কোভিড-১৯ পরবর্তী পৃথিবী

  • মূল: আন্দ্রে হফম্যান, ভাষান্তর: তোফায়েল আহমেদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আন্দ্রে হফম্যান, ছবি: সংগৃহীত

আন্দ্রে হফম্যান, ছবি: সংগৃহীত

প্রকৃতি ধ্বংসের ফলেই যে মানবজাতি ক্রমাগতভাবে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে পড়ছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সামান্যই মতভেদ রয়েছে। যেমন কোভিড-১৯, যা পৃথিবীজুড়ে ইতোমধ্যে লাখ লাখ মানুষকে অসুস্থ করার পাশাপাশি অগণিত মানুষের প্রাণহানির কারণ হচ্ছে।

এই মহামারি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমকেও বাধাগ্রস্ত করবে। কারণ পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি জিডিপি কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। কোভিড-১৯ মহামারি কি সবাইকে এ সম্পর্কে জাগ্রত করবে? বা এর ফলে মানুষের সচেতনতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কি বর্তমান ব্যবস্থাকে পাল্টানো যাবে?

বিজ্ঞাপন

কিছু সংখ্যক রাজনীতিক বলছেন, এই মহামারি এই সময়ে ভাবনার মধ্যে ছিল না। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিন দিন জোনোটিক রোগের যে বিস্তার হচ্ছিল (ক্ষুদ্র অনুজীব দ্বারা সংগঠিত রোগ যা প্রাণীর দেহ থেকে মানবদেহে প্রবেশ করে) তার ফলাফল হিসেবে এ মহামারি অপরিহার্য ছিল।

এই প্রবাহ মানবসৃষ্ট কাজের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। প্রকৃতির সহ্যক্ষমতা থেকে অধিক চাষাবাদ, বনধ্বংস থেকে শুরু করে মাইনিং, পশু নিধন এসব ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, যাকে আমরা “স্বাভাবিক ব্যবসায়ীক কাজকর্ম” দাবি করছি। ফলাফল হিসেবে জীবজন্তুর সাথে আমাদের মিথস্ক্রিয়া সর্বচ্চো পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিণতি হিসেবে রোগব্যাধি বিস্তারের আদর্শ ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইবোলা, এইডস, সেবিয়ের একুইট রেসপেটরি সিনড্রোম বা সার্স এবং মিডল ইস্ট রেসপেটরি সিনড্রোম বা মার্স, সবগুলো রোগই সবাইকে আগাম সতর্কবানী দিয়েছে যাতে বিশ্ব কর্ণপাত করেনি।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু কোভিড-১৯ অন্য যে কোনো মহামারি বা ব্যাধি থেকে ভিন্ন হতে পারে। পরিশেষে এটা অন্য যে কোনো সময়ের মহামারি থেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্ববাসীর সামনে পরিষ্কার করল যে কীভাবে প্রাণপ্রকৃতির ভালো থাকার সাথে মানবজাতির সুস্থতা ও উন্নতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবেশ সংরক্ষণ অর্থনীতিতে ধ্বংস নামাবে এই দাবি শুধু অদূরদর্শিতাই নয় বরং তা হিতেও বিপরীত। বরং পরিবেশগত ধ্বংসের ফলেই আজ বিশ্ব অর্থনীতি থমকে গেছে।

অধিকন্তু, সাম্প্রতিক কালের অন্য যে কোনো প্রাদুর্ভাবের চেয়ে কোভিড-১৯ এ রাষ্ট্রগুলো নজিরবিহীন এবং ব্যাপকভাবে বৈশ্বিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম ও কৌশলপত্র প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। রাষ্ট্রগুলোর এসব পদক্ষেপ পরিবেশ রক্ষা ও পুনরায় সংরক্ষণের এক সুবর্ণ সুযোগ হাজির করেছে। এসব পুনরুদ্ধার কার্যক্রম দু’টি বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হওয়া উচিত। প্রথমত. ভর্তুকিই একমাত্র সমাধান নয়, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে পরিবেশগত আইন আরও দৃঢ়তর করতে হবে। দ্বিতীয়ত. সরকারি ব্যয় এমনভাবে করা উচিত, যাতে সামাজিক স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হয়। এর অর্থ হলো সবুজ কলকারখানাগুলোতে বিনিয়োগ করা, বিশেষ করে ওইসব কাজে যা আমাদের টেকসই অর্থনীতির (circular economy) দিকে নিয়ে যাবে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং নোবেল লরিয়েট জোসেফ স্টিগলিজ ও নিকোলাস স্টার্ন তাদের গবেষণায় পেয়েছেন, ‘‘সবুজ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজ’’ প্রথাগত অর্থনৈতিক উদ্দীপকের (stimulus) চেয়ে উচ্চ হারে লাভ, সাময়িক চাকরির নিশ্চয়তা এবং ভালোমানের দীর্ঘমেয়াদি ব্যয় কমিয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি অবকাঠামো তৈরি, বিশেষ করে শ্রমনিগূঢ় কার্যক্রম জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগের চাইতে প্রতি ডলারে দ্বিগুণ পরিমাণে চাকরির সংস্থান করে।

অন্যান্য অগ্রাধিকারের মধ্যে ‘প্রাকৃতিক পুজি’তে বিনিয়োগের মধ্যে বৃহৎ পরিসরে বাস্তুচক্রের পুনরুদ্ধারও অন্তর্ভুক্ত। এসব কার্যক্রম অনেক মূল্যবান সুবিধা তৈরি করবে, যেমন জৈবচক্রের শক্তিশালীকরণ থেকে শুরু করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ যা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বনডাইঅক্সাইড অপসারণে সহায়তা করবে। এসব প্রচেষ্টা এগিয়ে নিতে প্রকৃতি ও জলবায়ুকে সংকটে ফেলে এমন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদি ও ঋণপ্রদানকারী ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

কিছু সংখ্যক আইন প্রণেতা এর প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা বা আইএমএফ সবুজ পুনরুদ্ধার কীভাবে করা যায়, সে সম্পর্কিত বৃহৎ পরিসরে নির্দেশনা দিয়েছে। একই সাথে আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টিনা জর্জিয়েভা কর্পোরেট বেইলআউটে যাতে পরিবেশগত শর্ত জুড়ে দেয়া হয় সেজন্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ফ্রান্স ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। অধিকন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোভিড-১৯ এর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সবুজ পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা আঁকছে, যা ইতোমধ্যে নেওয়া ‘ইউরোপীয় গ্রিন ডিল’ এর সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। এর প্রধান উদ্দেশ্য জীববৈচিত্র্যের পুনঃসংরক্ষণ এবং শূন্য কার্বন অর্থনীতির দিকে নিজেদের কার্যক্রমকে আরও বেগবান করা।

ইউরোপের রাজনীতিবিদ, কোম্পানি, ট্রেড ইউনিয়ন, প্রচারণা গ্রুপ, থিংক ট্যাংকের ১৮০ জন সদস্য এর সদস্য দেশগুলোকে চিঠি দিয়ে সবুজ উদ্দীপক কার্যক্রম গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বৈশ্বিক টেকসই পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বহুসংখ্যক রাষ্ট্রকে নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদকে পরিবেশ ধ্বংসকারক কলকারখানা ও কার্যক্রমে কাজে লাগিয়ে এখনো পর্যন্ত অনেক সরকারই এর বিপরীতে কাজ করছে।

উদাহরণ হিসেবে স্টিগলিজ এবং স্টার্ন দেখিয়েছেন- নিঃশর্ত বিমান বেইলআউট অর্থনীতির গতিশীলতা এবং জলবায়ুর স্বাভাবিক ছন্দে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব ফেলে। এবং এখনো পর্যন্ত বিলিয়ন ডলার কোনো শর্তারোপ ছাড়াই সরকারি বিমান কোম্পানিগুলোকে দেয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক গ্রিন স্টিমুলাস ইনডেক্স এর রিপোর্ট অনুসারে এসব উদ্দীপকের তৃতিয়াংশেরও বেশি যে বৃহৎ ১৬ অর্থনীতির দেশে ব্যয় করা হয়েছে, তা সম্ভবত বিরূপভাবে পরিবেশের ক্ষতি করবে।

ক্রমবর্ধমানভাবে এই কর্মপন্থার পক্ষে সাফাই গাওয়া কঠিন এবং এটা যাতে ভুলে না যাই যে এই মহামারির কিছুদিন আগেও বিশ্বজুড়ে নজিরবিহীন দাবানল ও বন্যার প্রকোপ ছিল। যেহেতু দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, তাই এসব রোগব্যাধির জন্য দায়ী যেসব কারণ, তা প্রায়ই ঘটবে এবং তা আরও তীব্রতর হবে। রাজনৈতিক এবং কায়েমি স্বার্থবাদীরা হয়ত সামনের এসব চ্যালেঞ্জ থেকে মনোযোগ সরাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু এটা ভবিষ্যৎ কোনো সংকটের সমাধান করবে না এবং একই সাথে এটি অবশ্যই তাদের কোভিড-১৯ এর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে দেবে না। অন্যদিকে, প্রথাগত ব্যবসায়ীক কার্যক্রমে প্রত্যাবর্তনও এসব মহামারির আগমনকে ত্বরান্বিত করবে।

এক সংকট থেকে অন্য সংকটে পতিত হওয়ার চেয়ে আমাদের অবশ্যই স্থিতিমাপক কোনো ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

পরিশেষে, কোভিড-১৯ পরবর্তী পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে পরিবেশ সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীয় ইস্যু হিসেবে তুলে ধরার এটাই সুবর্ণ সুযোগ।

অনুবাদক তোফায়েল আহমেদ

তোফায়েল আহমেদ: স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মূল: আন্দ্রে হফম্যান, সুইস ধনকুবের।