জেলেনেস্কির ‘বিজয় পরিকল্পনা’ থমকে গেল যে কারণে!

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনেস্কি ১২ অক্টোবর ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর কাছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ‘বিজয়ের পরিকল্পনা’ পেশ করেন। জার্মানির রামস্টেইনে মার্কিন এয়ার ফোর্সের ঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর নিয়মিত বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এসময় উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে জেলেনেস্কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছেও তার ‘বিজয় পরিকল্পনা’ পেশ করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

এরপর হোয়াইট হাউস জেলেনেস্কির পরিকল্পনার বিষয়ে মন্তব্য করেছিল, জেলেনেস্কির পরিকল্পনায় এগিয়ে যাওয়ার ইতিবাচক পদক্ষেপ রয়েছে।

জেলেনেস্কি যে সময় পাশ্চাত্যের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কাছে ‘বিজয় পরিকল্পনা’ তুলে ধরছেন, তখন রাশিয়া ধীরে ধীরে ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে অগ্রসরমান। ইউক্রেনের সৈন্যদের নিজ দেশের অঞ্চল পুনরুদ্ধারে তীব্র লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছিল।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, জেলেনেস্কি মোট ৫টি পয়েন্টে তার বিজয় পরিকল্পনা ১২ অক্টোবর পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কাছে তুলে ধরেন। এর মধ্যে তিনটি পয়েন্ট ছিল অতি গোপনীয়।
তবে পাশ্চাত্যের দেশগুলো জেলেনেস্কির পরিকল্পনায় উদ্বেগও প্রকাশ করেছে বলে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এক প্রতিবেদনে জানায়।

কারণ হিসেবে যা বলা হয়, তা হচ্ছে, ২০২৩ সালের সামার থেকে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।

জেলেনেস্কির পরিকল্পনায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করতে। তিনি চেয়েছিলেন, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী পাশ্চাত্যের উন্নত অস্ত্র দিয়ে রাশিয়াকে পরাজিত করে চাপে রাখতে পারবে। এতে করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে শান্তি আলোচনার জন্য বাধ্য করতে পারবে ইউক্রেন।

সে কারণে জেলেনেস্কি পাশ্চাত্যের কাছে বেশি দূরত্বে হামলা করতে সক্ষম এমন ক্ষেপণাস্ত্র চেয়েছিলেন, যাতে করে রাশিয়ার অত্যন্ত ভেতরে হামলা করতে সক্ষম।

এছাড়াও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৬ জেট ও পেট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স পেতে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কাছ থেকে সহযোগিতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ন্যাটোভুক্ত পাশ্চাত্যের দেশগুলো মনে করছে, জেলেনেস্কির এ ধরনের অস্ত্রের সরবরাহ করা অবাস্তব।

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থান

জেলেনেস্কির এ প্রত্যাশার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বরং কৌশলগত অবস্থান নিয়েছেন। তিনি সরাসরি জেলেনেস্কিকে পেট্রিয়ট ও এফ-১৬ জেট দিতে যেমন অস্বীকার করেননি, তেমনি এখনি তা সরবরাহ করবেন, এমন কথাও বলেননি।

বরং জো বাইডেন জেলেনেস্কিকে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন এবং সেইসঙ্গে তিনি এটাও বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত পরবর্তী প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ফলে ভোলোদিমির যেমনটা চিন্তা করে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর কাছে তার রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন, তা একেবারে থমকে গেলই বলে মনে হচ্ছে।

এই থমকে যাওয়াটা ইউক্রেনের জন্য বড় একটি হোঁচটও বলা চলে। কারণ, ইতোমধ্যে ইউক্রেনের কৌশলগত অনেক অঞ্চল রাশিয়া দখল করে নিয়েছে।

এছাড়া তারা ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো মনে করছে, ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও এফ-১৬ জেট দিলে সে অঞ্চলে যুদ্ধের আরো বিস্তৃতি ঘটতে পারে। এতে করে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

শুধু তাইই নয়, রাশিয়ার একেবারে নাকের ডগায় ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে নিলে রাশিয়া সেটিকে মেনে তো নেবেই না, সেইসঙ্গে রাশিয়া আরো যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠবে। এর আগে রাশিয়া পারমাণবিক যুদ্ধের হুঁশিয়ারিও দিয়েছিল পাশ্চাত্যের দেশগুলির প্রতি।

বিশ্লেষকদের বক্তব্য

এদিকে, বিভিন্ন বিশ্লেষকদের বক্তব্যে জানা যায়, জেলেনেস্কির রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ের পরিকল্পনা নিয়ে বাইডেন প্রশাসন এখনি কিছু করতে চাইছে না। বিষয়টিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী সময়ের রেখে দিতে চেয়েছেন, কোনো ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে।

এমনকি মার্কিনি ভোটারদের মুখোমুখিও হতে চাইছে না এ বিষয়টিকে নিয়ে। সে কারণে চলতি বছরের ৫ নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে বিজয়ী পরবর্তী প্রেসিডেন্টের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কৌশল নিয়েছেন জো বাইডেন।

এ বিষয়ে স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট অ্যান্ডুজ-এর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক ফিলিপস ও’ব্রিয়েন বলেন, ‘তারা (মার্কিন প্রশাসন এবং ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো) এখনি জেলেনেস্কির প্রত্যাশা পূরণে তেমন কিছু করার আগ্রহ দেখায়নি। বরং তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী প্রশাসনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। কারণ এটাতে কৌশলগত ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। এ কৌশল ডেমোক্র্যাটদের জন্য ওয়াশিংটনে ‘টিকে থাকা না থাকার মতো’ অবস্থায় দাঁড় করাতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্দেশনা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য উপযুক্ত বলেই মনে হয়েছে। কারণ, হিসেবে তারা বলছেন, ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও এফ-১৬ জেট সরবরাহ করা মানে পারমাণিক শক্তিধর রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতোই অনেক বেশি ঝুঁকি নেওয়া।

সেইসঙ্গে তারা আরো বলছেন, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন, সে বিষয়টি এখনো অজানা।

ফিলিপস ও’ব্রিয়েন বলেন, ইউরোপীয়ান কাউন্সিল থেকে ফিরে জেলেনেস্কি মন্তব্য করেছেন, হোয়াইট হাউসের প্রতিক্রিয়ার জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন।

সাবেক ব্রিটিশ ট্যাংক কমান্ডার ও কৌশলগত পরামর্শক ফার্ম সিবিলাইনের প্রধান জাস্টিন ক্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি, জনগণ (ইউক্রেন) যুদ্ধ জয়ের আরো বিস্তারিত কার্যকর পরিকল্পনা চায়’।

তিনি বলেন, ‘এটাই হচ্ছে, জনগণের মতামত। তারা এমন একটি বিস্তারিত ও আরো কার্যকরী পরিকল্পনা চায়, যা দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভ করা যায়।’

ভোলোদিমির জেলেনেস্কির রাশিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ জয়ের পরিকল্পনার বিষয়ে খোদ ইউক্রেনের বিশ্লেষকদেরই সমালোচনা রয়েছে। তারা জেলেনেস্কির যুদ্ধ জয়ের পরিকল্পনাকে ‘মার্কেটিং প্রসেস’ (বিপণন কৌশল) হিসেবে বিবেচনা করছেন।

এ প্রসঙ্গে ইউক্রেনের থিংকট্যাংক ‘কাম ব্যাক অ্যালাইভ সেন্টার অব ইনিশিয়েটিভস’-এর ব্লিশেষক হলিব ভোলোস্কি বলেন, ‘এই ধরনের যুদ্ধ জয়ের জন্য নিজের সে শক্তি থাকা দরকার, যা দিয়ে শত্রুপক্ষকে বিধ্বস্ত করে দেওয়া যায়। সেই দিকটি থাকলে যুদ্ধের শেষপর্যন্ত টিকে থেকে জয়লাভ করা যায়। সেটি আসলে ইউক্রেনের নেই। যা আছে, তা অন্যের শক্তির ওপর নির্ভরতা’!

এদিকে, যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনেস্কি তার রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত, তখন ১ অক্টোবর ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় খনিসমৃদ্ধ পাহাড়ি শহর ভুহলেদার দখল করে নিয়ে নেয় রাশিয়ার সেনাবাহিনী।

এ শহর ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের হাব হিসেবে কাজ করে। এ শহর থেকেই ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার ওপর হামলার রসদ সরবরাহ করতো।

এর আগে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ফ্রন্ট লাইনের দক্ষিণ দিকের কৌশলগত শহর পোক্রোভস্ক শহর দখল করে নেয়। এই শহর পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগের হাব হিসেবে পরিচিত।

সে সময় ইউক্রেনের সেনাবাহিনী জানায়, পোক্রোভস্ক ঘিরে ফেলা মানে একটি বড় অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া। এই অঞ্চলের ভেতরেই রয়েছে নেভেলেস্কি, হিরনিক এবং ক্রাসনোহোরোইভকা শহর।

এর আগের সপ্তাহে রাশিয়ার সেনাবাহিনী এই শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর ওপর হামলা আরো জোরদার করে।

এ ছাড়া এই শহর ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তারা চলাচল করতো। ফলে, শহর পতনের পর ইউক্রেন এক ধরনের চাপ অনুভব করছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয়লাভ করে যুদ্ধ শেষ করতে।