রহমত, বরকত, নাজাতের রমজান
রমজান মাসের নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবী জুড়ে নেমে আসে এক অনাবিল আধ্যাত্মিক স্পন্দন। আধ্যাত্মিকতা বা রুহানিয়াতের দোলায় বিশ্বের সকল মুসলমানের চিত্ত হয় আলোকিত। রহমত, বরকত, মাগফেরাত, নাজাতের পয়গামে সূচিত রমজান মাস আত্মিক ও শারীরিক পরিশুদ্ধির অনুপ্রেরণা জাগায়।
‘রমজান হলো আমার উম্মতের মাস’, বলেছেন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি আরো বলেন, ‘রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস আর রমজান আমার উম্মতের মাস।’ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রজব মাস জমি চাষ করার, শাবান মাস বীজ বপন করার এবং রমজান মাসে ফল লাভ করার অফুরন্ত নেয়ামত পাওয়া যায়।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:
‘আল্লাহ তায়ালার কসম, মুসলমানদের জন্য রমজানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসে নি। এবং মুনাফিকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আসে নি। কেননা, মুমিনগণ এ মাসে (গোটা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি তালাশ করে। এ মাস মুমিনদের জন্য গনিমত আর মুনাফিকদের জন্য ক্ষতির কারণ।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৮৩৬৮)
অতএব রমজান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা সহজেই অনুমান করা যায়। তেমনিভাবে এটাও মনে রাখা জরুরি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পুরো বছরকেই বিভিন্ন মাসে বিভক্ত করে মানবজীবনের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন, যাতে হজ, কোরবানি. রোজা ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে প্রতিটি মুসলমান নর-নারী পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা ইসলামের শরিয়ত বা বিধানের সুফল পেতে পারেন।
মাহে রমজান তেমনিভাবে মানুষের জীবনে এক অতি কল্যাণময় মাস, যার প্রথম দশ দিন রহমত, দ্বিতীয় দশ দিন বরকত এবং তৃতীয় বা শেষ দশ দিন নাজাতের আলোয় দীপ্ত। রমজানে আমলের বহুমাত্রিক সুযোগের পাশাপাশি রয়েছে অধিকতর নেকি বা সাওয়াব হাসিলের নিশ্চয়তা। কারণ, রমজানে প্রতিটি আমলের সাওয়াব বাড়িয়ে দেওয়া হয় বহুগুণে এবং রোজাদারের মুখের গন্ধ হয় মেশকে আম্বরের মতো সুগন্ধিময়।
পবিত্র ও বরকতময় রমজান মাসেই রয়েছে মহিমান্বিত লায়লাতুল কদর, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। রয়েছে ইতেকাফের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইবাদতে নিবিড়ভাবে বিলীন হওয়ার অবারিত সুযোগ। রয়েছে দিনে রোজা আর রাতে কিয়ামুল লাইল, তারাবিহ, তাহাজ্জুদ নামাজ। তদুপরি পবিত্র কোরআন নাজিলের সম্মানিত মাস রমজান। ফলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশ-নির্দেশ-দিকনির্দেশনা সম্বলিত আল কোরআনের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মাসও রমজান।
অতএব, রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মহামুল্যবান। দিন ও রাতের প্রতিটি ক্ষণ রোজা, নামাজ, তেলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ, তাহলিলে পরিপূর্ণভাবে রমজানকে উদযাপন করাই প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর একান্ত কর্তব্য। ফরজ, ওয়াজিবের পাশাপশি সুন্নত আমলসমূহের অনুসরণ করে মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে সফল করা বিশ্বাসী মুসলমানদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
রমজানের পবিত্র পরিবেশে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নির্দেশিত ও পালনীয় ইবাদতের মাধ্যমে শারীরিক কৃচ্ছ্বতা সাধন করা যেমন উপকারী, তেমনি নানাবিধ আমলে নিয়োজিত হয়ে আত্মিক উৎকর্ষ সাধনও সহজতর। লোভ, লালসা, কাম, ক্রোধ, অসসতা, নির্লজ্জতা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দা, পরচর্চা ইত্যাদির কুঅভ্যাস ও রিপুর তাড়না থেকে বাঁচার পথও দেখায় রমজান এবং রমজানের আলোকিত পরিস্থিতিতে এসব আমল পালন করার প্রেরণাও জাগে।
যদিও দুঃখজনকভাবে লক্ষ্যণীয় যে, একদল লোক রোজা রাখার পরেও নানা রকমের অপকর্ম থেকে সরে আসতে পারে না। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ব্যবসায়িক জীবনকেও অনাচার, অপকর্ম ও পাপাচার মুক্ত রাখতে পারে না। এদের জন্য রয়েছে চরম দুঃসংবাদ। এদের রোজায় পানাহার ত্যাগ করা হয় বটে, কিন্তু রোজার প্রকৃত পরিশুদ্ধি ও কল্যাণ লাভ এদের পক্ষে মোটেও সম্ভব হয় না।
মনে রাখা দরকার যে, রোজাকে বলা হয়েছে ‘ঢাল স্বরূপ’ এবং প্রকৃত ও যথাযথভাবে পালনকরা রোজার পুরস্কার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা স্বয়ং নিজে দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। অতএব, রোজা অবশ্যই হতে হবে সর্বাঙ্গ-সুন্দর, ত্রুটি ও দোষমুক্ত। রোজাদারকে হতে হবে কোরআন ও হাদিসে নিদের্শিত সকল প্রকার অপরাধ থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তাহলেই রোজার পূর্ণ সাওয়াব এবং রমজানের অফুরন্ত রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাত পাওয়ার আশা করা যায়।
মানুষের চরম সৌভাগ্য যে, তার ইহকালীন জীবনকে আলোকিত ও পরকালীন জীবনকে কল্যাণময় করার অবারিত সুযোগ দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা রমজান মাস দিয়েছেন। এই মহতী মাসের যাবতীয় নেয়ামতকে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি ও ত্রুটির ঊর্ধ্বে রেখে পরিপূর্ণভাবে পালন ও হাসিল করার এই মহার্ঘ সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মধ্যেই মানবজীবনের সার্বিক সার্থকতা ও সফলতা নিহিত। মাহে রমজানের সূচনাতেই পুরো মাসের দিন ও রাতের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে অত্যন্ত সচেতনভাবে তৈরি হওয়া দরকার এবং বিশুদ্ধ আমল ও আখলাকের আলোকে কোরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পন্থায় একনিষ্ঠভাবে তৎপর হয়ে সফলতা প্রাপ্ত হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় হিজরি সালের রমজান মাসে রোজা পালন ফরজ করা হয়। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে নয়টি রমজান পেয়ে সিয়াম বা রোজা পালন করেছেন। কারণ রমজানের রোজা দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে ফরজ করা হয়েছিল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাদশ হিজরি বছরের রবিউল আউয়াল মাসে ওফাত লাভ করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে উন্মতের জন্য মহামূল্যবান নেয়ামত স্বরূপ রমজান উম্মতের জন্য অব্যাহত রয়েছে, যার সুফল সঠিকভাবে ও পূর্ণ নিষ্ঠা-একাগ্রতা-পরিশ্রমের মাধ্যমে লাভ করা মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের জন্য অপরিহার্য।