়নিকভাবে বেশ আলাদা হলেও তাদের কাজের পদ্ধতি একই। দুটি ওষুধই আরএনএ ভাইরাসের আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের কাজে বাধা তৈরি করে। চীনে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে যে ওষুধটি প্রয়োগ করা হয় তা হলো ফাভিপাইরাভির। গত ১৮ মার্চ এলসিভিয়ার প্রকাশিত “ইঞ্জিনিয়ারিং” নামক জার্নালে এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়। এ ট্রায়ালে ৩৫ জন কোভিড-১৯ রোগীর একটি গ্রুপকে দেয়া হয় ফাভিপাইরাভির ট্যাবলেট (প্রথম দিন ১৬০০ মিলিগ্রাম দিনে দুইবার এবং পরবর্তী ১৪ দিন ৬০০ মিলিগ্রাম দিনে দুইবার) এবং ইনহেলার হিসেবে দিনে দুইবার করে ৬০ মাইক্রোগ্রাম ইন্টারফেরন-আলফা১বি। আরেকটি গ্রুপকে দেয়া হয়েছিলো এইডসের ওষুধ লোপিনাভির (৪০০ মিলিগ্রাম দিনে দুইবার) এবং রিটোনাভির (১০০ মিলিগ্রাম করে দিনে দুইবার)-এর কম্বিনেশন এবং ইনহেলার হিসেবে দিনে দুইবার করে ৬০ মাইক্রোগ্রাম ইন্টারফেরন-আলফা১বি। দেখা যায়, রোগীদের ফাভিপাইরাভির প্লাস ইন্টারফেরন দেয়া হয়েছিলো তারা গড়ে চার দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে ওঠে। লোপিনাভির-রিটোনাভির প্লাস গ্রুপের ইন্টারফেরন গ্রুপের রোগীদের গড়ে সময় লাগে এগারো দিন। ফাভিপাইরাভির প্লাস ইন্টারফেরন গ্রুপের রোগীদের চেস্ট ইমেজিংইয়েও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয় (প্রায় ৩০ শতাংশ)। আরেকটি সম্প্রসারিত ট্রায়ালে ৩৯০ জন রোগীর ওপর একই রকম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সে ট্রায়ালে পূর্বের মতোই ফল পাওয়া যায় বলে জানানো হয়। তবে, ফাভিপাইরাভির শুধুমাত্র মৃদু থেকে মাঝারি কোভিড-১৯ রোগে কাজ করে, রেমডেসিভিরের মতো গুরুতর অবস্থায় এটি ভালো কাজ করে না। চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে ফাভিপাইরাভির করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় এখনও পরীক্ষাধীন।
৩। অন্যদিকে পরীক্ষামূলকভাবে গবেষণায় খুব ভালো ফল না পেলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় এ মাসের ১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইউএসএফডিএ) “ইমারজেন্সি ইউস অথোরাইজেশন” স্কিমের আওতায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা গুরুতর অবস্থায় আছেন, তাদের জন্য ‘রেমডেসিভির’ ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। “ইমারজেন্সি ইউস অথোরাইজেশন” স্কিমের আওতায় অনুমোদিত ওষুধসমূহ সাধারণ এফডিএ-এর সাধারণ অনুমোদনের মতো নয়। তাই, সম্ভাবনা আছে যদি অন্য কোনো ওষুধ ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে গবেষণায় রেমডেসিভিরের তুলনায় বেশি কার্যকরী প্রমাণিত হয়, ইউএসএফডিএ ওষুধটির প্রাথমিক অনুমোদন বাতিল করে দিতে পারে, ফলে রেমডেসিভিরের পরিণতি দাঁড়াতে পারে ইবোলায় এর ব্যবহারের মতো। প্রসঙ্গত, রেমডেসিভির ড্রাগটির আবিষ্কারক আমেরিকার বিখ্যাত জীবপ্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি গিলিয়াড সায়েন্সেস ২০১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস রোগে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রথম ধাপের (ফেইজ-১) পরীক্ষামূলক গবেষণা শুরু করে। কিন্তু, ২০১৮ সালে ইবোলা ভাইরাস রোগে এটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বন্ধ করে দেয়া হয়। কারণ আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ রেমডেসিভিরের চাইতে আরও দুটি ওষুধ (রেজেনেরন এবং মনোক্লনাল এন্টিবডি ১১৪) ইবোলা ভাইরাস রোগে অধিক কার্যকরী বলে প্রমাণ পায়। তাই, ইবোলা ভাইরাস রোগে রেমডেসিভিরের ব্যবহারের অগ্রগতি সেখানেই থেমে যায়। ফাভিপাইরাভিরের মতো রেমডেসিভিরও এক প্রকারের প্রো-ড্রাগ যা প্রাণীদেহে প্রবেশের বিভিন্ন এনজাইমের প্রভাবে সক্রিয় হয় এবং ভাইরাসের আরএনএ ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমের বিরুদ্ধে কাজ করে। রেমডেসিভির কোভিড-১৯ আক্রান্তদের দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষেত্রে স্পষ্ট ভাবে কাজ করছে বলে দাবি করছে এর আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠান এবং ট্রায়াল সংশ্লিষ্ট গবেষকগণ। ৬টি দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি এবং যুক্তরাজ্য) ১০৬৩ জন রোগীর করা ৩য় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল হিসেবে জানানো হয় রেমডেসিভির প্রয়োগে প্লাসেবো গ্রুপের তুলনায় সেরে ওঠার সময় ৪ দিন কমে এসেছে (১৫ দিন থেকে ১১ দিন) এবং মৃত্যুহারও কমেছে (১১.৬ শতাংশ থেকে ৮.০ শতাংশ)। গিলিয়াড এখনো তাদের গবেষণার ফলাফল কোন পিয়ার-রিভিইউড জার্নালে প্রকাশ করেনি কিন্তু খুব শীঘ্রই প্রকাশ করবে বলে জানায়। কিন্তু, ২৯ এপ্রিল বিশ্বের নামকরা প্রভাবশালী জার্নাল “ল্যানসেট”-এ চীনের ১৫৮ জন গুরুতর অসুস্থ রোগীর উপরে চালানো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশিত হলে রেমডেসিভিরের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। ল্যানসেটের সেই প্রতিবেদনে দাবি করা হয় রেমডেসিভির ব্যবহারে রোগীদের অবস্থার কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। প্লাসবো গ্রুপের তুলনায় রক্তে এটি রোগীর শরীরে ভাইরাসের সংখ্যাও কমাতে পারেনি। ল্যানসেটের সেই গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে গিলিয়াডের ভাষ্য হলো চীনের ট্রায়ালে রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫৮ জন এবং রোগীরা ছিল শুধু একটিমাত্র দেশের। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত ট্রায়ালে ছয় দেশের মোট ১০৬৩ জন রোগী অংশ নিয়েছে, তাই এই ফলাফলটাই বেশি নির্ভরযোগ্য। গিলিয়াড এও জানায় ১৫টি দেশের ১৮০টি হাসপাতালে ৫,৬০০ জন গুরুতর অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীর ওপর এই ওষুধের কার্যকারিতা আরও পরীক্ষা করার জন্য একটি সম্প্রসারিত ট্রায়াল চালানোর প্রস্তুতি চলছে। গবেষকরা মনে করছেন সেই সম্প্রসারিত ট্রায়ালের ফলাফলই বলে দিবে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এর ভবিষ্যৎ।
৪। ক্লোরোকুইন এবং এর আরেকটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ রাসায়নিক ফর্ম হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়া, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যামিবিয়াসিস এবং লুপাস চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এগুলো ফাভিপাইরাভির এবং রেমডেসিভিরের মতো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নয়, কিন্তু কোভিড-১৯ চিকিৎসায় চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যহবার করা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, ক্লোরোকুইন/হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পোষক দেহের কোষের pH বাড়িয়ে দেয় ফলে কোষের যে সকল অংশ (এন্ডজোম এবং লাইজজম) ভাইরাসকে ফিউসন প্রক্রিয়ায় কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশে সহায়তা করে তা বাধাগ্রস্ত হয়। এটি ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন এবং মানবদেহের কোষের ACE2 রিসেপ্টরের সংযোগ প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করে, ফলে ভাইরাস কোষের ভিতরে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয়। মার্চের ২০ তারিখে ফ্রান্সে পরিচালিত একটি ছোট ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের গবেষণার ফল এলসিভিয়ারের জার্নাল “ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল অ্যাজেন্টস”-এ প্রকাশিত হয় এবং এটিতে দাবি করা হয়, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কন্ট্রোল গ্রুপের তুলনায় স্পষ্টভাবেই কোভিড-১৯ রোগীদের সারিয়ে তুলতে সহায়তা করেছে। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের সাথে অ্যাজিথ্রোমাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার ফলে রোগীদের শরীর থেকে ভাইরাস আরও দ্রুততার সাথে নির্মূল হয়েছে। কিন্তু ট্রায়ালে রোগীর সংখ্যা কম হওয়ায় এই ট্রায়ালের ফলাফলের উপর নির্ভর করা সমীচীন হবে না বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মত দেন। পাশাপাশি ইউএসএফডিএ ওষুধটি রোগীদের ওপর মারাত্মক বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করে দেয়। শুধুমাত্র নিশ্চিত কোভিড-১৯ রোগীদের ওপর এটা সতর্কতার সাথে ব্যবহারের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়। এদিকে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে ১৩৭৬ জন নিউইয়র্কের হাসপাতালে ভর্তি কোভিড-১৯ রোগীর ওপর চালিত একটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণার ফলাফল গতকাল প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারে রোগীদের মৃত্যু বা সুস্থ হওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। এ গবেষণার ফল কোভিড-১৯ চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারের যৌক্তিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললো।
৫। গত এপ্রিল ২০২০ এর প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেশের দুটি নামকরা ওষুধ প্রস্তুতকারি কোম্পানি, বেক্সিমকো, বিকনকে এবং পরবর্তীতে এসকেএফ এবং জিসকা ফার্মাকে ফাভিপাইরাভির উৎপাদনের অনুমতি দেয়। ইতোমধ্যে বিকন ফার্মা “ফাভিপাইরা” ব্রান্ড নামে এটি ২০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট প্রস্তুত করা শুরু করেছে এবং তারা বেশ কিছু ট্যাবলেট পরীক্ষার জন্য হস্তান্তর করেছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য মতে, বিকন ফার্মা ২০টি ট্যাবলেটের দাম নির্ধারণ করেছে ৮ হাজার টাকা (প্রত্যেক ২০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেটের দাম পড়বে ৪০০ টাকা)। চীনে ব্যবহৃত ডোসেজ রেজিমেন ব্যবহার করলে চৌদ্দ দিনের চিকিৎসায় খরচ পড়বে প্রায় ৩৮,০০০ টাকা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা গাইডলাইনে সম্ভবত ভুল করে দিনে দুইবার ব্যবহারের পরিবর্তে দিনে তিনবার ফাভিপাইরাভির ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এটি দ্রুত সংশোধিত করা উচিত, না হলে অতিরিক্ত ডোজের কারণে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
মে মাসের ১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র রেমডেসিভির ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার পর তিন দিনের মাথায় দেশের আটটি ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানকে ওষুধটি উৎপাদন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই কোম্পানিগুলো হলো বেক্সিমকো, এসকেএফ, ইনসেপটা, স্কয়ার, বিকন, হেলথকেয়ার, অ্যাকমি ও পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস। দুদিন আগে এসকেএফ ইতোমধ্যে ওষুধটির উৎপাদনের সব প্রক্রিয়া শেষ করে ফেলেছে এবং “রেমিভির” ব্রান্ড নামে বাজারজাত করার প্রস্তুতি শুরু করেছে। পাঁচদিনের চিকিৎসায় এসকেএফের ওষুধটি কিনতে রোগীর খরচ হবে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আর দশ দিনের চিকিৎসায় খরচ পড়বে ৬০ হাজার টাকার মতো। বার্তা২৪.কম এ প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এসকেএফ প্রতিটি ওষুধের বাজারমূল্য নির্ধারণ করেছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। ফাভিপাইরাভির অথবা রেমডেসিভির দিয়ে চিকিৎসার এই উচ্চমূল্য কতজন রোগী ব্যাক্তিগতভাবে সরবরাহ করতে পারবে তা এখন বড় উদ্বেগের বিষয়।
৬। ফাভিপাইরাভির এবং রেমডেসিভির দুটোই এখনো বিভিন্ন দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। এদের মধ্যে রেমডেসিভিরের কার্যকারিতা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে এবং ফাভিপাইরাভির গুরুতর করোনা রোগে তেমন কাজ করে না। এটি মৃদু থেকে মাঝারি লক্ষণের রোগীদের ওপর পরীক্ষা করে ফল পাওয়া গেছে। চিকিৎসার খরচও আকাশ্চুম্বি। প্রশ্ন হলো এরকম দুটি ওষুধকে আমাদের দেশে একটি কন্ট্রোলড, র্যানডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ব্যাতীত যথেচ্ছভাবে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহার করা উচিত হবে কিনা। আরেকটি ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, চীন, যুক্তরাষ্ট্র সহ যেসব দেশে রেমডেসিভিরের ট্রায়াল চালানো হয়েছে তাতে আবিষ্কারক কোম্পানি গিলিয়াডের সরবরাহ করা রেমডেসিভির ইঞ্জেকশন ব্যবহার করা হয়েছে। গিলিয়াডের রেমডেসিভির ব্যবহার করেও যেখানে খুব উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাওয়া যায়নি, সেখানে গিলিয়াড ব্যাতিত অন্য কোনো এপিআই প্রস্তুতকারী কোম্পানির রেমডেসিভির কেমন ফল দিবে তা র্যানডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ব্যাতীত বলা অসম্ভব। পাশাপাশি যে সকল দেশীয় কোম্পানি এ ওষুধগুলো প্রস্তুত করছে তারা একই সোর্সের এপিআই ব্যবহার করছে কিনা তাও নিশ্চিত করতে হবে। না হলে একেক কোম্পানির প্রোডাক্ট একেক রকম ফলাফল দিবে। এরকম হলে মার্কেটে ছাড়ার পূর্বে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পাশাপাশি এসব প্রোডাক্টের বায়োইকুইভ্যালেন্স টেস্টও করা উচিৎ। আর ইন্টারফেরন-আলফা১বি ইনহেলার একইসঙ্গে ব্যবহার না করলে ফাভিপাইরাভির কাজ করবে কিনা তাও বিবেচনায় নিতে হবে। উল্লেখ্য, ইন্টারফেরন-আলফা১বি ইনহেলার আমাদের দেশে কোনো কোম্পানি বাজারজাত করে বলে আমার জানা নেই।
দেশীয় ওষুধ কোম্পানিসমূহের উপর আমাদের আস্থা অনেক। যে সকল কোম্পানি ফাভিপাইরাভির এবং রেমডেসিভির উৎপাদনের দায়িত্ব নিয়েছে তাদের দেশে-বিদেশে বেশ সুনাম রয়েছে। দেশের শত শত গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট সফলভাবে কাজ করছেন এসব কোম্পানিতে। তাদের দক্ষতা এবং পেশাদারিত্বও অনেক উঁচু মানের। আমার বিশ্বাস দেশের এ সংকটে এ সকল স্বনামধন্য কোম্পানিসমূহ ফাভিপাইরাভির ও রেমডেসিভির উৎপাদন এবং বিপণনে শুধু লাভের চিন্তা করবে না, এসব ওষুধের প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা, রোগীদের কল্যাণ এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিবে। পাশাপাশি আমি এও বিশ্বাস করি রেগুলেটরি অথরিটি হিসেবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর উক্ত বিষয়গুলো যথাযথভাবে তদারকি করবে এবং কিভাবে এ ওষুধগুলোর দাম করোনা রোগীদের ক্রয়ক্ষমতার রাখা যায় সে ব্যবস্থা করবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকায় বিনামূল্যে ওষুধগুলো রোগীদের জন্য সরবরাহ করা যায় কিনা তাও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি ক্লোরোকুইন/হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কোভিড-১৯ চিকিৎসায় আসলেই কার্যকরী কিনা তা নিয়ে দেশেই চালাতে আরেকটি র্যানডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল।
ড: মো: আজিজুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ফার্মেসী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]