স্নায়ুযুদ্ধ: চলে যাওয়া, ফিরে আসা
ইংরেজি ‘কোল্ড ওয়ার’ বাংলায় স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত। প্রায়-অর্ধ শতাব্দী সময়কাল পৃথিবী থরথর করে কেঁপেছিল স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনায়। একদিকে ছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব আর অন্য দিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া। দুই পরাশক্তি জোটের মেরুকরণে বিশ্ব ছিল বিভাজিত এবং যুদ্ধ হয়-হয় উত্তেজনা ঘিরে রেখেছিল সারা বিশ্বের মানুষদের।
সেই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবারও চাপা উত্তেজনা ফিরে ফিরে আসছে। আমেরিকা আর চীনের দ্বন্দ্ব কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-সৌদি জোট আর ইরান-সিরিয়া-রাশিয়ার মুখোমুখি অবস্থানের বর্তমান চিত্র মনে করিয়ে দেয় স্নায়ুযুদ্ধ সময়কালকে।
বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে চলছে ‘ছায়া-যুদ্ধ’, যা স্নায়ুযুদ্ধের প্রত্যাবর্তন বলে মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে অঘোষিত স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। স্নায়ুযুদ্ধের চলে যাওয়া আর ফিরে আসার মুখোমুখি হয়ে এখন তটস্থ বিশ্ববাসী। সবার মনে শঙ্কা, এই বুঝি শুরু হলো যুদ্ধ; এই বুঝি লেগে গেলো সংঘাত!
স্নায়ুযুদ্ধের ফিরে আসার আতঙ্কগ্রস্ত বিশ্বের এহেন সংকুল পরিস্থিতিতে স্নায়ুযুদ্ধের উদ্ভব, বিকাশ ও অবসানের ঘটনাপ্রবাহ ফিরে দেখা যেতে পারে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। মহাযুদ্ধের আগে বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপের একচ্ছত্র প্রাধান্য ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, হল্যান্ড বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক রূপে গণ্য হতো।
কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে এবং যুদ্ধের কারণে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় ইউরোপীয় দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের দেশগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কাঠামোয় প্রবল আঘাত হেনে দেশগুলোকে বিরাট সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপের প্রাধান্য খর্ব হয়ে উত্থান ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহৎ শক্তি ও পরমাণু শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে আত্মপ্রকাশ করে প্রবলভাবে। বিশেষত ইউরোপের পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে দেশ দুটি পরস্পরের মুখোমুখি হয়, যদিও বিশ্বযুদ্ধে দেশ দুটি এক জোট হয়ে হিটলারের জার্মানির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান ঘোষণা করেন যে, ইউরোপের বন্ধুদেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনে সাহায্য করবে আমেরিকা। মার্কিন রাষ্ট্রপতির এই ঘোষণা ‘ট্রুম্যান ডকট্রিন’ নামে পরিচিত। এই নীতি রূপায়নের জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্শাল পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের জন্য ব্যাপক মার্কিন অর্থ সাহায্য বরাদ্দের ঘোষণা করেন, যা ‘মার্শাল প্ল্যান’ নামে খ্যাত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপে মার্কিনিদের প্রভাব বিস্তারের পন্থা বলে অভিহিত করে এবং মার্কিন-সোভিয়েত মতবিরোধ শুরু হয়। একই সময় যুদ্ধোত্তর জার্মানির ভবিষ্যৎ নিয়েও দুই দেশের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হলে উভয় শক্তির অধীনে জার্মানি দ্বিখণ্ডিত হয়। জার্মানির পশ্চিম অঞ্চল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স দখল করে আর পূর্বাঞ্চল সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে আসে। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশের উপর সোভিয়েত দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর পশ্চিম ইউরোপের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং পূর্ব ইউরোপের উপর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। ফলে ইউরোপ মতাদর্শগত ও রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত হয়। দুই পরাশক্তির নেতৃত্বে ইউরোপের এই বিভাজন অচিরেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বে মার্কিন ও সোভিয়েত পন্থী দুটি ক্ষমতা বলয় তৈরি হয়। দ্বিমেরুর এই বিশ্ব ব্যবস্থায় উভয় শক্তির প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত ও অংশগ্রহণে শুরু হয় প্রচণ্ড উত্তেজনা ও যুদ্ধাবস্থা, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে স্নায়ুযুদ্ধ বা কোল্ড ওয়্যার-এর মাধ্যমে।
ইউরোপকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হলেও তা ক্রমেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং এ সময়কালে বিশ্ব রাজনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধের কারণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক ঘটনা সংঘটিত হয়। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপে কেন্দ্রীভূত স্নায়ুযুদ্ধ ১৯৫০ সালে এশিয়া মহাদেশে প্রবেশ করে কোরিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবাধীন উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালের ২৫ জুন মার্কিন প্রভাবাধীন দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে। নভেম্বরে এশিয়ার প্রথম কমিউনিস্ট দেশ চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে স্নায়ুযুদ্ধে নিজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ায় যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলেও এবং শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও দুই জোটের মধ্যে উত্তেজনা, সন্দেহ, যুদ্ধাবস্থা অব্যাহত থাকে।
১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির গণঅভ্যুত্থান সামরিক শক্তি দিয়ে ব্যর্থ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তখন হাঙ্গেরিকে ঘিরে তীব্র হয় স্নায়ুযুদ্ধ। একই বছর, সুয়েজ খাল সংকটকে কেন্দ্র করে মার্কিন ও সোভিয়েত দ্বন্দ্ব চরমে উঠে। খালের মালিকানা নিয়ে মিশর ও ব্রিটেন মুখোমুখি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশরের পেছনে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের পেছনে সামরিক সমর্থন দান করে।
১৯৬০ সালে মার্কিন গোয়েন্দা বিমান ইউ-২ গুলি করে সোভিয়েত ভূখণ্ডে নামানোর জেরে আবার উত্তপ্ত হয় বিশ্ব রাজনীতি। এতে সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ ও মার্কিন নেতা আইসেনহাওয়ারের মধ্যকার শীর্ষ বৈঠক ভেস্তে গিয়ে উত্তেজনার বিস্তৃতি ঘটে। একই বছর আফ্রিকার কঙ্গোতে মুখোমুখি হয় দুই বিশ্বশক্তি।
১৯৬২ সালে কিউবায় মিসাইল নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ তীব্র হয়। তারপর ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ ইত্যাদিতে সোভিয়েত ও মার্কিনিরা পেছন থেকে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে লড়তে থাকে। ৭০ দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন হলে মার্কিনিরা মুজাহিদিনদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দেয়। সে সময় মাটিতে যুদ্ধের পাশাপাশি তারকা যুদ্ধও শুরু হয়। একদিকে থাকে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো জোট আর অন্যদিকে সোভিয়েতপন্থী ওয়ারশ জোট। বস্তুত পক্ষে, সব সময় সরাসরি না হলেও বিভিন্ন পক্ষের পেছনে থেকে মার্কিন ও সোভিয়েতরা যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধাবস্থার মধ্যে পুরো পৃথিবীতে ফেলে দেয় স্নায়ুযুদ্ধের সুদীর্ঘ সময়কালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয়ে ১৯৯০-এর দশকে বার্লিন ওয়াল ভেঙে দুই জার্মানির একত্রীকরণ এবং পরিশেষে খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রের অবসানের ফলে ৪৫ বছর ব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। একই সঙ্গে দ্বিমেরু বিশ্বে একমেরু কেন্দ্রিক ক্ষমতা-কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্ব নেতৃত্ব চলে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র কব্জায়। তবে পূর্বতন সোভিয়েতের উত্তরাধিকারী ও পারমাণবিক শক্তি পেয়ে রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে আসে। দুই জার্মান এক হয়ে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। চীন আর্থিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম স্থানে চলে আসার অবস্থাও তৈরি হয়।
ফলে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর মার্কিন নেতৃত্ব অটুট থাকলেও বিশ্বে বেশ কিছু শক্তিশালী রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে এবং দেশগুলো নানা ইস্যুতে একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে পুরনো আরব-ইসরায়েল লড়াইয়ের জায়গা নিয়েছে ইরান ও সৌদি দ্বন্দ্ব। এতে সেখানকার ইসলামি দেশগুলো শিয়া ও সুন্নি ইসলামের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র লড়াই করছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান চার জাতিগোষ্ঠী, আরব, ইরানি, তুর্কি ও কুর্দিরা নিজস্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পারস্পারিক লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি জোটের পেছনে আর রাশিয়া ও চীন ইরানের পেছনে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, ২০২০ সালের শুরুতেই মার্কিনিরা ইরানি জেনারেল সুলাইমানিকে হত্যা করে দৃশ্যপটে সরাসরি চলে এসেছে। পারস্য উপসাগরীয় দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি থেকে মার্কিনিরা অস্ত্র ও কৌশলগত সাহায্য দিচ্ছে নিজের পক্ষের দেশ ও গোষ্ঠীকে।
ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নানা পরাশক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে চলছে এক ‘ছায়াযুদ্ধ’, যাকে অনেক বিশ্লেষক স্নায়ুযুদ্ধের ফিরে আসার সঙ্গে তুলনা করেছেন। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেভাবে মুখোমুখি অবস্থান, সামরিক উত্তেজনা, হুমকি-ধমকি ও প্রকাশ্য-গোপন লড়াই চলেছিল, ঠিক তেমনি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে। প্রতিদিন সেখানে বোমাবাজি-গুলি হচ্ছে, একদল আরেক দলকে অকাতরে মারছে, হাজার হাজার ঘর-বাড়ি-শহর-জনপদ পুড়ছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে শিবিরে শিবিরে মানবেতর ও নিরাপত্তাহীন জীবন কাটাচ্ছে।
এই ভয়ংকর রক্তাক্ত পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে নানা দেশ ও শক্তির হাত। স্নায়ুযুদ্ধের আমলের মতোই নেপথ্যে থেকে চালানো হচ্ছে রাজনৈতিক চাল ও সামরিক অভিযান। এর মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভীতিকর স্নায়ুযুদ্ধের স্মৃতি। একই সাথে সর্বত্র এই আশংকা তৈরি হয়েছে যে, আবার যেন ফিরে এসেছে আতঙ্কময় স্নায়ুযুদ্ধের কাল!