লাদাখ সীমান্তে লম্ফ-ঝম্প : সমর নাকি সমঝোতা



সাদিয়া আফরিন কুমু
প্রাথমিকভাবে বিরোধের শুরু হয়েছিল ১৮৬৫ সালে

প্রাথমিকভাবে বিরোধের শুরু হয়েছিল ১৮৬৫ সালে

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি ভারত বনাম চীন সম্পর্কের নানান গুঞ্জনে উত্তাল হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। বৈশ্বিক রাজনীতিতে সীমান্ত-বিরোধ নিয়ে দু দেশের মধ্যে বৈরিতা যেন কচ্ছপের কামড়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ থেকেই সীমানা ভাগাভাগি নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাস তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিরোধের টানাপোড়েনেই বারবার বিষোদগার হয়েছে উভয়ের ক্ষোভ। প্রাথমিকভাবে বিরোধের শুরুটা হয়েছিল ১৮৬৫ সালের জনসন লাইন ও আকসাই চীনের বিতর্ক থেকে। তার কিছু পরে ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা প্রস্তাবিত ১৯১৪ সালের ম্যাকমোহন লাইনের কিছু অংশ (তিব্বত ও অরুণাচল সীমান্ত) অস্বীকার করে চীন। তিব্বত দখলের পর অরুণাচল ও আকসাই চীনকে চীনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা হিসেবে দাবি করে চীন। ভারত—চীন কর্তৃক তিব্বতের দখলের ঘোর বিরোধিত করে এবং এই দ্বন্দ্ব চলাকালে তিব্বত ত্যাগ করা ধর্মীয় নেতা দালাই লামাকে আশ্রয় প্রদান করে। যার ফলশ্রুতিতে বিদ্বেষ আরো ঘনীভূত হয়। সীমান্ত-বিরোধকে কেন্দ্র করেই সূত্রপাত হয় ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের, যেখানে চীনের কাছে একতরফাভাবে ধরাশায়ী হয় ভারত। এরপর অবশ্য দুই দেশের মাঝে একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। তার পর থেকে কয়েকবার সীমান্ত-বিরোধের জের ধরে উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে থাকলেও কোনো প্রথাগত যুদ্ধ জড়ানোর নজির নেই।

কিন্তু, গত ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতের রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং চীনের অন্তত ৪৩ জন সেনা হতাহতের খবর জানান দিচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যম। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া উত্তাপ থেকেই বাড়তে শুরু করেছে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বৈরথের পারদ। ১৯৬২-এর পর দুই দেশ সম্মুখ যুদ্ধে জড়ায়নি, তাদের মধ্যে নতুন করে কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা স্বীকার করতে নারাজ অনেকে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। দু দেশের মধ্যকার বিরোধ নতুন মোড় নিয়ে যেভাবে জটিল আবহের সৃষ্টি করে চলেছে তাতে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে একেবারে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।

বর্তমান সময়ের এই ভিন্ন পরিস্থিতিতে পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের যুদ্ধে জড়ানো কি আদৌ সম্ভব নাকি নিতান্তই অগড়ম বগড়ম, সেটাই ভাববার বিষয়।

যুদ্ধের আলোচনায় সামরিক শক্তির প্রসঙ্গটি কান টানলে মাথা আসার মতো প্রাসঙ্গিক। বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে দু দেশের সামরিক শক্তির তুলনামূলক আলোচনা করা হচ্ছে। দুটি দেশই পরমাণু শক্তিধর হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য অত্যধুনিক সমরাস্ত্রে বলীয়ান। বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজেদের তৈরি অস্ত্রে অস্ত্রাগার সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি অস্ত্র আমদানিও করে আসছে এই দুই দেশ। সামরিক শক্তির দিক থেকে আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে অস্ত্র আমদানিতে পরপর পাঁচ বছর শীর্ষস্থানে থাকা ভারত। ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক শক্তিধর দেশের তালিকাভুক্ত হওয়া ভারতের বর্তমান পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৫০টি, যদিও চীনের পারমাণবিক অস্ত্র ভারতের বর্তমান পারমাণবিক অস্ত্র সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি (৩২০টি)।

সেনা সদস্য সংখ্যার দিক থেকে পিআরডব্লিউ সূচক অনুযায়ী প্রায় ১৩৮টি দেশের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জনবহুল দেশ চীন। চীনের সেনা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ২১ লক্ষ ২৩ হাজার, অন্যদিকে ভারতের সেনা সংখ্যা ১৪ লক্ষ ৪৪ হাজার। যদিও চীনের তুলনায় প্রায় ১৬ লক্ষ বেশি রিজার্ভ সেনা সদস্য নিয়ে চীনের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত। মার্চ মাসে বেলফার সেন্টার থেকে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতের প্রায় ২৭০টি যুদ্ধ বিমান এবং ৬৮টি স্থল আক্রমণ বিমান রয়েছে। অপরদিকে স্থল আক্রমণের জন্য ছোট বিমানবহরসহ চীনের প্রায় ১৫৭টি যুদ্ধ বিমান রয়েছে। চীনের রয়েছে ৭৪টি সাবমেরিন, ৩২১০টি এয়ারক্রাফট, ৩২০০টি যুদ্ধট্যাংক, ও ৩০০টিরও বেশি যুদ্ধজাহাজ। যেখানে ভারতের রয়েছে ৪২০০টি যুদ্ধট্যাংক, ২১১৩টি এয়ারক্রাফট, মাত্র ১৮টি সাবমেরিন ও ৪২টি যুদ্ধজাহাজ।

সামরিক দিক বিবেচনার পাশাপাশি উভয় দেশের কূটনৈতিক দিকও সমান গুরত্বের দাবি রাখে। সেকারণেই ভারত ও চীন উভয়ই নজর দিয়েছে বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার দিকে। দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা পৃথিবীতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে বেশকিছু দিন ধরেই চীন বেশ সচেষ্ট। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো বিশ্বে নব্য উপনিবেশবাদ কায়েম করার প্রচেষ্টায় মগ্ন চীন। বর্তমানের বিবাদমান ইস্যুগুলোর জন্য চীনের আগ্রাসী মনোভাবকেই দুষছেন অনেকে। নিজের প্রভাব বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন করে তাদেরকে নিজের পক্ষে টানার প্রয়াস নতুন নয় চীনের। এই পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই বিভিন্ন দেশের অবকাঠামো ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে সেসব দেশকে পাশে পেতে চাইছে চীন। কিন্তু অন্যদিকে বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়টি দেশ চীনের বিপক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ইন্দো-মার্কিন সম্পর্কের সুবাতাস কূটনৈতিক দিক থেকে চীনের আনুকূল্যকে প্রশমিত করছে।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ভারতও। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইসরাইল, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু দেশের সাথে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞাও অর্জন করেছে ভারত। অপরদিকে প্রতিবেশি দেশ নেপাল, ভুটানের সাথে ভারতের সাম্প্রতিক বৈরিতা ভারতকে নতুন প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাড় করাতে পারে। উপরন্তু, পাকিস্তানের সাথে ভারতের তিক্ততার বিষয়টি ভারতের উদ্বেগকে তরান্বিত করবে।

প্রকৃতপক্ষে তারত ও চীনের সংঘাতের বিষয়ে ভারতের প্রতিবেশি দেশগুলোর মাঝে খুব একটা হেলদোল লক্ষ করা যাচ্ছে না। তাঁরা চলমান উত্তেজনা প্রশমনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি গুরুত্বারোপ করছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মান, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ ভারত ও চীনকে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। রাশিয়াও উভয় দেশের সাথেই সুসম্পর্ক চায় বলে জানিয়েছে। বৈশ্বিক মহামারির এই নাজুক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে কোনো দেশই যুদ্ধসৃষ্ট নতুন কোনো দুর্যোগকালের সাক্ষী হতে চাইবে না।

ভারত-চীন সংঘর্ষের পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে ওঝার ঘাড়ে ভূত চাপলে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনাকালের এই অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে এই দুই পরাশক্তির সম্পর্কের অবনতির (বিশেষ করে বিশ্বের শিল্পায়নের ৭০ শতাংশ কাঁচামাল সরবরাহকারী চীনের অস্থিতিশীলতা) বিরূপ প্রভাবে অর্থনৈতিক চাপে পড়তে পারে মহাদেশের বাকি দেশগুলোও।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায় দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন উভয়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে। চীন-ভারত সংঘর্ষের উত্তাপ বাংলাদেশের ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞজনেরা। সেবিষয়ে ক্রমেই চাপ বাড়ছে বাংলাদেশের ওপর। দু দেশের যে কোনো একটিকে সমর্থন করে একচক্ষু হরিণ হওয়া বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য উভয় দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিরাপদ অবস্থানে থাকতে কূটনৈতিকভাবে আরো কৌশলী হতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে।

আপাত দৃষ্টিতে দুই দেশের চলমান উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখনও উভয় দেশের কোনোটিই যুদ্ধ দামামা বাজানোর মতো বোকামি করবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন বিশেষজ্ঞজনসহ সচেতন নাগরিক শ্রেণী। সীমান্তে উত্তেজনা জিয়িয়ে রাখলেও দুই দেশই শান্তি চায়।

ভারত ও চীনের শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা কারো অজানা নয়। বৃহৎ এই দু দেশের অর্থনীতি একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জনবহুল ভারতের অর্থনৈতিক বাজারের সিংহভাগই চীনাদের দখলে। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে চীন থেকে ভারতে প্রতি বছর গড়ে ৫.২৫ লক্ষ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়। ২০১৯- ২০২০ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৬৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ভারতে রপ্তানি করেছে চীন। ভারতের রপ্তানিকৃত পণ্যের ১৪ শতাংশেরও বেশি পণ্য চীন থেকে রপ্তানি করা হয়। চীন কখনোই চাইবে না ভারতের এই বৃহৎ বাজারের দখলদারিত্ব হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে। ইতোমধ্যেই চীনা পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে সর্বভারতীয় ব্যবসায়ী সংগঠন—কনফেডারেশন অব অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স (সিএআইটি), এর পাশাপাশি তারা ভোক্তাদেরও চীনা পণ্য বর্জনের জন্য আহবান জানিয়েছে। ভারতের সাথে চীনের এই বিরোধ যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ালে ভারতের বাজারে রাজত্ব হারাবে চীন, এবং বিকল্প হিসেবে ভারতের বাজারে পাকাপোক্ত হবে মার্কিন আধিপত্য। ফলশ্রুতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধে পশ্চাদগামী হতে কখনোই পছন্দ করবে না চীন।

অন্যদিকে, ভারতও এটা মাথায় রাখবে—চীন তার তুলনায় পাঁচগুণ বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সামরিক ব্যয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীন ২০১৯ সালে সামরিক খাতে ব্যয় করে ২৬১ বিলিয়ন ডলার, যেখানে গত বছরে ভারতের সামরিক ব্যয় ৬.৮ শতাংশ বাড়ার পরও মাত্র ৭১.১ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় দিক থেকেই পরিস্থিতি চীনের অনুকূলে রয়েছে বলে ধরা হচ্ছে। তাই সম্মুখ সামরিক লড়াইয়ে না গিয়ে হয়তো অসামরিক বা কূটনৈতিকভাবেই চীনকে কোণঠাসা করার পথকে বেছে নেবে ভারত।

সাম্প্রতিক একটি বিবৃতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, “ভারত শান্তি চায়”, তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, “চীনের এই ঘটনা যদি ভারতকে উসকে দেওয়ার জন্য হয়ে থাকে তবে ভারতও এর উপযুক্ত জবাব দিতে সক্ষম।” এ-থেকে বোঝা যায় ভারতের ওপর সরাসরি আক্রমণ আসার আগ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকার শক্ত অবস্থানকেই বেছে নেবে ভারত।

ভারত-চীন সংঘাত যুদ্ধে রূপ নিলে সামরিক শক্তি বা পাল্টাপাল্টি সমরাস্ত্র ব্যবহারের বিধ্বংসী প্রভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে পরমাণু শক্তিধর দুই দেশকেই, সেকথা তাদের কারোরই অজানা নয়। তাই সীমান্ত-বিরোধ নিয়ে ভারত-চীন সম্পর্ক তলানিতে ঠেকলেও এরবেশি সীমান্ত উত্তেজনা বাড়তে দেবে না বরং শেষমেশ সংযম বজায় রেখে সমঝোতাতেই নজর দেবে দেশ দুটি, এখন পর্যন্ত সেরকমই আশা করছেন বিশ্লেষক মহল।

তবে উভয় দেশের সামরিক প্রস্তুতি জোরদার, যেমন সীমান্তে সেনা ও বিভিন্ন যুদ্ধ সরঞ্জামাদি মোতায়েন, সামরিক মহড়া, সৈন্য সংখ্যা সমৃদ্ধকরণ, বিমানঘাঁটি ও রাডার স্টেশন স্থাপনসহ অন্যান্য সব তোরজোড় যুদ্ধের আয়োজনকে তরান্বিত করে সত্যিই কি কোনো জটিল পরিস্থিতির আভাষ দিচ্ছে নাকি নিতান্তই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা সেটা দেখার জন্য থাকতে হবে সময়ের অপেক্ষায়।


সাদিয়া আফরিন কুমু, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,গোপালগঞ্জ

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;