সাড়ে ৬ কোটির বেশি হাফেজ রয়েছে বিশ্বে
হাফেজ বলতে বুঝানো হয়, যার সমস্ত কোরআন মুখস্থ আছে। সারাবিশ্বে হাফেজে কোরআনদের বেশ সম্মানের চোখে দেখা হয়, সম্মান করা হয়। কোরআন ব্যাতীত পৃথিবীতে আর কোনো বই কী আছে, যার শুরু থেকে শেষ অবধি কেউ মুখস্থ করেছেন? মনে হয় নেই, কারণ তা সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্বে পবিত্র কোরআনের সাড়ে ৬ কোটিরও বেশি সংখ্যক হাফেজ রয়েছেন বলে জানিয়েছে একটি জরিপ সংস্থা।
সংস্থাটি জানিয়েছে, এটা একটি মতামতভিত্তিক জরিপ। জরিপের ফলাফল প্রকাশের সময় সংস্থাটি আরও জানিয়েছে। প্রতিদিন এ সংখ্যা বেড়ে চলেছে। আর এমন মানুষ আছেন, যারা কোরআন মুখস্থ করেছেন, কিন্তু প্রকাশ করেননি। ৪-৫ বছর বয়সের শিশু থেকে শুরু করে, নারী, যুবক, অন্ধ এমনকি বৃদ্ধরাও ত্রিশপারার বিশাল কিতাব পুরোপুরি মুখস্থ করেছেন, অনেক অমুসলিমও কোরআন মুখস্থ করেছেন।
কোরআন ব্যতীত এমন নজির আর আছে কি? এটা আল্লাহর কালাম কোরআনের অলৌকিকতা আর কী হতে পারে? পৃথিবীর সমস্ত ছাপা কোরআন, রেকর্ড, ক্যাসেট, হার্ডডিস্ক ইত্যাদি ধ্বংস করে ফেললেও এর কপি হাফেজদের কাছ থেকে সহজেই পাওয়া যাবে। অন্যকোনো গ্রন্থের এমনটি অসম্ভব। কারণ মানবপ্রণীত কোনো গ্রন্থ হুবহু কারও মুখস্থ নেই।
প্রায় ১৪ শত বছর আগের তুলির সাহায্যে লেখা আর বর্তমান কম্পিউটার যুগের কোরআনের মধ্যে বিন্দুমাত্র ফারাক নেই। এমন উদাহরণ আর কী আছে? নিশ্চয়ই নেই।
এর কারণ হচ্ছে, কোরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব। এর সংরক্ষক আল্লাহতায়ালা স্বয়ং। পবিত্র কোরআনের মতো এমন অলৌকিক নজির আর কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
আর এ জন্যই পবিত্র আল্লাহতায়ালা কোরআনের শুরুতে মানবজাতিকে সচকিত করে ঘোষণা করেন, ‘এটি এমন এক কিতাব (বিধান), যার মধ্যে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই।’ -সূরা বাকারা: ২য় আয়াতের ১ম অংশ
আমরা জানি, কোরআন নাজিলের আগেও অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে, এরপর ১৪ শত বছরের অধিককাল ধরে পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে। এসব গ্রন্থ মানবরচিত হলেও এর অনেকগুলোতে মূল্যবান অনেক কথা, তত্ত্ব, তথ্য-উপাত্ত ও বিবরণ রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সিংহভাগই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এক সময়ের তুমুল পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া এমন অনেক গ্রন্থের নামও জানে না এখনকার মানুষ। এখন পর্যন্ত যেগুলো টিকে আছে, সেগুলোরও ব্যাপক সংস্কার, সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেছে। কিন্তু আল্লাহর কিতাব কোরআনে কারিমের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই, সংস্কার নেই; পরিবর্তন নেই।
নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তি জিন্দেগির ২৩ বছরে কোরআন যেভাবে নাজিল হয়েছিল, হুবহু সেভাবেই সমগ্র দুনিয়াজুড়ে রয়েছে। শুধু কি মানুষের লেখা গ্রন্থই বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে? না, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের কাছে যেসব আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছিল, সেগুলোও অপরিবর্তিত অবস্থায় নেই। তার কারণ হচ্ছে, সর্বশেষ কিতাব নাজিলের পর পূর্বেকার সমস্ত বিধান বাতিল হয়ে গেছে।
‘এ কিতাবে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই।’ মানুষের লেখা কোনো একটি গ্রন্থের শুরুতে এভাবে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস করেনি কোনো লেখক। বরং প্রত্যেক গ্রন্থকার বইয়ের শুরুতে উল্লেখ করে দেন, ‘ভুলত্রুটি মার্জনীয়, কোনো পাঠক ভুল-ত্রুটি পেলে অনুগ্রহ করে আমাদের জানালে পরবর্তী সংস্করণে তা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো।’ অর্থাৎ মানুষের কোনো কাজ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, এটাই স্বাভাবিক।
পৃথিবীর বহু পণ্ডিত পবিত্র কোরআনের খুঁত ধরতে এসে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছেন প্রতিদিন। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে রোজ এমন ঘটনা ঘটছে।
কোরআন নাজিলের সময়কালে আরবের কবিরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছিল, কোরআনের মতো তারাও নিখুঁত বাণী লেখতে সক্ষম। আল্লাহতায়ালাও তার রাসূল (সা.)-এর কাছে অহির মাধ্যমে জানান, ঠিক আছে। ওরা লেখুক। কিন্তু আরবের সব কবি একসঙ্গে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলতে বাধ্য হন, এ হলো আসলেই মহান আল্লাহর বাণী।
কোরআনে কারিম যে আল্লাহর বাণী তা বহুভাবে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর কোনো পণ্ডিত এতে সামান্যতম ভুল খুঁজে পাননি, পাওয়ার উপায়ও নেই।
এই কোরআন শুধু মুসলিমদের নয়, এটা সমগ্র মানবজাতির এক মহাসম্পদ। এর আলোয় আলোকিত হওয়ার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক মানুষের। এ কিতাব শুধু মুসলিমরাই পড়বে- এমন নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই এ কিতাব নির্দ্বিধায়-নির্বিঘ্নে অধ্যয়ন করতে পারেন। পারেন এর মর্ম উপলব্ধি করতে।
হেরা গুহায় বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় প্রথম যে অহি নাজিল হয়েছিল তা কী ছিল- জানেন নিশ্চয়ই। তা ছিল, ‘পড়ুন আপনার রবের নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।’ এই যে ‘পড়ুন’ শব্দ, এর তাৎপর্য হচ্ছে- মানুষকে পড়তে হবে, অধ্যয়ন করতে হবে। বিদ্যার্জন ব্যতীত কল্যাণ যেমন নিজের জন্য সম্ভব নয়, তেমন অন্যের জন্যও তা সম্ভব নয়। শিক্ষাই হচ্ছে উন্নয়ন ও সভ্যতার চাবিকাঠি, শিক্ষার মধ্যেই মানবতার প্রকৃত মুক্তি। তাই প্রথম অহির বাণীই হলো- পাঠ করুন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ভারতীয় ধর্মগ্রন্থসমূহ বিশেষ শ্রেণির পুরুষ ব্যতীত অন্যদের জন্য পঠনপাঠনসহ শ্রবণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। তাই সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল ভারতীয় ধর্মগ্রন্থসমূহ। কিন্তু কোরআন অধ্যয়ন, পঠনপাঠন সবশ্রেণির মানুষের জন্য উন্মুক্ত। কোরআন সব মানুষের কাছে খোলামেলা।
অনেকে মনে করেন, কোরআন কেবল মুসলিমদের জন্য। কোনো কোনো মুসলিমেরও এমন ধারণা রয়েছে, তা ঠিক নয়। কোরআন সবমানুষের জন্য নাজিল হয়েছে। পৃথিবীর আলো-বাতাস, খাদ্য-পানীয়তে যেমন সমান অধিকার, তেমনই পবিত্র কোরআন আল্লাহর তরফ থেকে একটি বিশেষ রহমত ও নিয়ামত। এ কিতাব কোনো জাতির একক সম্পদ নয়। সূর্যের আলো যেমন সবার জন্য উন্মুক্ত, তেমনই কোরআনের জ্ঞান অর্জনসহ এ থেকে সবমানুষই ফায়দা নিতে পারেন।
যারা এ চিরশাশ্বত নিয়ামত থেকে বঞ্চিত তারা সত্যিকার অর্থেই হতভাগ্য। হঠকারিতা নয়, বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে নয়, কোনো ভাবাদর্শে আপ্লুত কিংবা আবেগতাড়িত হয়ে নয়, গভীর আন্তরিকতা ও ঔদার্য নিয়ে এসব কথা ভাবুন। তাহলেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগতের দুয়ার খুলে যাবে সহসা।
বৃটিশ সংস্থা ‘ফেইথ ম্যাটার্স’র গবেষণা জরিপে উল্লেখ করা হয় যে, সম্প্রতি শুধু বৃটেনে ১০ বছরে ৪০ হাজারের অধিক তরুণ-তরুণী পবিত্র কালেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের ইসলাম গ্রহণের পেছনে কোরআন বিশাল ভূমিকা রেখেছে। আসলে কোরআনই পারে মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগতের দুয়ার খুলতে। যখন কেউ পবিত্র কালেমার প্রকৃত তাৎপর্য ও মর্মার্থ মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে পারেন, তখন তার জীবন বিপন্ন হলেও তা আঁকড়ে থাকেন। মৃত্যুর ভয়ও তার থাকে না। কালেমার দাবির কাছে মানুষের জীবন অতি তুচ্ছ এবং নগণ্য প্রতিপন্ন হয়। এটাও কিন্তু কোরআনে কারিমের অলৌকিক শক্তি। আর হাফেজে কোরআন কিংবা সাধারণ মুসলমান হিসেবে যারা কোরআন মুখস্থ ও তেলাওয়াত করেন- তারাও হৃদয়ের গভীরে এক প্রশান্তি অনুভব করেন। এই প্রশান্তির অনুভূতি বলে কিংবা লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। এটাও কোরআনের আরেক অলৌকিকত্ব ও বরকত।