রমজান ও দ্বীনের আহ্বান বা দাওয়াত

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ইসলাম ধর্ম সকল মানুষের জন্য আলো স্বরূপ আর মুসলমানগণ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ প্রদানকারী। অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানগণ সমগ্র মানব জাতিকে কল্যাণ ও সরল-সুপথে আহ্বানকারী। বস্তুত পক্ষে, দ্বীনের পথে দাওয়াত দেওয়া বা আহ্বান করা সকল নবীর কাজ রূপে স্বীকৃত। সকল নবী-রাসুলই একজন দাঈ বা আহ্বানকারী তথা শিক্ষক রূপে এসেছিলেন। সকলেই নিজ নিজ আমলের মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে তৌহিদের এই অম্লান বাণী প্রচার করেছিলেন:

‘তোমরা সবাই আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো উপাস্য নেই’ (সুরা আরাফ: আয়াত ৫৯)।  

বিজ্ঞাপন

আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার  দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানানোর জন্য কেউ কোনো প্রতিদান কামনা করেননি। পরিস্কার ভাষায় বলেছেন:

‘আমি এর জন্য তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না’ (সুরা শোয়ারা: আয়াত ১০৯)।

বিজ্ঞাপন

এই আহ্বান ও দ্বীনের প্রতি দাওয়াতের গুরুত্বের পাশাপাশি তার পদ্ধতি ও নীতিমালা সম্পর্কে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

‘আপনি আপনার রব (প্রভু)-এর পথে প্রজ্ঞা এবং উত্তম উপদেশের সাথে মানুষকে ডাকুন এবং উত্তম পন্থায় বিতর্ক করুন’ (সুরা নাহল: আয়াত ১২৫)।

‘হে নবী, আপনি মানুষকে বলে দিন এ হচ্ছে আমার পথ, আমি মানুষদেরকে আল্লাহর পথে আহ্বান করি। আমি এবং আমার অনুসারীরা পূর্ণাঙ্গ সচেতনতার সাথে এ পথে আহ্বান জানাই। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র এবং আমি কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (সুরা ইউসুফ: আয়াত ১০৮)।

‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কোন্ ব্যক্তির হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে, নেক কাজ করে এবং বলে আমি মুসলমানদেরই একজন’ (সুরা হামিম সাজদাহ: আয়াত ৩৩)।

ফলে প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হলো আল্লাহর পথে, দ্বীনের পথে, সৎ কাজের পথে এবং অসৎ কাজের বিরুদ্ধে আহ্বান করা বা দাওয়াত দেওয়া। রমজান মাসের পবিত্র পরিবেশে এ দাওয়াত বা আহ্বানের কাজ আরো বৃদ্ধি করাই ঈমানের দাবি এবং আমল হিসাবে অধিক সাওয়াবের মাধ্যম। ইসলামী স্কলারদের মতে দাওয়াতের পাঁচটি আদব, পাঁচটি পন্থা এবং পাঁচটি ফলাফল রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে অবহিত হয়ে সঠিক ও ইসলাম সম্মত ভাবে আহ্বান বা দাওয়াতের কাজ করা যেতে পারে। কুতর্ক বা চিৎকার করে নয়, মিষ্টভাষা, উত্তম উপদেশ ও হেকমতের সঙ্গেই দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করা ইসলামের নির্দেশিত বিধান। এ কারণে দাওয়াতের আদব, পন্থা ও ফলাফল সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

#দাওয়াতের আদব পাঁচটি

১. ইখলাস ও আন্তরিকতার মাধ্যমে দাওয়াত দিতে হবে। আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন: ‘এদের এ ছাড়া আর কোন কিছুর আদেশ দেওয়া হয়নি, তারা আল্লাহর জন্য নিজেদের দ্বীন ও ইবাদত নিবেদিত করে নেবে’ (সুরা বায়্যিনাহ: আয়াত ৫)।

২. দাওয়াত ও আমলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। অর্থাৎ দাওয়াত দেওয়ার আগে নিজেকে সেসব বিষয়ে আমল করতে হবে। কেননা, কথার সাথে কাজের মিল না থাকাটা অপমানকর, লজ্জাজনক এবং মোনাফেক বা প্রবঞ্চকের লক্ষণ। আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন: ‘তোমরা কি অন্যদের সৎকাজের আদেশ দাও আর নিজেদের ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব তেলাওয়াত করে থাকো। তোমরা কি বুঝবে না!’ (সুরা বাকারা: আয়াত ৪৪)।

৩. দাওয়াত ও তাবলিগের ক্ষেত্রে ন¤্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করতে হবে। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ইরশাদ করা হয়েছে: ‘তোমরা তার সাথে নরম ভাষায় কথা বলো, যাতে করে সে উপদেশ গ্রহণ করে, অথবা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো’ (সুরা ত্বাহা: আয়াত ৪৪)। আরো ইরশাদ হয়েছে: ‘আল্লাহর অসীম দয়ায় আপনি তাদের জন্য ছিলেন কোমল প্রকৃতির মানুষ। এর বিপরীতে যদি আপনি নিষ্ঠুর ও পাষাণ হৃদয়ের মানুষ হতেন, তাহলে এসব লোক আপনার আশপাশ থেকে দূরে চলে যেতো’ (সুরা আলে ইমরান: আয়াত ১৫৯)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এই নির্দেশ দিয়েছেন যে: ‘তোমরা সহজ করো, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, তাদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করো না’ (মুসলিম শরিফ: ১৭৩২)।

৪. দাওয়াত বা আহ্বানের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দিয়ে শুরু করতে হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও দাওয়াতের ক্ষেত্রে এরূপ করতেন। যেমন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামানে প্রেরণ করার সময় এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছিলেন: ‘তুমি আহলে কিতাবের এক গোত্রের কাছে যাচ্ছো। তোমার সর্বপ্রথম দাওয়াত যেন হয় এ কথার সাক্ষ্য দেওয়ার দিকে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, আর আমি (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসুল। যদি তারা তোমার এ দাওয়াতে সাড়া দেয়, তাহলে তাদের এ সংবাদ দাও যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন’ (মুসলিম শরিফ: ১৯)।

৫. প্রত্যেককে তার মান ও প্রয়োজন অনুসারে দাওয়াত প্রদান করা। অর্থাৎ শহুরে লোকদের জন্য দাওয়াত বা আহ্বানের ভাষা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আর গ্রামীণ জনতার জন্য তা একই রকম হলে বোধগম্য হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। এজন্য স্থান, কাল, পাত্র অনুযায়ী দাওয়াতের ভাষা ও বক্তব্য নির্ধারণ করা অপরিহার্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন: ‘যাকে হিকমত ও প্রজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২৬৯)।

#দাওয়াতের পন্থা পাঁচটি

১. যাকে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে, এককভাবে তার প্রতি মনোযোগী হয়ে দাওয়াত দিতে হবে, যাতে পুরো আলোচনায় তিনি সম্পৃক্ত বোধ করেন। ব্যক্তিগত দাওয়াতের ক্ষেত্রে এ পন্থা উপযোগী।

২. পাবলিক লেকচার বা সমষ্টিকে দাওয়াত দেওয়ার সময় অবিতর্কিত মৌলিক বক্তব্য পেশের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

৩. দাওয়াতের আগে সঠিক প্রশিক্ষণ ও নোট নেওয়া, যাতে কোরআন ও হাদিসের সঠিক রেফারেন্স ও অর্থ প্রদান করা যায় এবং কোনোরূপ বিভ্রান্তির সৃষ্টি যাতে না হয়।

৪. শুধু বক্তব্যের উপর নির্ভর না করে লেখালেখি, গবেষণা ও সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমেও দাওয়াতের কাজকে অগ্রসর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৫. আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রচারমাধ্যমকে বিশুদ্ধ ও সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। যুগের চাহিদা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নকে দ্বীন, ইসলাম ও দাওয়াতের কাজে লাগানোর চেষ্টা করা যেতে পারে।

#দাওয়াতের পাঁচটি ফল

১. সকল নবী-রাসুলের দ্বীনী ও আদর্শিক উত্তরাধিকারী লাভ করা যায়। কারণ, তারাই ছিলেন প্রথম ও অগ্রণী দাঈ এবং দ্বীনের দাওয়াতের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র তুল্য ব্যক্তিত্ব।

২. দাঈ-এর জন্য সকল মাখলুক ইস্তেগফার করতে থাকে। যে ব্যক্তি মানুষের দ্বীনের জন্য চেষ্টা ও পরিশ্রম করে, তার নিজের দ্বীন ও ঈমান সর্বাগ্রে মজবুত হয়। যে ব্যক্তি মানুষের কল্যাণের কথা বলে দাওয়াত দেয়, তার কল্যাণও সর্বাগ্রে সুনিশ্চিত হয়। মাখলুকের সকলের সঙ্গে সঙ্গে গভীর সমুদ্রের তলদেশের মাছও পর্যন্ত দাঈ বা আহ্বানকারীর জন্য দোয়া এবং মাগফেরাত কামনা করতে থাকে।

৩. যাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে, তাদের সংখ্যার হিসাবে দাওয়াত দানকারী সাওয়াব লাভ করে। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে: ‘যে ব্যক্তি হেদায়েতের পথে ডাকবে, সে তার দাওয়াতের অনুসারীদের সাওয়াবের অনুরূপ সাওয়াব পাবে। এটা তাদের সাওয়াবের মধ্যে কোনো হ্রাস ঘটাবে না’ (মুসলিম শরিফ: ১০১৭)।

৪. যাকে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে, এক সময় সে নিজেই দাঈ হয়ে যায়। ফলে দাওয়াত জারি থাকে এবং দাওয়াতের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে জড়িতরা অবিরাম সাওয়াব পেতে থাকে।

৫. যে মানুষকে দ্বীন, কল্যাণ, সৎকর্মের দাওয়াত দেয়, তার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে এবং নেতৃত্বে আসীন করতে চায়। মহান আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা নেককারদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, তারা দাওয়াত দেয় এবং বলে ‘আমাদেরকে মুত্তাকিদের ইমাম বানিয়ে দিন’ (সুরা ফোরকান: আয়াত ৭৪)।

রমজানে মাসে রোজা রেখে দ্বীন ও ইসলামের পক্ষে দাওয়াত দেওয়ার চেয়ে লাভজনক ও সাওয়াবের কাজ আর কিছুই হতে পারে না। কথা বলা ও লেখার মাধ্যমে, চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে দ্বীন, ইসলাম, ঈমান, আমল এবং যাবতীয় সুকর্মের পক্ষে আর কুকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া একজন আদর্শ দাঈ-এর দায়িত্ব। প্রতিটি মুসলমানই নিজের সাধ্যমতো এ দায়িত্ব সারা বছর তো বটেই, মাহে রমজানের সময় বিশেষভাবে পালন করতে পারেন এবং রহমত, বরকত, নাজাত ও মাগফেরাতের মাহে রমজানকে নিজের জীবনে সার্থক করতে পারেন।