হাসান নাসরুল্লাহর উত্থান যেভাবে
ইরান মদতপুষ্ট লেবাননের শিয়াপন্থী রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর কোমর ভাঙতে উঠে পড়ে লেগেছে ইসরায়েল। তাতে বড় সাফল্যও পেয়েছে ইহুদি রাষ্ট্রটি। শিয়াপন্থী এই সশস্ত্র সংগঠনের প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সেনারা।
শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল দানিয়েল হাগারি এই কথা জানিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘হাসান নাসরুল্লাহ নিহত’।
ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) থেকেই ৬৪ বছরের হিজবুল্লাহ প্রধানের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পৃথক একটি পোস্ট করেছে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ।
এক্স হ্যান্ডেলে আইডিএফ লিখেছে, হাসান নাসরুল্লাহ আর কখনওই বিশ্বকে সন্ত্রাসবাদের ভয় দেখাতে পারবেন না। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে তার মৃত্যু হয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরেই প্রতিবেশী দেশটির পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তে মারাত্মক বোমাবর্ষণ চালিয়েছে ইহুদি বিমান সেনা। বাদ যায়নি রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ অংশ। এই এলাকাগুলো হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত।
লেবাননের রাজনীতিতে নাসরুল্লাহর প্রভাব ছিল প্রশ্নাতীত। পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির জনগোষ্ঠীর একাংশের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বা সংঘর্ষের সময়ে মধ্যস্থতা করা, দু’টি ক্ষমতাই ছিল নাসরুল্লাহর।
দক্ষিণ বৈরুতে ইসরায়েলি বিমান সেনার ভয়ানক বোমাবর্ষণে নাসরুল্লাহর কন্যা জায়নাবের মৃত্যু হয়েছে বলেও দাবি করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। যদিও লেবানন বা হিজবুল্লাহর তরফে এই নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
ইসরায়েলি সেনার হাতে শিয়াপন্থী এই জঙ্গিনেতার মৃত্যুর খবর এবারই যে প্রথম এল এমনটা নয়। ২০০৬ সালে ইসরায়েল-লেবানন যুদ্ধের সময়েও তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছিল। কিন্তু সংঘর্ষ থামতেই গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসেন নাসরুল্লাহর। তার গায়ে যে ইহুদিরা আঁচড়টি কাটতে পারেনি, তা তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
প্রায় তিন দশক (প্রায় ৩২ বছর) ধরে ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান কর্তা ছিলেন হাসান নাসরুল্লাহ। সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেলের পদ সামলাতেন তিনি।
১৯৬০ সালে দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় হাসান নাসরুল্লাহ। ছোটবেলায় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। হিজবুল্লায় যোগ দেওয়ার আগে জড়িয়ে পড়েন শিয়াদের আন্দোলনে।
শিয়াদের আন্দোলন চলাকালীন আধা সামরিক সংগঠনে যোগ দেন নাসরুল্লাহ। এর পর বিদ্যুৎ গতিতে উত্থান হতে থাকে তার। ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নাসরুল্লাহ তৈরি হলে সশস্ত্র সংগঠনের শীর্ষপদে চলে আসেন তিনি।
১৯৯৭ সালে নাসরুল্লাহকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করে আমেরিকা। তখন এই সংগঠনের প্রধান ছিলেন নাসরুল্লাহ। ওই সময়ে সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছিল তার।
নাসরুল্লাহর জন্মদাতা ইরানি সেনাবাহিনী ১৯৮২ সালে এই সংগঠনের যোদ্ধাদের লেবাননে পাঠিয়েছিল। ওই বছরে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় পশ্চিম এশিয়ার এই দেশ। হিজবুল্লাহকে দিয়ে ইহুদি সেনাকে পাল্টা মার দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল ইরান।
২০০০ সালে প্রায় ১৮ বছর পর দক্ষিণ লেবাননের দখল করা এলাকা থেকে বাহিনী সরিয়ে নেয় ইসরায়েল। ইহুদিদের এতে রাজি করানোর পিছনে নাসরুল্লাহর বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।
এর ছ’বছরের মাথায় ২০০৬ সালে ফের ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় হিজবুল্লাহ। যা ৩৪ দিন ধরে চলেছিল। ওই সংঘর্ষের কোনও জয়-পরাজয় হয়নি। ফলে একে ‘ঐশ্বরিক বিজয়’ বলে মনে করে এই সংগঠন। যার নেপথ্যে নাসরুল্লাহর মস্তিষ্কই কাজ করেছিল বলে দাবি গোয়েন্দাদের।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের ওপর ভয়ঙ্কর হামলা চালায় ইরান সমর্থিত হামাস নামের আরেক সশস্ত্র সংগঠন। ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালায় তারা। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েক জনকে অপহরণ করে গাজায় নিয়ে যায় হামাসের সদস্যরা।
ওই ঘটনার পর হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গাজায় সংঘর্ষ শুরু হতেই ইহুদিদের বেকায়দায় ফেলতে তাদের সেনা ঘাঁটিতে লেবাননের দিক থেকে হামলা শুরু করে হিজবুল্লাহ।
চলতি বছরের ১ আগস্ট শিয়া জঙ্গি সংগঠনের প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ বলেন, আমাদের এখন প্যালেস্টাইনবাসীর পাশে দাঁড়াতে হবে। সেখানকার জনগণকে রক্ষার জন্য আমাদের মূল্য দিতে হবে।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ চলাকালীন নাসরুল্লাহ আরও দাবি করেন, ইহুদিরা যুদ্ধ বন্ধ না করলে কোনও অবস্থাতেই হিজবুল্লাহ পিছু হটবে না। বরং ইসরায়েলের ওপর হামলা অব্যাহত থাকবে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর বৈরুতে ইহুদি বিমান সেনার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হিজবুল্লাহর দুই কমান্ডারের মৃত্যু হয়। এবার নাসরুল্লাহর সঙ্গে আলী কারাকে নামের আরও এক কমান্ডারের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এই যোদ্ধা দক্ষিণ ফ্রন্টে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, এভাবে একের পর এক নেতা ও কমান্ডারকে হত্যার মাধ্যমে হিজবুল্লাহকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে ইসরায়েল। এবার লেবাননে আইডিএফ গ্রাউন্ড অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে স্পষ্ট করেছেন ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।