ইতেকাফ
রোজার মাস রমজানের আরেক নেয়ামত হলো ইতেকাফ। ইতেকাফ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, অবস্থান করা বা কোনো স্থানে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় ইতেকাফ বলা হয়, আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টি ও ইবাদতের জন্য এক বিশেষ সময়কাল পর্যন্ত বিশেষ নিয়মে নিজেকে মসজিদে আমলে আবদ্ধ রাখা। অতি মোবারক লায়লাতুল কদর অনুসন্ধান করার জন্য ইতেকাফ করা সুন্নত।
মসজিদে ইতেকাফ হচ্ছে, হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা, চিত্তের নিষ্কলুষতা, চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতার মাধ্যম। পবিত্র ফেরেশতাগণের গুণাবলি অর্জন, লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদত করার সুযোগ পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো ইতেকাফ।
রমজান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মিত ইতেকাফ করেছেন। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে যে:
‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতেন। এরপর তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ ইতেকাফ করতেন’ (বোখারি শরিফ: ১/২৭১)।
হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,
‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতেকাফ করতেন। তবে যে বছর তিনি ওফাত লাভ করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতেকাফে কাটান’ (বোখারি শরিফ: ১৯০৩)।
ইতেকাফের প্রসঙ্গ পবিত্র কোরআনেও বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন:
‘আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও করুকারী-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১২৫)।
‘আর তোমরা মসজিদে ইতেকাফকালে স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করো না’ (সুরা বাকারা: আয়াত ১৮৭)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত একটি হাদিস। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে:
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে খাঁটি মনে একদিন ইতেকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার থেকে জাহান্নামকে তিন খন্দক দূরে সরিয়ে দেবেন। এক খন্দক হলো, আসমান-জমিনের দূরত্বের চেয়েও বেশি দুরত্ব’ (শুয়াবুল ঈমান)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
‘ইতেকাফকারী সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত থাকে এবং তার আমলনামায় এতো বেশি নেকি লেখা হয় যেন সে নিজে সব নেক কাজ করেছে’ (মেশকাত শরিফ: ১/১৮৩)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সহাবীগণ মসজিদে ইতেকাফে অংশ গ্রহণ করতেন এবং দুনিয়ার যাবতীয় চিন্তা-ফিকির থেকে মুক্ত হয়ে একাগ্র চিত্তে আল্লাহ সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ইবাদতে মগ্ন হতেন। পুরুষগণ মসজিদে আর মহিলারাও নিজ গৃহে ইতেকাফে অংশ নিতে পারেন। মাসয়ালা অনুযায়ী, মহিলাগণ তাদের নিজ নিজ গৃহে নামাজের নির্দিষ্ট স্থানে পর্দা টেনে ইতেকাফ করবেন। গৃহে নামাজের জন্য কোনো স্থান নির্দিষ্ট না থাকলে তা নির্দিষ্ট করে নিয়ে সেখানে ইতেকাফ করা যাবে। যেসব মহিলার স্বামী বৃদ্ধ, অসুস্থ কিংবা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে তাদের জন্য এসব অতি জরুরি পারিবারিক দায়িত্ব পালন করা ইতেকাফ করার চেয়েও উত্তম।
নারী বা পুরুষ, উভয়ের ক্ষেত্রেই মসজিদ বা গৃহের ইতেকাফের স্থান থেকে কোনো শরিয়তি কারণ ছাড়া বের হলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে। মসজিদে ইতেকাফকারীকে পরিবার বা সমাজের লোকজন খাবার পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। ইতেকাফ একটি মহৎ ইবাদত। এ ইবাদত স্বেচ্ছায় পালনীয়। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, একজনের পক্ষে আরেকজনকে বিনিময় দিয়ে বা ভাড়া করিয়ে ইতেকাফ করানোর সুযোগ নেই। নিজের ইতেকাফ নিজেকেই করতে হবে। কোনো মহল্লার এক বা দুইজন রমজানে মহল্লার মসজিদে ইতেকাফে অংশ নিলে মহল্লার হক আদায় হয়ে যায়। কেউ ‘ইতেকাফ করতে চাইলে, ২০ রমজানের সূর্যাস্তের আগেই ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করবে’ (বোখারি শরিফ: ২০২৭)।
ইসলামের ধর্মব্যবস্থায় রুহানিয়্যাত বা আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধি করতে যেসব আমল, যেমন, তাহাজ্জুদ, নফল নামাজ ও রোজা যেমন রয়েছে, তেমনি রমজানে বিশেষভাবে রয়েছে ইতেকাফ। ইতেকাফে একজন মুসলমান শবে কদরের অন্বেষণে এবং দুনিয়ার যাবতীয় কাজ থেকে বিমুখ হয়ে শুধুমাত্র আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার ইবাদতে মশগুল হয়, এতে তার ঈমান, একিন ও আমলের বিষয়টি বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং একনিষ্ঠভাবে মসজিদে আমলের পরিবেশে থাকার কারণে তার মধ্যে নূর বা আলো বা পবিত্রতা সঞ্চারিত হয়। তাই, রমজান মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে শেষ দশ দিন মসজিদে ইতেকাফ করার বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং অতুলনীয়।
বাংলাদেশে পাড়া-মহল্লা, শহর-গ্রামে সাধারণত এক বা দুইজন অতিবৃদ্ধ মুসুল্লি ইতেকাফে শামিল হন। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে, বিশেষত আরব বিশ্বে উৎসবমুখরভাবে মানুষ ইতেকাফে শরিক হন এবং মসজিদের কোণে কোণে অবস্থান করে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত আমলের বাইরে নফল ও অন্যান্য আমলের মাধ্যমে রমজানের শেষ দশ দিনকে সাফল্যম-িত করেন। মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারাম এবং মদিনায় পবিত্র মসজিদুন নববীতে রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফের জন্য উপচে পড়া ভিড় হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মুসলিম নারী ও পুরুষ ইতেকাফে শামিল হয়ে মসজিদে অবস্থান করেন এবং তারাবিহ, কিয়ামুল লাইল, তাহাজ্জুদ, তেলাওয়াত, জিকির ইত্যাদিতে মশগুল থাকেন। যে দৃশ্য তৌহিদের ভিত্তিতে ইসলামের রুহানিয়্যাত ও মুসলিম ভ্রাতত্বের অনুপম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে।