যেভাবে হতে পারে ইউরোপ ও চীনের সমঝোতা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের নিজ স্বার্থরক্ষায় এখনও কি যথাযথ কৌশল অবলম্বন করতে পারবে? আসন্ন দিনগুলোতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য এটাই হবে প্রধান প্রশ্ন।
চীন মার্কিন দ্বন্দ্ব নভেম্বরের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসন পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছেন নিজেদের ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে সরাতে চীনকে সবকিছুর জন্য দোষারোপ করাই মোক্ষম কৌশল। ট্রাম্প তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের নিকট যদি পরাজিতও হোন, তারপরেও চীনের সাথে তাদের দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকবে। চীনের ভূরাজনৈতিক উত্থান রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতির প্রতিষ্ঠিত কৌশল– সংকোচন, দমন এবং এবং ভূরাজনৈতিক উত্থান পরিবর্তন করে দেয়া তা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিদলীয় ঐতিহ্য (অর্থাৎ এক্ষেত্রে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয়দলের নীতিই এক)।
চীনকে রুখতে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য যেকোন দেশের আগ্রাসী যেকোন নীতিই সফল হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। চীনের মাথাপিছু জিডিপি (ক্রয়ক্ষমতা সূচকের সাথে সমন্বয়ক্রিত) অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ অথবা মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রের এক তৃতীয়াংশ। কিন্তু অর্থনীতির সার্বিক আয়তনে চীন খুব দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ছুঁয়ে ফেলবে।
এটা কেউই বুঝতে পারছে না যে সামনের দশকে চীনের অর্থনীতি কোন প্রক্রিয়ায় এগোবে। কিন্তু বর্তমান প্রবণতা বলছে চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ, এই দুইয়ের অপেক্ষাই অধিক হারে এগোবে। চীন যদি তাইওয়ানের সাথে তাদের মাথাপিছু জিডিপি ব্যবধান অর্ধেকেও নামিয়ে আনতে পারে, তবে (জনসংখ্যার কল্যাণে) এর অর্থনীতি যু্ক্তরাষ্ট্র অথবা ইইউ’র সামগ্রিক অর্থনীতির দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
কোভিড-১৯ মহামারি সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা ও বিশ্বব্যাংক প্রত্যাশা করছে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এ বছরও ইতিবাচক থাকবে। ইতোমধ্যে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীর অর্থনৈতিক সংকোচন প্রত্যক্ষ করছে এবং এর শেষ কখন হবে এর কোনো সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ফলাফলে, এই মহামারি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের আপেক্ষিক প্রভাব আরও বাড়াবে।
তবে ‘বয়সী’ হতে থাকা জনসংখ্যা, বিশাল লোকসানি রাষ্ট্রীয় খাত, বাড়ন্ত ঋণ; এসবের প্রভাবে আসন্ন দিনে চীনের অর্থনীতি শক্ত ধাক্কা খাবে, বিশেষ করে যদি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অগ্রাধিকারে কাঠামোগত সংস্কার চলতে থাকে। চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি আধুনিক সমাজ পরিচালনায় অতিশয় বেমানান। কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃত্যুর পূর্বে উহানের ফিজিশিয়ান লি ওয়েনলিয়াং যিনি করোনা প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার অপরাধে চীনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তিনি বলেন, একটি সুস্থসমাজের একটি মাত্র কণ্ঠস্বর থাকা উচিত নয়। এই ত্রুটিপূর্ণ মানে চীনের রাজনৈতিক পদ্ধতি খুবই নাজুক অবস্থায়। এই অবস্থা সবধরনের অস্থিরতা ও নাজুকতার জন্য সহায়ক ও অরক্ষিত।
এখন পর্যন্ত এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আগামী দিনের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীন এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠবে। এর বর্ধনশীল উপস্থিতি সবার জন্যই এক নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে, বিশেষ করে ইউরোপের জন্য। কারণ ইউরোপ যু্ক্তরাষ্ট্রের ওপর আর নির্ভরযোগ্য ও সমমনা অংশীদার হিসেবে আস্থা রাখতে পারছে না। তারা নিজেরাই নিজেদের কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে।
চীনকে নিয়ে ইউরোপের নতুন কৌশল দুটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। প্রথমত, পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবশ্যই সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে। চীন বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের ৩০ শতাংশ নিঃসরণের জন্য দায়ী। কারণ বর্তমানে ইউরোপের অন্যতম প্রধান নীতি হলো গ্রিন এনার্জি ট্রান্সমিশনের দিকে নিজেদের ধাবিত করা ও ২০৫০ সালের মধ্য ‘শূন্য কার্বন নিঃসরণ’র লক্ষমাত্রা অর্জন করা। তাই চীনের সাথে সংলাপ বন্ধ করা কোন ভালো বিকল্প নয়।
এই কথা অন্যান্য অধিজাতিক বিষয় যেমন বাণিজ্য ও গণস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে ইউরোপ ও চীনের উভয়েরই বড় স্বার্থ রয়েছে একইসাথে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সংস্কারের জন্য প্রয়োজন উভয়ের সহযোগিতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান গভীরভাবে হিতে বিপরীত যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বহুজাতিক সংস্থার শক্তিশালীকরণকে আরও বৃহত্তর বোঝা হিসেবে হাজির করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে এটাই প্রতিয়মান হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এসব সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ও গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, ইইউ ক্রমবর্ধমান ভাবে চীনকে “পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী” হিসেবে দেখে যার মূল্যবোধ ও স্বার্থ অপরিহার্যভাবে এর নিজের সাথেই সংঘাতে জড়াবে। ইউরোপের সংবেদনশীল বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগ দেখভাল করা একই সাথে চীনা রাষ্ট্রিয় ভর্তুকি প্রাপ্ত করপোরেশন ও ইউরোপীয় ফার্মের মধ্যে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে একটি শক্ত কাঠামো দরকার। অনেকগুলো বিষয়ের মধ্য ইউরোপীয় নীতিনির্ধারক ও কূটনৈতিকদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, চীন বিভিন্ন বিষয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাতে তারা যাতে অটল থাকে।
এটা নিঃসন্দেহ যে ইউরোপের জনমত চীনের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব অবশ্যই নীতিনির্ধারণে পড়বে। হংকং, তাইওয়ান ও জিনজিয়াংয়ে চীনা শাসকদের নির্যাতন, দমন ও অত্যাচার বেড়ে চলার প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পক্ষে তৎপরতা চালানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়া হাঙ্গেরির মতো রাষ্ট্রের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাজ হবে দুটি স্তম্ভের মধ্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। যদিও ইউরোপ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াবে কিন্তু পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইইউ চীনকে পরিত্যাগ করবে না। ইউরোপকে যেমন বিশ্বপরিমণ্ডলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে অবশ্যই বাস্তববাদী হতে হবে, অন্যদিকে চীনা নেতাদের বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরও লাভবান করবে। চীন বিষয়ে ইউরোপ যখন নতুন কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে তখন হংকংয়ে চীনের দমন পীড়ন তাদেরকে আরও কঠোর হতে বাধ্য করবে।
মূল লেখক: কার্ল বিল্ট, সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।