যুদ্ধ থামাতে নাকি বাধাতেই সোলাইমানিকে হত্যা
ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল কাসিম সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইছেন বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। গত শুক্রবার রাতে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে ইরানি এই সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়।
সোলাইমানিকে হত্যার পর এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ হবে। যুদ্ধ বাধাতে নয়, যুদ্ধ থামাতেই সোলাইমানিকে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ সোলাইমানি মার্কিন নাগরিক ও সেনা স্থাপনায় আরও অনেক হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেসব পরিকল্পনা থেমে যাবে। সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ত্রাসের রাজত্বের পতন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার স্বার্থ রক্ষা করতেই এই হত্যাকাণ্ড।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ থামানোর যে ঘোষণা দিয়ে সোলাইমানিকে হত্যা করেছেন তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বরং বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও তরান্বিত হলো। এই হত্যার পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনি প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না, ইরান সরাসরি এই হামলার প্রতিউত্তর দেবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা জবাব দেওয়া ইরানের জন্য বোকামিই হবে। সমরশক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তি কোনোটাই ইরানকে এই ধরনের পাল্টা হামলার অনুমোদন দেয় না।
সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান সরাসরি কোনো হামলা না করলেও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হামলার শিকার হতে পারেন। সোলাইমানির বদৌলতে ইরানের সীমানা এখন অনেক বড়। ইসরায়েলও এখন ইরানের প্রতিবেশী। কারণ বিগত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সোলাইমানি যে ছায়াযুদ্ধ শুরু করেছিলেন তার ফলে সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, আফগানিস্তান পর্যন্ত তার সীমানা বিস্তৃত হয়েছে। ইরান চাইলে তার বন্ধু রাষ্ট্র সিরিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাসের মাধ্যমে ইসরায়েলে সর্বাত্মক হামলা চালাতে সক্ষম।
অন্যদিকে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা মার্কিন মিত্র সৌদি আরবের ওপর হামলা চালাতে সক্ষম এটি আর নতুন কিছু নয়। এরই মধ্যে হুতিদের হামলায় নাকানি-চুবানি খাচ্ছে সৌদি সেনারা।
এছাড়াও এসব দেশে সোলাইমানির অনুসারী হাজার হাজার মিলিশিয়া সদস্যরাও রয়েছে। তারাও তার সামরিক কমান্ডারের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে যে কোনো ধরনের আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে। শনিবার অজ্ঞাত স্থান থেকে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসের কাছাকাছি ও উত্তর বাগদাদে মার্কিন সেনা ছাউনিতে দুই দফা রকেট হামলা চালানো হয়েছে।
সুতরাং ট্রাম্প যে যুদ্ধ থামানোর অজুহাত দেখিয়ে সোলাইমানিকে হত্যা করলেন তা কতটুকু ধোপে টিকবে না এখনই স্পষ্ট হচ্ছে।
এই হত্যার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন নাগরিক ও স্থাপনা আরও হুমকির মধ্যে পড়লো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইরাকে বাড়তি সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে এবং তার নাগরিকদের ইরাক ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে। উপরোক্ত এসব কর্মকাণ্ডই স্পষ্ট করছে সোলাইমানি হত্যার পর যুদ্ধাবস্থার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কারণ এই হত্যার পর ট্রাম্প নিজে থেকে ইরাকে অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে তিনি ইরানের ৫২টি স্থাপনায় হামলার ঘোষণা দিয়েছেন। এসবই যদি যুদ্ধ থামানোর লক্ষণ হয়, তাহলে তা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই নয়।
জাতিসংঘ, রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশ এই ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা বলেছে। এতে করে মধ্যপ্রাচ্য দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে আশঙ্কা করছেন বিশ্ব নেতারা।
বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বারাক ওবামা প্রশাসনে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা নেড প্রাইস বলেছেন, সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী উত্তেজনার মধ্যে জড়িয়ে গেল। ইরানের সঙ্গে উত্তেজনায় জড়ানোর মাধ্যমে ট্রাম্পের নিজের কথার মধ্যেই বৈপরীত্য প্রকাশ পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা আরও একটি জিনিসকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তা হলো এই হত্যার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের আধিপত্য কমবে বলে মনে করছেন মার্কিন সমরবিদরা। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। সময়ের অন্যতম সেরা সমরবিদ সোলাইমানিকে হত্যায় ইরানের কুদস ফোর্সের কর্মকাণ্ডে হয়তো সাময়িক ভাটা পড়বে। কিন্তু সোলাইমানির বিকল্প তো তাদের তৈরি আছে। কারণ অনেক দিন ধরেই সিআইএ ও মোসাদের হিটলিস্টে ছিলেন সোলাইমানি। তাকে যে যে কোনো সময় হত্যা করা হতে পারে সেই প্রস্তুতি যেমন সোলাইমানির নিজের ছিল, তেমনি ইরানেরও ছিল। সোলাইমানির মৃত্যুর পরপরই দ্রুত তার স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করা হয় ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল ঘানিকে। ইসমাইল ঘানি বহুদিন ধরেই ইরানের রেভ্যুলেশনারী গার্ডের কুদস ফোর্সের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। তাই সোলাইমানির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যে কুদস ফোর্সের কর্মকাণ্ড থমকে যাবে সেই চিন্তা পুরোপুরি অমূলক।