যুবরাজ সালমানের ওপর নাখোশ সত্ত্বেও বাইডেন কেন সৌদিতে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরায়েল হয়ে শুক্রবার সৌদি আরব গেছেন জো বাইডেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বজুড়ে আলোচিত সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতা পেয়েও মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেন সৌদিতে গেলেন। এই নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
তার দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরেই একটি অংশ বাইডেনের সৌদি আরব সফরে প্রচণ্ড নাখোশ। তাদের কথা- প্রেসিডেন্ট তার নীতি-নৈতিকতার সাথে আপোষ করলেন।
সৌদি আরব আগাগোড়া মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান একটি মিত্র দেশ। অনেক দিন ধরেই আমেরিকার নতুন যেকোনো প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা নিয়ে প্রথম যেসব দেশে যান তার একটি সৌদি আরব। তাহলে এখন কেন এই বিতর্ক?
কারণ, প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে-পরে তার কথা, অঙ্গীকারের সাথে বাইডেনের এই সফরের কোনো সামঞ্জস্য নেই।
ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের ভূমিকা নিয়ে আমেরিকার বহু মানুষের মতো জো বাইডেনও ক্ষুব্ধ। এরপর সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডে তিনি যুবরাজ সালমান ও সৌদি রাজপরিবারের ওপর এতটাই নাখোশ হয়েছিলেন যে নির্বাচনী প্রচারণায় ঘোষণা দেন ক্ষমতায় গেলে তিনি এই সৌদি শাসকদের একঘরে করে ছাড়বেন।
আমেরিকা দশকের পর দশক ধরে প্রধানত জ্বালানি তেলের স্বার্থে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে সৌদি রাজপরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে। কিন্তু বাইডেন ক্ষমতায় এসে বলতে শুরু করেন বাইরের যে কোনো দেশের সাথে তার সরকারের সম্পর্কের ভিত্তি হবে মানবাধিকার।
এরপর নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গিয়েও তিনি সৌদি যুবরাজ সালমানের সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে অস্বীকার করেন। সৌদি যুবরাজ তার সাথে কথা বলতে কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করেন বাইডেন।
সৌদি আরব সফরের খবর নিশ্চিত হওয়ার পরও অর্থাৎ গত মাসেও বাইডেন বলেন, যুবরাজ সালমানের সাথে তার কোনো কথা হবে না। কিন্তু পরে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় দু’জনের মধ্যে জেদ্দায় কথা হবে।
ক্ষমতা নেওয়ার ১৮ মাসের মাথায় এসে কেন উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলেন বাইডেন?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাস্তবতার কাছে মাথা নত করছেন বা মেনে নিচ্ছেন ৭৯ বছরের এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর এর পেছনে প্রধানত কাজ করছে ইউক্রেন যুদ্ধ। গত কয়েক দিন ধরে নিজেই তার মত বদলের পক্ষে যুক্তি তুল ধরার চেষ্টা করছেন বাইডেন।
কয়েক দিন আগে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় নিজের লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, সৌদি আরবকে ব্ল্যাংক চেক দে্য়ারর নীতি তিনি বদলে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ইউরোপে যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ও সৌদি আরবের গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করছেন।
বাইডেন লিখেছেন, ‘রাশিয়ার আগ্রাসনের পাল্টা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে। চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় আমাদের শক্ত অবস্থান প্রয়োজন.... এ কারণে সেসব দেশের সাথে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে যারা আমাদের চেষ্টায় সাহায্য করতে পারে। সৌদি আরব তেমন একটি দেশ।’
জেরুজালেমে বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিডের সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন সৌদি যুবরাজের সাথে বৈঠকে তিনি খাশোগি হত্যাকাণ্ডের কথা তুলবেন কিনা। ওই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বাইডেন আবারও যুক্তি তুলে ধরেন, কেন তিনি সৌদি আরব যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘অশান্ত মধ্যপাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য এবং এই অঞ্চল যেন চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে ঢুকে না পড়ে সেজন্য সৌদি আরবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘খাশোগির ব্যাপারে আমার অবস্থান সুস্পষ্ট। আমি কখনই মানবাধিকারের প্রশ্নে চুপ থাকবো না। কিন্তু আমি সৌদি আরব যাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থে, মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের প্রভাব সংহত করার এটি একটি সুযোগ।’
বাইডেন সরাসরি বলেন, আমেরিকা যখন বিশ্বে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চীন ও রাশিয়ার সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত, সেখানে সৌদিদের অবজ্ঞা করলে আমেরিকার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে।
এ ছাড়াও তিনি বলেন, ‘এর সাথে এখন আমেরিকার স্বার্থ জড়িত। এই অঞ্চলে আমেরিকার নেতৃত্ব অক্ষত থাকুক আমি তা নিশ্চিত করতে চাই। এমন কোনো শূন্যতা যেন এখানে তৈরি না হয়, যেখানে রাশিয়া এবং চীন তা পূরণ করে ফেলে।’
এটা অনস্বীকার্য যে, গত ১৮ মাস ধরে হোয়াইট হাউজের সাথে সম্পর্ক শীতল হয়ে যাওয়ায় সৌদিরা চীন ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক বাড়িয়েছে। চীনের সাথে সৌদি আরবের ব্যবসা ক্রমাগত বাড়ছে। পুতিনের সাথে যুবরাজ সালমানের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ।
তাছাড়া, আমেরিকা অবজ্ঞা করলেও দেশের ভেতর ক্ষমতা সংহত করতে তাকে তেমন কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না। আমেরিকা চায় বা না চায় তিনিই যে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই দেশের বাদশাহ হচ্ছেন তা নিয়ে তেমন কোনো সন্দেহ আর নেই।
বাইডেন প্রশাসনের একাংশের মধ্যে বেশ কিছু দিন ধরেই যুবরাজ সালমান ও সৌদি আরব নিয়ে প্রেসিডেন্টের অবস্থানের পরিণতি নিয়ে অস্বস্তি তৈরি হচ্ছিল।
ইউক্রেন সঙ্কটের পর যুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়ায় অস্বস্তি বেড়ে যায়। বাইডেনও বুঝতে পারছেন বাড়তি সৌদি তেল এখন আমেরিকার জন্য জরুরি।
ওয়াশিংটনে গবেষণা সংস্থা মিডল-ইস্ট ইন্সটিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান কাটুলিস ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘ছেলেমানুষি কাটিয়ে বাইডেনের প্রশাসন অভিজ্ঞ হতে হতে শুরু করেছে। বিষয়টা এমন নয় যে আপনি এই ব্যক্তিকে (যুবরাজ সালমান) ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবেন। ফলে, জটিল এই পরিস্থিতি যতটা সম্ভব সামাল দিয়ে নিজের স্বার্থ দেখা ... মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার এমন নীতির ভুরিভুরি নজির রয়েছে।’
অর্থাৎ সৌদি আরবের ব্যাপারে আমেরিকার গতানুগতিক বিদেশ নীতির পথে ফিরে গেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, এর রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে তাকে।
আমেরিকাতে এখন সবার নজর শুক্রবার বাইডেন আর যুবরাজ সালমানের মধ্যে কথা কী হলো, তারা হাত মিলিয়েছেন কিনা অথবা বৈঠকে মুড কেমন ছিল- সেসব বিষয়ে।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একাংশ চায়, বাইডেন যেন সৌদি আরবে বিরোধীদের মুক্তির জন্য চাপ দেন। খাসোগজি হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা তোলেন। ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের জন্য চাপ দেন। নতুন করে অস্ত্র বিক্রির কোনো প্রতিশ্রুতি যেন না দেন।
এগুলো না করলে দলের ভেতর চাপে পড়বেন বাইডেন।
তার সমালোচকরা বলছেন, তিনি আবার প্রমাণ করছেন আমেরিকার ক্ষমতার রাজনীতির মূলে রয়েছে সম্পদ ও তেল। মানবাধিকারকে বিদেশ নীতির মূলে রাখার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন তা মিথ্যা প্রমাণিত করছেন। এরপর কীভাবে তিনি একনায়কদের সমালোচনা করবেন?
গত সপ্তাহে কংগ্রেসের সিনিয়র ডেমোক্র্যাট আ্যাডাম শিফ বলেন বাইডেনের জায়গায় থাকলে তিনি সৌদি আরবে এই সফর করতেন না বা যুবরাজ সালমানের সাথে দেখা করতেন না।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রকাশক ফ্রেড রায়ান এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বাইডেন এখন জেদ্দায় হাঁটু গেড়ে একঘরে মানুষটির রক্তে রঞ্জিত হাতে হাত মেলাবেন।’
একই পত্রিকায় খাশোগির বাগদত্তা হাতিস চেনগিজ একটি উপ-সম্পাদকীয়তে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘আপনি বিরোধীদের নির্যাতন করার জন্য, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের জন্য রাশিয়াকে নিন্দা করেন। সৌদি আরবও একই রকম ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। তাদের কেন আপনি ছাড় দিচ্ছেন? তেলের জন্য?’
গত দেড় বছর ধরে হোয়াইট হাউজের কাছ থেকে অবজ্ঞায় যথারীতি নাখোশ ক্ষমতাধর সৌদি যুবরাজ। সে কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধের পর পুতিনকে একঘরে করা আমেরিকার চেষ্টায় তেমন সাড়া দেয়নি সৌদি আরব। তেলের উৎপাদন কিছুটা বাড়িয়েছে কিন্তু বলার মতো তেমন নয়।
এপ্রিলে গবেষণা-ধর্মী সাময়িকী দি আটলান্টিকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বাইডেনের সাথে তার ঠাণ্ডা সম্পর্ক নিয়ে এক প্রশ্নে সৌদি যুবরাজের উত্তর ছিল- ‘আমার তাতে বিন্দুমাত্র আসে যায় না।’
তিনি বলেন, সৌদি আরবকে অবজ্ঞা করলে আমেরিকার জন্য তা হবে দুর্ভাগ্য এবং চীনের জন্য সৌভাগ্য।
গবেষণা সংস্থা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট অব নিয়ার ইস্ট পলিসির ডেনিস রস ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাকে বলেন, ‘সৌদি আরবে ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে কথা বলে তার মনে হয়েছে তাদের রাগ যে আমেরিকা কিছু চাইলে সাথে সাথে তারা সাথে সাথে ফোন করে, আমরা কিছু চাইলে তারা ফোনই ধরে না।’
গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের গবেষক ও সাবেক গোয়েন্দা জনাথন পানিকফ বিবিসিকে বলেন, ‘সৌদিরা বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে তাদের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা চায়। গত ১৮ মাস ধরে কেউই জানে না এই সম্পর্ক কোন দিকে যাবে। এটা একেবারেই সৌদি আরব পছন্দ করছে না।’
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সাথে শান্তি মীমাংসা শুরুতে সৌদি আরব রাজি হয়েছে কিন্তু বদলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে বাঁচতে শক্তিধর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চায়।
এই সফরের ঠিক আগের দিন ইসরায়েলি বাণিজ্যিক বিমানের জন্য তাদের আকাশপথ উন্মুক্ত করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সৌদি আরব। যার ফলে, তিনি হলেন প্রথম কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যিনি সরাসরি তেল আবিব থেকে সৌদি আরবে গেলেন।
কিন্তু সৌদি আরবের জন্য বাইডেনের এই সফরের গুরুত্ব প্রধানত রাজনৈতিক।
সফরে কী হয় তার চেয়ে বড় কথা তার দেশে এসে বাইডেন তার সাথে কথা বলছেন- এমন একটি ছবি যুবরাজ সালমানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরবকে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছামতো যেভাবে পরিবর্তন করতে চাইছেন তিনি বাইডেনের সফরকে তার একটি স্বীকৃতি হিসেবে দেখছেন সৌদি যুবরাজ। এরপর তিনি নিশ্চিতভাবে ভাবতে শুরু করবেন তাকে ও তার দেশকে অবজ্ঞা করা অমেরিকার পক্ষেও সম্ভব নয়। সূত্র- বিবিসি বাংলা।