রমজানের সওগাত ও ফজিলত
ফজিলত ও বরকতময় রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত সওয়াব ও কল্যাণে ভরপুর। রমজান প্রতিবছর মুসলিম নর-নারীকে আমলে ও আখলাকে সুন্দর হওয়ার এবং প্রতিটি দিন ও রাত সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে প্রতিপালন করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। ফলে আলস্য ও উদাসীনতা ত্যাগ করে সচল ও তৎপরভাবে নামাজ, রোজা, তেলাওয়াত, দান, সাদাকার মাধ্যমে মোবারক রমজান মাসের পরিপূর্ণ কল্যাণ ও সফলতা হাসিল করা সকলের কর্তব্য। ভালো কাজ, সুকর্ম, লাভজনক তৎপরতা, যেগুলো কল্যাণের পথ দেখায়, তেমন কাজ বা আমলের মাধ্যমেই মানবজীবনের পরম সার্থকতা নিহিত, মাহে রমজান তেমন সফলতার পথে অনুপ্রাণিত করে।
পবিত্র কোরআন বারবার ভালো কাজ/আমল বা সুকর্মের বিষয়ে তাগিদ দিয়েছে। জ্ঞানীদের/চিন্তাশীলদের জন্য বহু নিদর্শন ও দৃষ্টান্ত পবিত্র কোরআনে বহু বার বর্ণিত হয়েছে। বহু জাতির উত্থান-পতনের মাধ্যমে মানব জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরা ও আয়াতে। পবিত্র কোরআন হলো উপদেশ ও হেদায়েত। কিন্তু সেই কল্যাণকর উপদেশ, হেদায়েত, সঠিক পথের দিশা ইত্যাদি বিনা চেষ্টা, শ্রম ও উদ্যোগে পাওয়া যাবে না। গভীর চর্চা, মনোনিবেশ ও অধ্যয়নের মাধ্যমে শিখতে, জানতে ও আত্মস্থ করতে হয় পবিত্র কোরআনের আলোময় দিশাসমূহ।
কিন্তু, পবিত্র কোরআনের শিক্ষাগুলো গ্রহণ করার জন্য মুসলিম নর-নারীগণ উদ্যোগী ও সচেষ্ট না হলে উপদেশ, হেদায়েত, সঠিক পথের দিশা তথা দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ কেমন করে পাওয়া সম্ভব হবে? পরিশ্রম ও চেষ্টা ছাড়া তো কিছুই শেখা বা পাওয়া যায় না। নিজেকে উন্নত, সুশিক্ষিত, সফল ও কল্যাণমণ্ডিত করতে হলে নিরন্তর চেষ্টা ও চর্চা করতে হয়। জীবনের বস্তুগত সফলতার জন্য মানুষ এমন চেষ্টা ও চর্চা অব্যাহতভাবে করে। কিন্তু যে চেষ্টায় দুনিয়া ও আখেরাতের চিরকল্যাণ নিশ্চিত হবে, তা না করা হলে এমনি এমনি সফলতা পাওয়া অসম্ভব। চেষ্টা, চর্চা ও উদ্যোগের মাধ্যমে কল্যাণ লাভ ও সফল হওয়ার প্রেরণাময় দিকনির্দেশনা পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে:
‘(মানুষ যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন), তার জন্যে আগে পেছনে একের পর এক (আগত ফেরেশতার) দল নিয়োজিত থাকে, তারা আল্লাহর আদেশে তাকে হেফাজত করে; আল্লাহ তায়ালা কখনো কোনো জাতির (ভাগ্য/অবস্থা) পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের (ভাগ্য/অবস্থা) পরিবর্তন করে; (সুরা রা’দ: আয়াত ১১)
অতএব নিজের ভাগ্য/অবস্থা বদলের জন্য নিজেকে সর্বাগ্রে ইচ্ছুক, আগ্রহী ও সচেষ্ট হতে হবে। আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করে কাজে নেমে গেলেই সফলতা আসবে। অলস ও অকেজো বসে থাকলে সফলতা, কল্যাণ, সার্থতা কস্মিনকালেও আসবে না।
অতি কল্যাণময় ও অত্যন্ত মূল্যবান রমজান মাস রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের পথ দেখায়। কিন্তু অলস-অকর্মণ্য হয়ে বসে থাকলে বা অহেতুক কাজে সময় নষ্ট করলে রমজান মাসের ফজিলত বা ফায়দাসমূহ কেমন করে পাওয়া যাবে? আলস্য, হতাশা ও বিমর্ষতার কারণে অচল ও উদভ্রান্ত হয়ে থাকলে রমজানের সীমাহীন সওয়াবের সুযোগ ও পাপমুক্তির সুবিধা কেমন করে নিজের জীবনে আসবে?
ফলে রমজানের পবিত্র ও তাৎপর্যময় প্রতিটি মুহূর্তকে নিজের ইতিবাচক/কল্যাণকর পরিবর্তনের পথে কাজে লাগানো ও পরিচালিত করা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর একান্ত কর্তব্য। নিজের আত্মসমীক্ষা ও আত্মসমালোচনা করে রমজানের দিন ও রাত্রের আমলসমূহের প্রতি তৎপর হওয়ার মাধ্যমে ভাগ্য ও অবস্থাকে সাফল্যের দিকে পরিবর্তিত করাই কাম্য। রমজানে এমন সুযোগ হারানো যাবে না এজন্য যে, রমজান বিশেষ কয়েকটি কারণে শ্রেষ্ঠ মাসের একটি এবং মুসলিম নর-নারীর জন্য নানারূপ কল্যাণকর সুযোগে ভরপুর। নিজের দুরবস্থা কাটানো ও নিজেকে কল্যাণের দিকে ধাবিত করতে রমজান একটি চমৎকার সুযোগ এনে দেয়।
কারণ:
*রমজানে ইসলামের অন্যতম রোকন বা স্তম্ভ সিয়াজ বা রোজা ফরজ করা হয়েছে। রমজান ছাড়া ফরজ রোজা পালনের সুযোগ সারা বছরে আর পাওয়া যাবে না।
*কোরআন নাজিলের কারণে কোরআনের মাস হিসেবে রমজান সম্মানিত।
*রমজানে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সহিহ মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে বলা হয়েছে: ‘যখন রমজান মাস আসে, তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।
*রমজানে রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম ‘লাইলাতুল কদর’। রমজানে এমন একটি রাত আছে, যাকে কোরআনের হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ রাতের প্রশংসায় আল্লাহ তায়ালা একটি স্বতন্ত্র সুরা পবিত্র কোরআনে নাজিল করেছেন। সেই সুরা কদর-এ বলা হয়েছে: ‘কদরের রাত হাজার মাস (তথা চুরাশি বছর চার মাস) থেকেও উত্তম।’
*রমজান মাসে রয়েছে সালাতুল তারাবিহ নামাজের আমল। অন্য কোনো মাসে এমন নামাজের সুযোগ পাওয়া যায় না। রমজানে দিনে রোজা আর রাতে নামাজ আদায়ের সুযোগ প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জন্য এক মহা নেয়ামত। তদুপরি, কিয়ামুল লাইল, তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে রমজান মাস নামাজ ও রোজার আমলে ভরপুর থাকে। এসব আমলের সাওয়াবও রোজার মাসের বরকতে বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যেসব সুযোগ রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে মানুষ পায় না।
*রমজানের বিশেষ আমল হলো শেষ দশ দিন মসজিদে ইতেকাফ করা, যার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা বা রুহানিয়্যাত বৃদ্ধি পায় এবং রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতে যে মহিমন্বিত লাইলাতুল কদর রয়েছে, সুনিশ্চিতভাবে সেটা পাওয়াও সম্ভব হয়। আমলে-আখলাকে পবিত্র-উজ্জ্বলতা হাসিলের মহাসুযোগ রমজানে পাওয়া যায়, যা বছরের অন্য কোনো মাসে পাওয়া সম্ভব নয়।
*রমজানে রোজাদারের দোয়া কবুল করা হয়। রমজানে দিনে বা রাতে যে কোনো সময় রোজাদারের ফরিয়াদ বা দোয়া বা আবেদন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কবুল করেন। বিশেষত ইফতার সামনে রেখে দোয়া কবুলের বিষয়ে বহু বিশ্বস্ত বর্ণনা রয়েছে। রমজানে আল্লাহ তায়ালা অধিক হারে বান্দাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। মুসনাদে আহমাদের একটি হাদিসে মাহে রমজানে দোয়া কবুল ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
*রমজান দোয়া কবুলের মতোই গোনাহ মাফের মাস। এ মাসে আল্লাহ বান্দাহর গোনাহ মাফ করেন। রমজানে অধিক তাওবা করা ও নেক আমলের মাধ্যমে গোনাহ মাফ করিয়ে সাওয়াব হাসিলের চেষ্টা করা উচিত। রমজান পেয়েও গোনাহ মাফ করাতে না পারা ব্যক্তিকে ‘হতভাগ্য’ বা ‘বঞ্চিত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
*রমজান মাস জাহান্নাম থেকে মুক্তি আদায়ের মাস। রমজানের সঙ্গে নাজাত, মাগফেরাত সম্পর্কিত। আমল, রহমত, বরকতের সঙ্গে সঙ্গে মাগফেরাত ও নাজাত পাওয়ার সুযোগ রমজান মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অন্যতম।
*সাধারণ আমলের মতোই দান, সাদাকা ইত্যাদির সাওয়াবও রমজান মাসে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। ফলে সাওয়াব, কল্যাণ, বরকত হাসিলের জন্য রমজানের চেয়ে দামি মাস আর নেই। গুণে, মানে, বৈশিষ্ট্য বছরের অন্য মাসগুলোর চেয়ে রমজানের গুরুত্ব, মর্যাদা ও তাৎপর্য অপরিসীম। ফলে বছরের অন্য সময়ের মতো পরিকল্পনায় রমজানকে বরণ ও পালন করা যাবে না। রমজানকে পালন ও বরণ করতে হবে বিশেষ পরিকল্পনা ও কর্মসূচির মাধ্যমে, যাতে একটি মুহুর্তও নষ্ট না হয়ে রমজানের প্রতিটি রাত ও দিন যেন আমলের মাধ্যমে সার্থক ও সফল হয়।
*রমজানে ছোট-বড় প্রতিটি আমলের সাওয়াব বা প্রতিদান বহু গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। নফল ইবাদতের সাওয়াব অন্য মাসের ফরজের সমতুল্য করে দেওয়া হয়। আর এক ফরজের সাওয়াব সত্তর বা ততোধিক ফরজের সমতুল্য করে দেওয়া হয়। এমনকি, রমজানের ওমরাহের সাওয়াব হজের সমতুল্য করে দেওয়া হয়। আবু দাউদ শরিফের ১৯৯১ নম্বর হাদিসটি এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্বরূপ। এতে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলআইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রমজান মাসে ওমরাহ পালন করা আমার সাথে হজ করার সমতুল্য।’
অতএব পবিত্র মাহে রমজানের পুরোটা সময়কাল পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে কল্যাণের দ্বারা। জান্নাত প্রাপ্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ হাসিলের লক্ষ্যে পূর্ণ সচেতন ও সচেষ্ট হওয়া রমজান মাসে প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ফলে আলস্য ও উদাসীনতায় মূল্যবান রমজানকে নষ্ট না করে রমজানের নানাবিধ আমলের মাধ্যমে সব ধরনের কল্যাণ হাসিলের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোই সকলের জন্য একান্ত কর্তব্য ও প্রচেষ্টা হওয়া দরকার।