আমি বন্দী হয়ে আছি: মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া রোহিঙ্গা কিশোরী

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ,বার্তা২৪.কম, সাউথ ইস্ট এশিয়া, ব্যাংকক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবিঃ সংগৃহীত 

ছবিঃ সংগৃহীত 

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের একটি ছোট বেডরুমের মেঝেতে পা ভাজ করে বসে আছে ১৪ বছরের একটি মেয়ে, ফাতেমা (ছদ্মনাম)। এই চোখের পানিও এখন শুকিয়ে গিয়েছে মেয়েটির৷ এই বেড রুমটি এখন তার জন্য একটি জেলখানা। যেখানে তার ৩৫ বছর বয়সী স্বামী তাকে প্রায় প্রতিরাতে ধর্ষণ করেন।

গত বছর এই রোহিঙ্গা মেয়েটি তার পরিবারকে বাঁচাতে নিজের জীবনকে বিসর্জন দেয়। জন্মভূমি মিয়ানমার থেকে এক বিপজ্জনক ভ্রমণ শেষে পৌঁছায় মালয়েশিয়ায়।  এটি এমন একটি দেশ যেটি সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। সে এমন এক ব্যক্তিকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়, যাকে আগে থেকে চিনতো না, দেখেওনি কখনও। 

বিজ্ঞাপন

এটা তার পছন্দ ছিল না। তার জীবনে যা কিছু ঘটেছে তার একটিও তার ইচ্ছায় হয়নি। তার পরিচিত জীবনকে পিছনে ফেলে আসাটাতেও তার হাত ছিল না। এই যে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে, সহবাস কোন কিছুতেই তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শুধু নিজেকে সঁপে দেয়া ছাড়া! 

মেয়েটি জানালো, তার পরিবার ছিল হতদরিদ্র, ক্ষুধার্ত এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়ে ভীত। ২০১৭ সালে মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। প্রতিটা দিন রাত ছিল আতঙ্কের। এমন অসহায় সময়ে মেয়েটির এক প্রতিবেশি তার পরিবারের কাছে একটি প্রস্তাব নিয়ে আসেন। প্রতিবেশি বলেন, একজন মালয়েশিয়ান পুরুষ মেয়েটিকে বিয়ে করে নিরাপদে মালয়েশিয়া নিয়ে যাবে। বিনিময়ে তার পরিবারকে ১৮ হাজার রিঙ্গিত (প্রায় ৪ লাখ টাকা) দিবেন এবং মেয়টি মালয়েশিয়া পৌছে  বিয়ের পর তার বাবা মা ও ছোট তিন ভাই বোনের জন্য খাবারের টাকাও পাঠাতে পারবেন৷ 

বিজ্ঞাপন

এরপর একদিন ফাতেমা চোখের জলে পরিবারকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ে মানবপাচারকারীদের গাড়িতে। যেখানে তার মতো আরও কিশোরি ছিল। 

ফাতেমা তখনো জানতো না তার জন্য সামনে কি অপেক্ষা করছে। শুধু জানতো তার রুগ্ন কাঁধের উপর নির্ভর করছে তার পরিবারে থাকা খাওয়া, বেঁচে থাকা। 

ফ্রান্স ভিত্তিক সংবাদ সংস্থ্যা, এ.পি. (এসোসিয়েট প্রেস) মালয়েশিয়ায় বিয়ের জন্য বিক্রি হওয়া রোহিঙ্গা কিশোরীদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ননা দিয়েছেন সাংবাদিক ক্রিস্টেন গিলেনিউ। 

প্রতিবেদক ফাতেমাকে দেখতে পান কুয়ালালামপুরের ওই ফ্ল্যাটটিতে বসে আছে। রোগা শরীরে একটি জামার সঙ্গে ঢোলা পাজামা পড়া। বেডরুমটিতে কোন ফার্নিচার নেই। সাদা দেয়ালের অনেক জায়গায় পলেস্তারা উঠে গেছে। ছাদ থেকে ঝোলানো বাচ্চাদের দোলনা। ফাতেমা যদি কোন সন্তান জন্ম দিতে পারে, তার জন্য এই দোলনা দিয়ে রেখেছে তার স্বামী। 

দূর্বল কন্ঠে ফাতেমা বললেন, ‘আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। কিন্তু আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। আমি একটা ফাঁদে আটকে আছি।’

মিয়ানমারে নিরাপত্তাহীনতা এবং বাংলাদেশের দুর্বিষহ শরণার্থী ক্যাম্প জীবন থেকে বাঁচতে অনেক রোহিঙ্গা কিশোরীই বাধ্য হচ্ছে টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়ায় বিয়ে করতে এবং সেখানে যেতে। যেখানে তাদের নিয়মিত শারীরিক লাঞ্চনা সয়ে যেতে হচ্ছে। এ.পি. এই ধরণের অপ্রাপ্তবয়স্ক ১২ জন রোহিঙ্গা কিশোরীর সঙ্গে কথা বলেছে। যাদের মধ্যে সর্বনিম্ন একজনের বয়স ১৩ বছর। 

ক্রিস্টেনের স্বাক্ষাৎকার নেয়া সব মেয়েই জানিয়েছেন তাদেরকে স্বামীরা বন্দী করে রেখেছেন। ঘরের বাইরের আলো তারা হঠাৎ হয়তো কোনদিন দেখতে পারেন। অনেকেই জানিয়েছেন, তারা মানবপাচারকারীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মালয়েশিয়ার আসার পথে ধর্ষনের শিকার হয়েছেন। তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জন অভিযোগ করেছেন, তাদের স্বামীরা তাদের নির্যাতন ও ধর্ষন করেন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক কিশোরী ইতিমধ্যে বাচ্চা জন্ম দিয়েছেন। তবে সকলেই জানিয়েছেন, তারা কেউই মা হওয়ার জন্য উপযুক্ত অবস্থায় নেই। 

এই মেয়েদের কারোর পক্ষেই তাদের বিয়েতে নিজেদের মতামত দেয়ার অবস্থা ছিল না। তাদের সবকিছু মেনে নিতে হয়েছে।

১৬ বছরের নাসরিন (ছদ্মনাম) বলেন, এটাই ছিল আমার পালিয়ে বেঁচে থাকার এক মাত্র উপায়। ২০১৭ সালের স্মৃতি এখনো তাকে তাড়া করে। যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়, তার প্রতিবেশিকে ধর্ষন করে, তার খালাকে মেরে জখম করে। 

নাসরিন বলেন, ‘তখন সেনাবাহিনী প্রতিরাতে এতো গুলি করতো যে আমার বন্ধুরা দিনের বেলা বেলুন ফু্টানোর শব্দ করলেও আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তু ছিলাম না, কিন্তু এছাড়া আমার আর কোন উপায়ও ছিল না।’  

এখন ২৭ বছর বয়সী একজন স্বামীর ফাঁদে পড়ে আছে৷ সে বা তার পরিবারের কেউই জানে না, এই ফাঁদ থেকে সে কখনো মুক্তি পাবে কিনা! 

'সুখী হওয়ার মতো রোহিঙ্গাদের জন্য কোন জায়গা এই পৃথিবীতে নেই,' দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নাসরিন।

এই ধরনের অনিচ্ছাকৃত বিয়ে রোহিঙ্গা কিশোরীদের জন্য নতুন এক বিষাদ। জন্মের পর থেকেই তারা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে৷ সেখানে নিজেদের ইচ্ছা বা স্বপ্ন বলে কিছু নেই। রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর উদাসীনতা এবং কঠোর অভিবাসন নীতি এই রোহিঙ্গা কিশোরীদে জন্য কোন আশা বাকি রাখেনি। তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া যেমন অনিশ্চিত, তেমনি বাংলাদেশেও কাজ করে খাওয়ার কোন উপায় নেই। আবার কোন দেশও বড় সংখ্যক রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব দিচ্ছে না।

তাই রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের পালানোর হার বেড়েছে। জাতিসংঘের শরনার্থী সংস্থ্যার (ইউএনএইচসিআর) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে রোহিঙ্গারা যখন নৌকায় আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া পৌছে তার বেশিরভাগই ছিল পুরুষ। কিন্তু অন্তত গত ২ বছরে আন্দামান সাগরে ভাসা নৌকায় ৬০ ভাগেরও বেশি রোহিঙ্গা নারী। 

আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাল্য বিবাহের হার বেড়েই চলছে। সংস্থাটির রিজিওনাল এডভোকেসি এবং ক্যাম্পেইন ডিরেক্টর শাহীন চুগতাই জানান, ক্যাম্পে শিশু পাচারের সংখ্যাও বাড়ছে। যার মধ্যে বেশি বিপদগ্রস্ত কণ্যা শিশুরা।