বিশ্বে হালাল খাবার শিল্পে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি, নৈতিকভাবে উৎসৃত এবং সনদপ্রাপ্ত খাদ্যপণ্যের প্রতি গ্রাহকদের চাহিদা এবং হালাল প্রথার উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা এর অন্যতম কারণ। হালাল সনদপ্রাপ্ত পণ্যের চাহিদা শুধুমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেই নয়, বরং অমুসলিম অঞ্চলেও এটি মান এবং নৈতিক উৎপাদনের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশ একটি প্রধান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এই বিশাল বাজারের সম্ভাবনা থেকে অনেক উপকৃত হতে পারে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া হালাল খাবারের দেশ, দেশ দুটি একযোগে কাজ করছে এই বাজারের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে; যা দেশে-বিদেশে বড় ভূমিকা রাখবে।
‘রিভার্স লিঙ্কেজ প্রকল্প’ নামে পরিচিত এই সহযোগিতা প্রজেক্ট হালাল সনদ প্রদানকারী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমকে আরও দক্ষ এবং দেশের হালাল ইকোসিস্টেম আরও উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ হালাল খাদ্য ও সার্টিফিকেট বিষয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক কাজ করছে, যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০০৭ সালে যখন হালাল খাদ্যপণ্য নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিলো না, তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশন একক প্রচেষ্টায় এই খাতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগের মাধ্যমে হালাল খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও সেবার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ হালাল সার্টিফিকেট প্রদান করছে, যা সরকারি এবং দ্বীনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর ফলে, বাংলাদেশে উৎপাদিত হালাল খাদ্যপণ্য বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ভূমিকা হালাল খাদ্য এবং ইসলামি জীবনধারা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নেও অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের হালাল পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০০৭ সাল থেকে কাজ করছে এবং ২৩৫টি কোম্পানি তাদের ২ হাজারের অধিক পণ্যের জন্য হালাল সনদ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৬৬টি কোম্পানি তাদের ছয় শতাধিক পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে এবং দিন দিন এই পরিমাণ বাড়ছে।
হালাল খাবার ও এর গুরুত্ব
‘হালাল’ শব্দটি ইসলামি আইন থেকে উদ্ভূত এবং এটি মুসলিমদের জন্য যা কিছু গ্রহণযোগ্য বা বৈধ তা বোঝায়। বিশেষভাবে, হালাল খাবার এমন খাদ্যপণ্যকে বোঝায় যা ইসলামি আহারের নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তুত এবং প্রক্রিয়াজাত করা হয়, যেখানে কিছু নির্দিষ্ট খাবার যেমন শূকরের মাংস, মদ এবং অন্যান্য নন-হালাল উপাদান নিষিদ্ধ। হালাল খাবারকে অবশ্যই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় পরিস্কার এবং নৈতিকমান পূর্ণ করতে হয়, যার মধ্যে প্রাণী হত্যার সময় মানবিক আচরণও অন্তর্ভুক্ত।
বৈশ্বিক হালাল খাবারের বাজার ২০২১ সালে ১.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে, এ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এর পেছেনে রয়েছে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি অমুসলিমদের মধ্যে হালাল খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি। হালাল খাবারের প্রতি আগ্রহ সাধারণত খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যমান এবং নৈতিক ভোজনের চর্চা সম্পর্কে সচেতনতার কারণে বাড়ছে। এর বাইরে হালাল খাবার বিশেষত তাদের জন্য আকর্ষণীয় বিকল্প, যাদের খাদ্যাভ্যাস সীমিত অথবা যারা এমন পণ্য চান যা উচ্চ নৈতিকমান মেনে চলে।
বাংলাদেশের জন্য হালাল খাবারের বাজার একটি বিশাল সুযোগ। ১৭০ মিলিয়নের বেশি জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশে মুসলিম জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে হালাল খাবারের চাহিদা বিপুল। এছাড়া বাংলাদেশ আঞ্চলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং এমনকি উত্তর আমেরিকার মতো আন্তর্জাতিক বাজারগুলোতে হালাল পণ্য রপ্তানির জন্য কৌশলগতভাবে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সহযোগিতা
বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া বিভিন্ন খাতে দীর্ঘদিনের সহযোগিতার ইতিহাস রয়েছে। এর মধ্যে ব্যবসা, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত। দুই দেশই বিশেষভাবে খাবার শিল্পে হালাল পণ্য এবং সেবা উন্নয়নে একযোগ কাজ করছে। মালয়েশিয়া বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ হালাল রপ্তানিকারক দেশ, বাংলাদেশকে হালাল খাবার বাজার সম্প্রসারণে উপযুক্ত অংশীদার।
‘রিভার্স লিঙ্কেজ প্রকল্প’ বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার মধ্যকার এক ধরনের সহযোগিতা। এর লক্ষ্য বাংলাদেশের হালাল ইকোসিস্টেমের উন্নয়ন, বিশেষভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আরও সক্ষম করা, যাতে এটি দ্রুত এবং দক্ষভাবে হালাল সনদ প্রদান করতে পারে। হালাল সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এটি গ্রাহকদের নিশ্চয়তা দেয়- পণ্যটি ইসলামি আইন অনুযায়ী প্রস্তুত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের হালাল খাবারের খাতে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যেমন হালাল সনদ প্রদান প্রক্রিয়ায় মানসম্মত নিয়মের অভাব, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং হালাল প্রথার বিষয়ে সীমিত জ্ঞান।
রিভার্স লিঙ্কেজ প্রকল্প হতে পারে গেম চেঞ্জার
রিভার্স লিঙ্কেজ প্রকল্পটি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা এবং সেরা চর্চা বিনিময়ের মাধ্যমে একটি সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা। প্রকল্পটির লক্ষ্য ইসলামি ফাউন্ডেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি, যাতে এটি আরও দক্ষভাবে হালাল সনদ প্রদান করতে পারে। এটি বাংলাদেশের হালাল খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াকে উন্নত করারও লক্ষ্য রাখে, যাতে পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক হালাল মান অনুসরণ করা হয়।
প্রকল্পটির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো- একটি পূর্ণাঙ্গ হালাল সনদ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা আন্তর্জাতিক সেরা চর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে যে, বাংলাদেশে তৈরি পণ্যগুলো সর্বোচ্চ হালাল উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মান অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে। প্রকল্পটি স্থানীয় উৎপাদকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করবে, যাতে তারা তাদের কার্যক্রমে হালাল প্রথা অনুসরণ করতে পারে।
হালাল সনদের ভূমিকা
হালাল সনদ একটি অপরিহার্য উপাদান, যা বাংলাদেশের হালাল খাবার শিল্পের পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মুক্ত করতে সহায়ক। হালাল সনদ প্রদান প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া, উপাদান সংগ্রহ থেকে শুরু করে উৎপাদন এবং প্যাকেজিং পর্যন্ত পরীক্ষা ও যাচাইকরণ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এটি নিশ্চিত করে যে, চূড়ান্ত পণ্যটি ইসলামি আহারের নিয়ম মেনে তৈরি হয়েছে এবং গ্রাহকের প্রত্যাশা পূর্ণ করছে।
বাংলাদেশের জন্য, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হালাল সনদ প্রাপ্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে রপ্তানি হওয়া খাদ্যপণ্যের জন্য হালাল সনদ বাধ্যতামূলক। যদি বাংলাদেশের কোনো নির্ভরযোগ্য এবং মানসম্মত হালাল সনদ ব্যবস্থা না থাকে, তবে বাংলাদেশি পণ্যগুলো এই বাজারগুলোতে প্রবেশ করতে সমস্যায় পড়বে।
মালয়েশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের সনদ প্রদান প্রক্রিয়া সুশৃঙ্খল এবং উন্নত হতে পারে। মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠিত সনদ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারবে যে, তার পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক হালাল মান পূর্ণ করছে, যা সেগুলোকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।
টেকসই হালাল ইকোসিস্টেম গঠন
সনদ প্রাপ্তির বাইরেও বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী হালাল ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা কয়েকটি মূল উপাদান অন্তর্ভুক্ত করবে-
অবকাঠামো উন্নয়ন: বাংলাদেশকে হালাল খাদ্য উৎপাদন সমর্থন করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে হবে। যেখানে হালাল প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট এবং সংরক্ষণ সুবিধা থাকবে।
গবেষণা ও উদ্ভাবন: হালাল খাবার শিল্প ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হচ্ছে। নতুন পণ্য এবং উদ্ভাবন নিয়মিতভাবে বাজারে আসছে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য গবেষণা এবং উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।
গ্রাহক সচেতনতা: হালাল খাবারের জন্য গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। জনসাধারণকে হালাল সনদের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ানো যায়।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: বাংলাদেশ সরকারের উচিত বিশেষায়িত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বে কাজ করে হালাল শিল্পের উন্নয়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।
রপ্তানি প্রচার: বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারে প্রধান হালাল খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ হতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচারের জন্য যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
উপসংহার
হালাল খাবারের শিল্প বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল সুযোগ। যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতামূলক রিভার্স লিঙ্কেজ প্রকল্প দেশের হালাল ইকোসিস্টেম উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সনদ প্রদান প্রক্রিয়া উন্নত, উৎপাদন মান বৃদ্ধি এবং গ্রাহক সচেতনতা তৈরি করে বাংলাদেশ হালাল পণ্যের বৈশ্বিক রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি প্রধান দেশ হতে পারে। সঠিক অবকাঠামো, গবেষণা এবং উদ্ভাবনে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের হালাল খাবারের শিল্পের ভবিষ্যত উজ্জ্বল এবং মালয়েশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিল্লাল বিন কাশেম: লেখক ও কলামিস্ট