অবিশ্বাস্য বদলে বিশ্বসেরার পথে এয়ার ইন্ডিয়া
কয়েক দশক ধরে কম বিনিয়োগের পর ভারতের বেসরকারিকরণ করা ৯২ বছরের পতাকাবাহী এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মীদের গড় বয়স ৫৪ বছর। এয়ারলাইন্সের ইমেইল সিস্টেম এত পুরাতন ছিল যে কর্মীরা জিমেইল ব্যবহার করতে শুরু করেন। এটিই এয়ার ইন্ডিয়া।
অথচ ৭০’র দশকে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা শাসক লি কুয়ান ইউ এয়ার ইন্ডিয়ার সেবা দেখে বলেছিলেন, তিনি তার দেশে এই ধরনের একটি রাষ্ট্রায়ত্ব এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠা করতে চান। সেই সেবার মান নিয়ে সেরার তালিকায় থাকা এয়ার ইন্ডিয়ার মান কমে ক্ষয়িঞ্চু হতে হতে একটি রুগ্ন এয়ারলাইন্সে পরিণত হয়। হাজার হাজার কোটি রুপির লোকসান নিয়ে পরবর্তীতে লোকসানি প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেয় ভারতীয় সরকার। ২০২১ সালের অক্টোবরে তা কিনে নেয় টাটা গ্রুপ। সম্পদশালী টাটা পরিবার পুনরায় এয়ার ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টাটার চেয়ারম্যান নটরাজন চন্দ্রশেখরন স্পষ্ট করে বলেন, আমাদের লক্ষ্য প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বসেরা এয়ারলাইন্স হিসেবে গড়ে তোলা।
এরপর টাটা এয়ার ইন্ডিয়ার সিইও নিয়োগ দেয় ক্যাম্পবেল উইলসনকে। এখানে যোগদানের আগে ক্যাম্পবেল সিঙ্গাপুরের লো-কস্ট এয়ারলাইন স্কটে কাজ করেছেন। ৫ বছরের টার্ন অ্য্যারাউন্ড প্রকল্পের অধীনে এয়ার ইন্ডিয়ার সেই হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। এরই মধ্যে ৪৭০টি নতুন উড়োজাহাজ অর্ডার করেছে। নতুন করে ৫ হাজার কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে, যাদের গড় বয়স ৫৪ থেকে ৩৫ এ নামিয়ে আনা হয়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়াকে ঢেলে সাজাতে গত কয়েক বছরে টাটা গ্রুপ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ইতোমধ্যে ৪৭০টি নতুন উড়োজাহাজের কেনার অর্ডার ছাড়াও কেবিন আধুনিকায়ন, যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন করা হয়েছে।
৫ বছরের পরিকল্পনায় এয়ার ইন্ডিয়া দেশের অভ্যন্তরীণ মার্কেটে ব্যাপক প্রবৃদ্ধির আশা করছে, যেখানে বছরে প্রায় ১৪৫ মিলিয়ন যাত্রী রয়েছে। টাটার প্রাথমিক অগ্রাধিকার হচ্ছে তাদের পুরাতন উড়োজাহাজগুলোকে বহর থেকে বিদায় করা। কারণ কয়েক দশক ধরে এসব উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ উপেক্ষিত ছিল। মালিকানা নেওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়া লিজের মাধ্যমে ৩৬টি উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত করে, এর মধ্যে ১১টি বোয়িং ৭৭৭ ও ২৫টি এয়ারবাস এ৩২০ ছিল। এসব উড়োজাহাজের মাধ্যমে এয়ারলাইন্সটি নতুন ৬টি নতুন আন্তর্জাতিক রুট চালু করে। এছাড়া ২৪টি রুটে ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
এয়ার ইন্ডিয়া সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করেছে উড়োজাহজা কিনতে। ৪৭০টি উড়োজাহাজের জন্য এয়ারলাইন্সটি ৭০বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে। এসব উড়োজাহাজের মধ্যে থাকছে এ৩২০নিওস ১৪০টি, এ৩২১নিওস ৭০টি এবং ১৯০টি বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স।
বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাটার মতো এত বিশাল সম্পদশালী একটি কোম্পানি এটি কিনে নিয়েছে বলেই এত বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। আগামীতে এর ভবিষ্যৎ কি তা এখনই বলা কঠিন। তবে টাটা যেভাবে পরিকল্পনা মাফিক বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করে এগিয়ে যাচ্ছে তার কোনো বিকল্প ছিল না। ডুবন্ত এই এয়ারলাইন্সকে টেনে তুলতে এটিই সেরা বিনিয়োগ।
এয়ার ইন্ডিয়ার সাবেক নির্বাহী পরিচালক জিতেন্দার ভার্গব বলছেন, টাটা এয়ার ইন্ডিয়া কেনার পর সত্যিকার অর্থে এর লক্ষ্যণীয় উন্নতি চোখে পড়বে ২০২৭ সালে। আর সত্যি বলতে এটি টি২০ ক্রিকেট নয়। ব্র্যান্ড ইমেজ পুনরুদ্ধার, প্রযুক্তি, সেবা এবং নতুন উড়োজাহাজ অধিগ্রহণ করতে সময় লাগবে।
হার্দি প্যাটেল নামে আরেক ট্রাভেল কিউরেটর বলছেন, ঋণ জর্জরিত, লোকসানি একটি এয়ারলাইন্সকে টেনে তুলতে সময় দিতে হবে। আর টাটা সমালোচনা ও কর্মীদের অস্থিরতা সত্বেও তাদের লক্ষ্যে অবিচল রয়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়ার সিইও বলেন, অধিগ্রহণের মাধ্যমে এয়ার ইন্ডিয়া ৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী দক্ষ উড়োজাহাজ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। এয়ারলাইন্সটি কেবিনের অভ্যন্তরীণ সংস্কার করে বিদ্যমান বহরের শ্রীবৃদ্ধি করতে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করছে। অনবোর্ড পরিষেবাও উন্নত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ দূরত্বের ফ্লাইটে প্রিমিয়াম ইকোনমি আসন চালু এবং নতুন ফুড মেনু প্রবর্তন।
এয়ার ইন্ডিয়ার লক্ষ্যমাত্রা
ভারতই একমাত্র দেশ যাদের জনসংখ্যা আগামীতে চীনকে ছাড়িয়ে যাবে। আর এদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটছে। যে কারণে উচ্চবিত্তই শুধু নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকাশপথে ভ্রমণের চাহিদা বাড়ছে। গেল দশকে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স এই চাহিদার সদ্ব্যব্যবহার করে দেশের বৃহৎ এয়ারলাইন্সে পরিণত হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক গন্তব্যেও তারা ভালো করছে। যখন টাটা এয়ার ইন্ডিয়াকে কিনে নেয় তখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের মার্কেট ২৫ শতাংশ মাত্র।
এরই মধ্যে টাটা শুধুমাত্র বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে প্রযুক্তি খাতে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এয়ারবাস এ৩৫০-৯০০ উড়োজাহাজ দিয়ে ঢাকা-মুম্বাই রুটে নতুন করে সূচি তৈরি করছে। একই সাথে ভিস্তারাকে এয়ার ইন্ডিয়ার সাথে একত্রীকরণ আরেকটি মাইলফলক হবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর ফলে এয়ার ইন্ডিয়া সত্যিকার অর্থে ওয়ার্ল্ড ক্লাস এয়ারলাইনে পরিণত হবে। আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়ার লক্ষ্য ৩০ শতাংশ মার্কেট দখল করার (অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক)।
এয়ার ইন্ডিয়া প্রতি ৬ দিনে একটি করে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত হচ্ছে বহরে। সুতরাং এটি দেখেই যে কেউ বুঝতে পারবেন কত দ্রুততার সাথে এয়ারলাইন্সটির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের নতুন হাব নইডা বিমানবন্দর
ভারত যে শুধু বিশ্বমানের এয়ারলাইন্সের দিকে নজর দিচ্ছে তা-ই নয়। এর সাথে তাল মেলাতে প্রয়োজন বিশ্বমানের বিমানবন্দর। আর সেই লক্ষ্যে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিকল্প আরেকটি হাব তৈরি করা হচ্ছে। নইডা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর থেকে তিন গুণের বেশি যাত্রী পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। এর নির্মাণ কাজ শেষ হলে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরের বিকল্প হিসেবে আভির্ভূত হবে। এটি উত্তর প্রদেশের গৌতম বুদ্ধ নগর জেলায় অবস্থিত। এটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে তৈরি হচ্ছে। ২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিমানবন্দরের পরিচালনায় যুক্ত ফ্লুগফেন নইডা নির্মাণের কাজ জিতে নেয়। তারা ৪০ বছর বিমানবন্দরটি পরিচালনা করবে। নতুন এই বিমানবন্দর নির্মাণ ও ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ করতে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ খরচ হচ্ছে।
বিমানবন্দরটিতে যেতে ভারতের ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্রিনফিল্ড হাইওয়ে নির্মাণ করছে। শুরুতে বিমানবন্দরে দুটি রানওয়ে হবে এবং এটি ৮টি রানওয়েতে উন্নীত করার মতো জায়গা রাখা হয়েছে। শুরুতে নইডাতে বছরে এক কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে এবং তা ১২ কোটি যাত্রী সেবা পর্যন্ত উন্নীত করা হবে।
শঙ্কা যেখানে
তবে এতকিছুর পরেও এয়ার ইন্ডিয়া নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। এতসব সুখবরের পরেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এয়ার ইন্ডিয়াকে সফল করতে এসব বিনিয়োগ একটি ভিত্তি হিসেবে সাহায্য করবে, তবে এয়ারলাইন্সটি যাত্রীদের কাছে নির্ভরযোগ্য এবং সময়নিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হতে না পারলে পরিবর্তনগুলো খুব বেশি কাজে আসবে না। সর্বোপরি এয়ারলাইন্সটিকে অন টাইম ফ্লাইটের বিষয়ে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে, নতুবা একবার যদি যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আস্থা ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন ও দুরূহ হবে।