রমজানে দানশীলতার অনুসরণ ও অনুশীলন

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজার মাস রমজানে তাঁর স্বাভাবিক দানশীলতাকে বাড়িয়ে দিতেন। দয়া ও দানের ক্ষেত্রে যে নবী সারা পৃথিবীর সামনে উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত, তিনি রমজানে তা আরো অবারিত করতেন, যার অনুসরণ ও অনুশীলন করা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর কর্তব্য। বিশেষত রমজানের দানের মাধ্যমে আল্লাহ সোবহানুহু তায়ালার আদেশ পালন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ এবং রমজানের বরকত ও বহুগুণ সাওয়াব লাভ করার সুযোগ রয়েছে, যা কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ। তদুপরি, দানের সুফল সম্পর্কে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার রয়েছে স্পষ্ট ঘোষণা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

‘যেসব নেকি তোমরা আল্লাহর কাছে অগ্রিম পাঠাবে, তার কাছে এর সবই তোমরা মজুদ পাবে’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১১০)।

বিজ্ঞাপন

কোরআনুল কারিমে আরো ইরশাদ করা হয়েছে:

‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ হচ্ছে কোন একটি বীজের মতো, সে বীজটি বপন করার পর তা থেকে একে একে সাতটি শীষ বের হয়। আর এর প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ করে শস্য দানা। আল্লাহ তায়ালা যাকে চান তাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ তায়ালা অনেক প্রশস্ত, অনেক বিজ্ঞ’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২৬১)।

বিজ্ঞাপন

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিস, যা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন:

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল লোকের চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন। আর মাহে রমজানে যখন হযরত জিবরাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি আরো বেশি বদান্যতা প্রকাশ করতেন। জিবরাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহে রমজানের প্রত্যেক রাতেই তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং কোরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাতকালে কল্যাণবহ মুক্ত বায়ুর চেয়ে বেশি দানশীল হতেন’ (মুসলিম শরিফ: ২৩০৮)।

রমজান মাসের রোজা প্রতিটি রোজাদারের কাছে দানশীল হওয়ার এবং অন্নহীনকে অন্ন দেওয়ার দাবি জানায়। রমজান মাস দানশীলদের জন্য দানের এক মহা সুযোগ নিয়ে আসে, যা তার কল্যাণকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে। তদুপরি, সাফল্য কখনোই সম্পদ পুঞ্জিভূত করার মধ্যে নয়, দানে। কারণ, সম্পদ হলো পানির মতো। তাকে আটকে বা পুঞ্জিভূত করে রাখা হলে সেসব পচে-গলে দুর্গন্ধময় হয়ে যাবে। আর প্রবাহিত করা হলে স্রোতে পানির মতো সুপেয় ও স্বচ্ছ হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

‘আল্লাহ তায়ালার দু’জন ফেরেশতা রয়েছেন। তাঁরা প্রতিদিন সকালে ঘোষণা করতে থাকেন। একজন বলেন, হে আল্লাহ, তুমি দাতার প্রতিদান দাও। অপরজন বলেন, হে আল্লাহ, তুমি কৃপণের সর্বনাশ করো’ (বোখারি শরিফ: ১৪৪২)।

বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, যখনই বান্দাহ দান করে, তখন দানের বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা দানকারীর শরীরের সুস্থতা, মনের শান্তি ও রিজিকের প্রশস্ততা দান করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

‘সাদাকা/দান গোনাহর আগুন নিভিয়ে দেয়, যেভাবে পানি আগুন নিভিয়ে দেয়’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ২০৭১৯)।

বস্তুতপক্ষে, গোনাহ ও পাপাচার শরীর ও মনে দাহ সৃষ্টি করে। হৃদয়ে কালো দাগের মতো পাপ মানুষের ভেতরে অন্ধকার ডেকে আনে। যার ফলে শরীর ও মনে নানা রকমের ব্যাধি, অস্থিরতা ও অকল্যাণের উদ্ভব ঘটে। তাওবা ও দান-সাদাকা সেসব পাপকে দূর করে এবং দহনের অস্থিরতায় পনির মতো প্রবাহিত হয়ে শান্তি আনে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

‘শেষ বিচারের দিন সকল মানুষের ফয়সালা হওয়ার পূর্ব-পর্যন্ত দানকারী তার দানের ছায়াতলে থাকবে’ (মুসনাদে আহমাদ: ১১৪)।

দান কতো শক্তিশালী এবং আশ্চর্যজনক সাহায্যকারী, তা মানুষের বাস্তব জীবনে দেখা যায়। দানের কল্যাণকর দৃষ্টান্ত দুনিয়াতেও দেখতে পাওয়া যায়। এ রকম অনেক ঘটনার মধ্যে খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। তিনি অনেক সম্পদের অধিকারী ছিলেন। তিনি তাঁর সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খরচ করতেন। তাবুক যুদ্ধের রসদ দিয়েছেন তিনি। মুসলমানদের জন্য মদিনার রুমা কূপ খরিদ করে সেটা সকলের কল্যাণে ওয়াকফ করেছেন। তিনি অকাতরে দান-সাদাকা করেছেন এবং আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। আরো অনেক সাহাবি ও বুজুর্গ দানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। যে কারণে তাঁরা দুনিয়া ও আখেরাতে সুখ, শান্তি ও কল্যাণের অধিকারী হয়েছেন।

মানব জীবনে দানকারী নিজে যেমন সুখী হয়, তেমনি পরিবার, পরিজন, আত্মীয়, প্রতিবেশী, সমাজ এবং সর্বপরি আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার কাছেও সম্মানীত হয়। আর মুসলমানের বৈশিষ্ট্যই হলো দান করা এবং কর্জে হাসানা দেওয়া। কারণ, ইহুদি ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা দানে বিমুখ। কিন্তু মুসলমানগণ ফরজ জাকাত ছাড়াও নানা প্রকার দানে উৎসাহী। এটাই হলো অন্যান্যদের সঙ্গে মুসলমানদের পার্থক্য। দান ও সাদাকার মাধ্যমে মুসলমানগণ যে মানবতাবাদী আর ইসলাম যে বিশ্ব মানবিকতার ধর্ম, তার প্রমাণকারী। ফলে রমজানের দানের ক্ষেত্রে অধিকতর অগ্রসর হওয়াই বাঞ্ছণীয়। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানে অধিকতর দানশীল ছিলেন। তাঁর উম্মতকেও রমজানে অধিক দানশীল হওয়া কর্তব্য। দান-সাদাকা ছাড়াও গরিব-মিসকিস, অসুবিধাগ্রস্ত আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশীকে ইফতার, সাহরি ও খাবার সরবরাহ করাও অতি জরুরি কর্তব্য। সামর্থ্য-সুযোগ মতো মানুষকে আর্থিক ও অন্যবিধভাবে সাহায্য করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

‘যে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে রোজাদারের প্রতিদানের সমান প্রতিদান পাবে। তবে এটা রোজাদারের প্রতিদান কমাবে না’ (মুসনাদে আহমাদ: ১১৪)।

ফলে রোজার মাস রমজানে সামর্থ্য অনুযায়ী দুস্থ ও গরিবদের খাদ্য ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করা দরকার। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দানের হাত প্রসারিত করা হলে তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে অধিকতর কল্যাণের উসিলা হবে। কেননা, মানুষ নিজের জন্য যে অর্থ ও খাদ্য খরচ করে, তা এক সময় শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য যা খরচ করে তা জমা থাকে এবং বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিদান রূপে পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা করেন:

‘যদি তোমরা আল্লাহ তায়াকে উত্তম ঋণ দাও, তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি তা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন এবং তিনি তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ তায়ালা বড়ই গুণগ্রাহী, ধৈর্যশীল’ (সুরা তাগাবুন: আয়াত ১৭)।           

মানবজীবনের কঠিন প্রান্তরে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার নিদের্শ অনুযায়ী চলার মধ্যেই কল্যাণ, নিরাপত্তা ও সাফল্য নিহিত। দানের ক্ষেত্রে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার হুকুমের অনুসরণ করাই কল্যাণকর। কারণ, দানের মাধ্যমে নিজেকে পাপমুক্ত, বিপদমুক্ত ও সাওয়াবের অধিকারী করা যায়, যা করতে পারাই বিচক্ষণতার পরিচায়ক। অথচ বহু মানুষ দুনিয়ার জীবনে প্রচুর সম্পদ জমিয়ে রেখে পুঞ্জিভূত করে এবং মৃত্যুর পর সেসব নিয়ে তার উত্তরাধিকারীগণ দাঙ্গা-ফাসাদ, মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত হয়। এতে তার সম্পদ একদিকে যেমন বিপদের কারণ হয়, অন্য দিকে তার জন্য কোনো উপকারে আসে না। কিন্তু ঐ ব্যক্তি নিজের পর্যাপ্ত অর্থ-সম্পদ থেকে জীবদ্দশায় দান করতে পারলে সে দানের লাভ সে নিজেই ভোগ করতে পারতো। অতএব, সর্বদা দানশীলতার বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে এবং রোজার মাস রমজানে দানের ব্যাপারে অধিকতর মনোযোগী ও উৎসাহী হতে হবে।