উত্তর ভারতে বায়ুদূষণ, কমছে আয়ু, বাড়ছে বিপদ

  • কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বায়ুদূষণ বিপদে উত্তর ভারত। সংগৃহীত

বায়ুদূষণ বিপদে উত্তর ভারত। সংগৃহীত

বিশাল ভারতীয় উপমহাদেশের 'প্রাণ ভোমর' উত্তর ভারত, যেখানেই সব সময় শাসনের কেন্দ্রস্থল অবস্থিত। আর্য, শক, হুন, মুঘল, পাঠান ইত্যাদি জাতি সমগ্র ভারত শাসন করেছে উত্তর ভারত থেকে। ঐতিহাসিক আমল থেকেই পশ্চিম ভারত গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ রূপে। দক্ষিণ ভারত সমুদ্র ও ব্যবসার জন্য। পূর্ব ভারত কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহ করেছে। আর শাসনের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে উত্তর ভারত।

ভারতের রাজনীতি, প্রশাসনের মতোই জনসংখ্যাও বেশি উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোর গুরুত্ব শহরগুলোতে। মানুষ ভাগ্য ফেরাতে দিল্লি, আগ্রা, লখনৌ, কানপুর, এলাহাবাদ, জয়পুর, গোয়ালিয়র প্রভৃতি শহরে বসবাস করে। উত্তর ভারতের মূলকেন্দ্র এবং ভারতের রাজধানী ও ঐতিহাসিক শহর দিল্লি বহু মানুষের বসবাস ও যান্ত্রিকতার কারণে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বায়ুদুষণ কবলিত শহরে পরিণত হয়েছে। এবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো উত্তর ভারতের বিশাল এলাকাই বায়ুদূষণের কারণে প্রকৃতির থাবায় বিপন্ন। সেখানে কমছে মানুষের আয়ু। বাড়ছে নানামুখী বিপদ।

বিজ্ঞাপন

গবেষণার ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্যে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে উত্তর ভারতের বাসিন্দাদের গড় আয়ু নয় বছর করে কমে যেতে পারে। মহারাষ্ট্র বা মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দারা এখনই গড়ে আড়াই থেকে প্রায় তিন বছর করে আয়ু হারাচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মাত্রায় যদি বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা যেত, গড় ভারতবাসীর আয়ু আরও সাড়ে পাঁচ বছর করে বাড়ত। আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-(একিউএলআই) এর রিপোর্ট তেমনই দাবি করছে।

একিউএলআই-এর মতে, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত দেশ। কারণ এখানকার ৪০ শতাংশ মানুষ গাঙ্গেয় সমভূমির বাসিন্দা। এই অঞ্চলে বায়ুদূষণের মাত্রা তার ব্যাপ্তিতে বিশ্বের অন্য যে কোনও অঞ্চলের বছরভর বায়ুদূষণ-মাত্রাকে প্রায়শই ছাড়িয়ে যায়। ভৌগোলিক ব্যাপ্তিতে তাই এটাই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত এলাকা।

বিজ্ঞাপন

শুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিলে মানুষের আয়ু কতখানি বাড়ে, সমীক্ষা করেছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট। তাদের মতে, ২০১৯-এ গাঙ্গেয় সমভূমিতে বায়ুদূষণের যে মাত্রা ছিল, তা বজায় থাকলে ওই অঞ্চলের ৪৮ কোটি বাসিন্দার গড় আয়ু কমপক্ষে ৯ বছর করে কমে যেতে পারে। সেই সঙ্গে একিউএলআই রিপোর্ট এ-ও জানাচ্ছে, ভারতে বায়ুদূষণের ভৌগোলিক ব্যাপ্তি ক্রমশই বাড়ছে। মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশের মানুষ একুশ শতকের গোড়ার বছরের তুলনায় এখনই গড়ে ২.৫ থেকে ২.৯ বছর আয়ুষ্কাল খোয়াচ্ছেন।

ভারত-সহ গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই বায়ুদূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে রিপোর্টে। সেখানে বলা হয়েছে, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-নেপালে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশের বাস এবং এই চারটি দেশই লাগাতার বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দূষিত দেশের তালিকায় থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাপকাঠিতে দূষণ-মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া বায়ুতে শ্বাস নিতে নিতে পৃথিবী জুড়ে ব্যক্তি-আয়ুষ্কালের মোট যত বছর নষ্ট হতে পারে, তার ৬০ শতাংশই আসবে দক্ষিণ এশিয়া থেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে দূষণ কমাতে পারলে, দক্ষিণ এশিয়াবাসীর গড় আয়ু ৫.৬ বছর করে বাড়তে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকায়, বাতাসে সূক্ষ্ম কণার স্বাভাবিক পরিমাণ হওয়া উচিত প্রতি ঘন মিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম। ভারতে তা রয়েছে গড়ে প্রতি ঘন মিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্বে সর্বোচ্চ।

এই ভয়াবহ দূষণের কারণ কী? রিপোর্ট বলছে, শুধু ভারত ও পাকিস্তানেই ২০০০ সালের তুলনায় এখন রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা চতুর্গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৭-র মধ্যে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-নেপাল মিলিয়ে জীবাশ্ম-জ্বালানিনির্ভর তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। সেই সঙ্গে ফসলের গোড়া পোড়ানো, ইটভাটা এবং অন্যান্য শিল্প-কর্মকাণ্ড তো রয়েছেই। বায়ুদূষণই এখন বিশ্ব স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ, বলেছে রিপোর্ট।

ভারতের এই বিপদ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জন্য কঠিন সতর্ক বার্তার শামিল। উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও নগরায়নের পরিকল্পনাহীন গতি সামাল দিতে না পারলে পুরো অঞ্চলেই বিপদ ঘনিয়ে আসবে। দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশ হবে বসবাসের জন্য বিপজ্জনক।

দক্ষিণ ভারত অবশ্য এই সমস্যা আগেই আঁচ করতে পেরেছে এবং সেখানে নগরায়নের কাজ চলছে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে ও সবুজের সমান্তরালে। দক্ষিণের শহর বেঙ্গালুর 'গার্ডন সিটি'র মর্যাদা পেয়েছে। কোচি, মহিশূর, বিশাখাপত্তম, কালিকট, মুন্নার প্রভৃতি শহর প্রাকৃতিক পরশে আধুনিকতাকে বরন করে অগ্রসর বসবাসের সুযোগ করেছে।

পুরো দক্ষিণ এশিয়াই প্রকৃতির সুরম্য অঙ্গন। এ অঞ্চলের শহরগুলো, যেমন, লাহোর, কাঠমাণ্ডু, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নাগপুর, আম্বালা, জলন্ধর, রাঁচি প্রভৃতি চমৎকার প্রাকৃতিক বিন্যাসে সমৃদ্ধ। পাহাড়, সমুদ্র, অসাধারণ ভূমিরূপের মাধ্যমে নান্দনিক বিভায় উদ্ভাসিত শহরগুলো যেন ভুল পদক্ষেপের কারণে দূষণের ক্ষেত্রে পরিণত না হয়, তা লক্ষ্য রাখা সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্ব। বিশেষত, প্রকৃতির থাবায় বিপন্ন উত্তর ভারতের বিরূপ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণই বাঞ্ছনীয়।