রমজানের রাসুলুল্লাহর আদর্শ

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

পবিত্র রমজান মাসে সব ধরনের ইবাদত অধিক পরিমাণে করাই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য। মাহে রমজানে হযরত জিবরাইল আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে পবিত্র কোরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। তদুপরি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বাবস্থায় সবচেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন আর রমজানে তিনি আরো দানশীল হতেন। তিনি অধিক পরিমাণে দান, সাদাকা, জিকির, তেলাওয়াতে ব্যস্ত থাকতেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে রোজা পালনের পাশাপাশি বিশেষ ইবাদতের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতেন। তিনি রমজান মাসকে ইবাদত, জিকির ও তেলাওয়াতের মৌসুমে রূপান্তরিত করতেন। রমজানে দিনে রোজা রাখার পাশাপাশি সারা রাত আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার কাছে মোনাজাত, সাহায্য প্রার্থনা ও কাকুতি-মিনতিতে অতিবাহিত করতেন। রমজান মাসের নামাজগুলোতে তিনি লম্বা বা বড় আকারের সুরা তেলাওয়াত করতেন। দীর্ঘ রুকু ও সিজদা করতেন। হাবিবে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইবাদতের দীর্ঘ ও কষ্টকর প্রচেষ্টা ছিল পবিত্র কোরআনের বাস্তব দৃষ্টান্ত। কারণ, আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

বিজ্ঞাপন

`হে বস্ত্র আবৃত, রাতে নামাজের জন্য দণ্ডায়মান হও কিছু অংশ ব্যতিত’ (সুরা মুজাম্মিল: আয়াত ১-২)।

`রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়–ন, এটা আপনার জন্য ফরজ নামাজের অতিরিক্ত একটা নামাজ। আশা করা যায়, আপনার মালিক আপনাকে প্রশংসিত মর্যাদায় মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত করবেন’ (সুরা বনি ইসরাঈল: আয়াত ৭৯)।

বিজ্ঞাপন

বস্তুতপক্ষে সমগ্র রমজান মাসকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমলে ভরপুর রাখতেন। দিনের বেলায় রোজা রাখার পাশাপাশি তিনি দাওয়াত, তালিম ও তরবিয়াতে ব্যস্ত থাকতেন আর রাতে অধিক সময় নামাজ, জিকির ও তেলাওয়াতে মশগুল থাকতেন।

রমজান মাসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছিল এই যে, তিনি নিজ চোখে চাঁদ না দেখে অথবা চাঁদ সম্পর্কে কোনো সাক্ষীর নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য না পেলে রোজা  রাখতেন না। অতঃপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসকে মহাসমারোহে বরণ করতেন। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, যখন রমজানের নতুন চাঁদ দেখতেন, তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নের দোয়া পাঠ করতেন:

‘হে আল্লাহ, তুমি ঐ চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত কর নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে। হে চাঁদ, আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। হেদায়েত ও কল্যাণময় চাঁদ।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৪৫১)

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহরি খাওয়ার জন্য বিশেষ তাগিদ বা উৎসাহ দিতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

‘তোমরা সাহরি খাও, কেননা, সাহরিতে বরকত আছে’ ( বোখারি শরিফ: ১৮০১)।

‘আমাদের রোজা আর আহলে কিতাবদের (খ্রিস্টান-ইহুদি) রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া আর না খাওয়া’ (মুসলিম শরিফ: ১৩১)।

অবশ্যই রাতের শেষ প্রহর অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূণ। আমলের জন্য নিবিড় সময় তখন। একাগ্র চিত্তে নামাজেরও উপযুক্ত সময় তখন। তেমন একটি মোবারক সময় রোজার নিয়তে সাহরি খাওয়ার জন্য নির্ধারিত। সাহরি একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল, যা মুসলমানদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সামান্য পরিমাণে খাবার ও পানীয় দিয়ে সাহরি খাওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তদুপরি সেই সময়টি সম্পর্কে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

‘রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে’ (সুরা জারিয়াত: আয়াত ১৮)।

‘তারা রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমা প্রার্থনাকারী’ (সুরা আলে ইমরান: আয়াত ১৭)।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যাস্তের পর পরই নিজে তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন এবং অন্যদেরকেও তাড়াতাড়ি ইফতার করতে আদেশ করতেন। ইফতারের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার কাছে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করতেন। কারণ ‘ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না’। তিনি মাগরিবের নামাজের আগেই ইফতার করতেন।  খেজুর, খোরমা, পানি দ্বারা তিনি ইফতার করতেন। সারা দিন রোজার পর খালি পেটে উগ্র খাবারের বদলে মিষ্টিজাতীয় নরম খাবার স্বাস্থ্য ও হজমের জন্য উপযুক্ত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি কাজ ও খাদ্য প্রণালী স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অতি উত্তম ও যথোপযুক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

কোনো ব্যক্তি রোজা অবস্থায় ভুলে পানাহার করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সেই রোজা কাজা করতে বলতেন না। এতে প্রমাণিত হয় যে, রোজায় একান্ত ভুলবশত পানাহার করে ফেললে সেই রোজা ভঙ্গ হবে না। তবে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহিহ সনদের হাদিসে রোজা ভাঙ্গার কারণগুলো হলো, দিনের বেলা রোজা পালনের সময় ইচ্ছাকৃত পানাহার করা, শিঙ্গা লাগানো, বমি করা। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, খাওয়া ও পান করার মতো যৌন সঙ্গমও রোজা ভঙ্গের কারণ। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসে সফর করেছেন। সফর অবস্থায় কখনো তিনি রোজা রেখেছেন, আবার কখনো রোজা রাখেন নি। তিনি সাহাবায়ে কেরামকেও সফরাবস্থায় রোজা রাখা না রাখার এখতিয়ার দিয়েছেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে যুদ্ধের সময় রোজা না রাখার আদেশ করতেন। কারণ, এতে যুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় শক্তি থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক যুদ্ধ রমজান মাসে করেছেন। বদর যুদ্ধও রমজান মাসে সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা মুসলমানদের অকল্পনীয় সাহায্য করেন। ইসলামের সবচেয়ে বড় দুটি গাযওয়া বা যুদ্ধ রমজানে মাসে হয়। এ দুটি হলো বদর এবং ফতেহ মক্কা বা মক্কা বিজয়।  

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। ইতেকাফের সময় দুনিয়ার কাজ-কারবার, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার ধ্যানে মগ্ন হতেন তিনি। বস্তুতপক্ষে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসকে অধিকতর আমল ও ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করতেন। পুরো মাসটিকেই দ্বীনের কাজের ব্যয় করতেন। আমল ও দাওয়াতের মাধ্যমে রমজানের প্রতিটি মুর্হুত, দিন ও রাতকে যথোপযুক্তভাবে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার নির্দেশিত পথ ও পন্থায় ব্যয় করাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ বা নির্দেশিত পদ্ধতি, যা অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জন্য একান্ত কল্যাণকর এবং বিশেষ জরুরি।