রাম মন্দির ইস্যু গ্রহণ করেননি উত্তর প্রদেশের ভোটাররা
২০১৪ সাল থেকে টানা ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবার ‘রামমন্দির’ ইস্যু করে নির্বাচনি বৈতরণী পার করতে চেয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার (৪ জুন) ভারতের ১৮তম লোকসভার নির্বাচনের ফলাফল বলে দিচ্ছে, বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাম মন্দির ইস্যু ভারতের জনগণ বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের ভোটাররা সেটা গ্রহণ করেননি।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন বিজেপির জন্য এক ধাক্কা হিসেবে কাজ করেছে ‘ইন্ডিয়া’ (ইন্ডিয়ান ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) জোট।
রাম মন্দির ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় অবস্থিত। সেই উত্তর প্রদেশেই এখন পর্যন্ত ‘ইন্ডিয়া’ জোট থেকে পিছিয়ে এনডিএ জোট। উত্তর প্রদেশে ‘ইন্ডিয়া’ জোট এগিয়ে আছে ৪০টি আসনে। এনডিএ জোট এগিয়ে আছে ৩৯টি আসনে এবং অন্যান্য ১টি আসনে এগিয়ে।
শুধু তাই নয়, উত্তর প্রদেশের অযোধ্যাতে রাম মন্দির অবস্থিত। এই অযোধ্যাতেই সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী অবধেশ প্রসাদ এগিয়ে রয়েছেন। পিছিয়ে আছেন বিজেপির প্রার্থী লাল্লু সিং। ২০১৮ সালে ফৈজাবাদ জেলার নতুন নামকরণ করা হয় ‘অযোধ্যা’। তবে লোকসভার এই আসনটিকে এখনো ‘ফৈজাবাদ’ বলা হয়।
- একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পিছিয়ে বিজেপি, মোদির পদত্যাগ দাবি
- এনডিএ জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও দূর্গে ধস বিজেপির
- এনডিএ জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও দূর্গে ধস বিজেপির
- বিশ্ব রেকর্ডে ভারতের লোকসভা নির্বাচন
অযোধ্যার রাম মন্দির নির্মাণকাজসহ যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব ছিল ‘শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট’-এর কাঁধে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই ট্রাস্ট নির্মাণ করা হয়। এই ট্রাস্টে রাম মন্দির নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজে মোট সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা অনুদান জমা পড়ে আর কেবলমাত্র রাম মন্দির নির্মাণের জন্যই খরচ বরাদ্দ করা হয় ১ হাজার ৮শ কোটি টাকা।
চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি রাম মন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে নরেন্দ্র মোদি ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, অতীতে নিশ্চয়ই আমাদের কিছু খামতি ছিল। তাই রামমন্দির হয়নি। আজ সেই খামতি দূর হয়েছে বলে রামমন্দির হয়েছে। এটা রাষ্ট্রচেতনার মন্দির।
তিনি বলেন, এটাই সময়, ঠিক সময়। ভারতে এখন দেশে হতাশার কোনো স্থান নেই। রামই হলেন ভারতের ভিত্তি, ভারতের আস্থা।
মঙ্গলবারের উত্তর প্রদেশের নির্বাচনি ফলাফল বলে দিচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির সেই বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ভোটাররা।
অযোধ্যায় রাম মন্দিরে 'প্রাণ প্রতিষ্ঠা'র দিন ঘোষণা হওয়ার অনেক আগে থেকেই ভারতের রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছিল রাম মন্দির উদ্বোধনের সময় এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে, যা থেকে কয়েক মাস পরের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে।
রাম মন্দির উদ্বোধনের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, এতেই দেখা যাচ্ছে যে, কেউই কিন্তু ধর্মটাকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করতে পারছেন না। ভারতীয় রাজনীতিতে এই একটা বড় পরিবর্তন এনেছে বিজেপি। কোনো দলই ধর্ম বাদ দিয়ে রাজনীতি করতে পারছে না অথচ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রটা তো সেক্যুলার।
জেপি নেতা অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বিবিসিকে একইভাবে বলেছিলেন, যে আন্দোলনের পুরোভাগে লাল কৃষ্ণ আদভানি থেকেছেন, বিজেপির সব স্তরের নেতারা থেকেছেন, সেটা এতদিনে অর্জন করা গেছে। আমরা সেই আন্দোলন কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে করিনি। যে মন্দির প্রতিষ্ঠার আবেগ ছিল মানুষের মধ্যে, আমরাও কোটি কোটি মানুষের সেই আবেগকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে এবং ভারতের অস্মিতাকে মর্যাদা দিতে এটা করেছি।
এ থেকে যদি আমাদের রাজনৈতিক সুবিধা হয়, হয়ে যেতেই পারে, তাহলে আমাদের তো কিছু করার নেই।
শুভাশিস মৈত্র বলছিলেন, রাম মন্দির নিয়ে মানুষের আবেগ যে আছে, বিশেষত হিন্দি বলয়ে সেটা ঘটনা। একাধিক সমীক্ষায় এটা উঠে এসেছে যে, এমন বহু মানুষও রাম মন্দির চেয়েছেন, যারা বিজেপিকে ভোটও দেন না। তাই, রাম মন্দিরের আবেগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিজেপি যে কাজে লাগাবে, তা খুব আশ্চর্যের কিছু নয়।
হিন্দি বলয়ে যে অবস্থা এখন বিজেপির ভোট শেয়ারের, তাতে সেই ভোট ধরে রাখতে হবে বিজেপিকে। কারণ, দক্ষিণ ভারতে কিন্তু বিজেপির অবস্থা কিছুটা নড়বড়ে।
তিনি বলেন, হিন্দি বলয়ের নানা রাজ্যে আবার বিরোধী দলগুলোও কিন্তু কিছুটা শক্তিশালী। তাই, লোকসভা নির্বাচনে জিততে হিন্দি বলয়ের ভোট বাড়াতে না পারুক, ধরে রাখা বিজেপির জন্য জরুরি। তাই, ওই অঞ্চলের মানুষের আবেগকে তারা কাজে লাগাচ্ছে।
এদিকে, বাংলাদেশের একটি নিউজপোর্টাল থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, নির্বাচনের কয়েক মাস আগে তড়িঘড়ি করে রামমন্দির উদ্বোধন ভোটে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে!
এ বিষয়ে তখন নিউজপোর্টালটিকে ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘কিছুদিন পরই ভারতে পার্লামেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে। অযোধ্যার ঘটনা নিঃসন্দেহে ভারতের ভোটারদের বড় একটি অংশ বিজেপিকে আকর্ষণ করবে। এমনিতেই নানান হিসাবে নরেন্দ্র মোদির সরকার আবার জিতে আসবে। অযোধ্যার ঘটনা ধর্মীয় ব্যাপার। কিন্তু এখানে রাষ্ট্র, রাজনীতিকে যুক্ত করতে পেরেছে বিজেপি, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে এই ইস্যু দারুণভাবে কাজে লাগাবে ক্ষমতাসীন বিজেপি। এমনিতেই বিজেপির অবস্থান এখন ভালো। রামমন্দির প্রতিষ্ঠা নরন্দ্রে মোদিকে শক্তিশালী করবে।’
তিনি বলেন, ‘ভারতে ক্ষমতায় যেতে এখন ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হয় না। তার চেয়ে অনেক কম ভোট পেয়ে বিজেপি ক্ষমতায়। ৩৪ থেকে ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজেপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে যাচ্ছে। এবারও তাই পাবে বলে মনে করি। কারণ বিরোধী শিবিরের ৭০ শতাংশ ভোট নানানভাবে বিভক্ত।’
ভারতে আগে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের তেমন সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু এখন সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এতে অনেক জনগণ বিজেপির প্রতি আকৃষ্ট হবে।’
ভারত এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সে বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে ভারতের ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন। সেইসঙ্গে বলা যেতে পারে, রাম মন্দির ইস্যুতে বিজেপি রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারেনি, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের হিন্দি বলয়ের ভোটাররা।
মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ৪৮ মিনিট পর্যন্ত ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ৫শ ৪৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স) পেয়েছে, ২শ ৯৫টি আসন এবং জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ (ইন্ডিয়ান ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) জোট পেয়েছে ২শ ৩০টি আসন।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে‘ইন্ডিয়া’ জোট পেয়েছিল ৮০টি আসন। ২০১৯ সালের নির্বাচনের তুলনায় ‘ইন্ডিয়া’ জোট অনেকটাই ভালো ফলাফল করেছে।
ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা শুরু হয়েছে মঙ্গলবার (৪ জুন)। ১৯ এপ্রিল শুরু হয়ে সাত দফায় ১ জুন শেষ হয় এ নির্বাচন।
এবারের ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৭ কোটি। এর মধ্যে ২১ কোটি তরুণ। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, এবার লোকসভা নির্বাচনে ৬৪.২ কোটি ভোটার ভোটে অংশ নিয়েছেন।