মতবিরোধ ইসলাম নিষিদ্ধ কাজ
আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং মতবিরোধ করতে নিষেধ করেছেন। এ মর্মে তিনি বলেন, ‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা তো জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে ছিলে, তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত পেতে পারো।’ -সুরা আলে ইমরান : ১০৩
এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত নুমান বিন বাশীর (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দিক থেকে মুমিনদের উদাহরণ একটি দেহের মতো; যখন তার কোনো একটি অঙ্গ পীড়িত হয়, তখন তার জন্য সারাদেহ অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
কাজেই ঐক্যবদ্ধতা, মিত্রতা, একতা, মতৈক্য, পারস্পরিক দায়িত্ব পালন, সহমর্মিতা, সত্যের সমর্থন এবং মতবিরোধ ও দলাদলি পরিহার এমন এক সুরক্ষিত দূর্গ; যেখানে সমাজ আশ্রয় নেয় এবং তা সবার আশ্রয়স্থল ও নিরাপদ স্থান। এটি দ্বীনের শক্তি, পার্থিব কল্যাণ সংরক্ষণকারী, ফেতনা-ফাসাদে রক্ষাকবচ এবং শত্রুর চক্রান্ত ও ক্ষতি মোকাবেলায় সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদানকারী। মহান আল্লাহ যেভাবে সামাজিক বন্ধন, শক্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার আদেশ দিয়েছেন, তেমনিভাবে সম্পর্কচ্ছেদ, পেছনে লেগে থাকা, শত্রুতা পোষণ, মতবিরোধ, হাঙ্গামা ও খারাপ কাজের দ্বার উন্মুক্ত করতে নিষেধ করেছেন।
হজরত ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই স্বরূপ; সে তার প্রতি জুলুম করবে না ও তাকে দুশমনের কাছে সমর্পণ করবে না।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই স্বরূপ; সে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তার সঙ্গে মিথ্যা বলবে না এবং তাকে লাঞ্চিত করবে না।’ -সুনানে তিরমিজি
উল্লেখিত আয়াত ও হাদিসসমূহে মুসলিমদের পারস্পরিক হক বিনষ্ট করতে নিষেধ ও সতর্ক করা হয়েছে, যে হকগুলো বিনষ্ট করলে মুসলিমদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও মতবিরোধ সৃষ্টি করে।
মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর অন্যতম রহমত হলো, তিনি তাদেরকে সাধারণ ফেতনা থেকে সতর্ক করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা ফেতনা থেকে বেঁচে থাকো যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা জালেম শুধু তাদের ওপরই আপতিত হবে না। আর জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর।’ –সুরা আল আনফাল : ২৫
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেছেন, ‘প্রত্যেক ক্ষতিকর ফেতনার উপকরণ থেকে বেঁচে থাকা, যা মানুষকে আল্লাহর শাস্তির মুখোমুখি করবে।’
ইসলাম যেভাবে সাধারণ ফেতনা ও তার ক্ষতি থেকে সতর্ক করেছে, তেমনিভাবে বিশেষ ফেতনা থেকেও সতর্ক করেছে- যা সেই ব্যক্তির ক্ষতি করে, এমনকি জনসাধারণেরও। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা থাকার বিষয়ে শরিয়ত কঠোরভাবে সতর্ক করেছে। হজরত আবু যর (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিম জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, সে ইসলামের রুজু তার গর্দান হতে খুলে ফেললো।’ -সুনানে আবু দাউদ
হজরত ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কোনো গোমরাহির ওপর আমার উম্মতের সবাই কখনও একত্রিত হবে না। কাজেই তোমরা জামাতবদ্ধ থাকো। কেননা জামাতবদ্ধদের ওপর আল্লাহর সাহায্য রয়েছে।’ -মুজাম তাবরানি
সমাজ বিনির্মাণ এবং সামাজিক সুরক্ষা, সম্প্রীতি, শক্তি, ফেতনা-দুর্যোগে স্থিতিশীল থাকা, শত্রুর চক্রান্ত নস্যাৎ করা এবং বিপর্যয়রোধের অন্যতম মাধ্যম হলো, সালফে সালেহিনের নীতিতে শাসকবর্গের জন্য সর্বদা কল্যাণ কামনা করা এবং তাদেরকে সুপরামর্শ দিয়ে নসিহত করা। যেন সর্বদা আল্লাহর এই বাণীর বাস্তবায়ন হয়, ‘নেককাজ ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করবে।’ –সুরা আল মায়েদা : ২
এ বিষয়ে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের তিনটি জিনিস পছন্দ করেন। তিনি পছন্দ করেন যেনো তোমরা একমাত্র তারই ইবাদত করো ও তার সঙ্গে কোনো অংশীদার স্থাপন না করো। তোমরা যেনো আল্লাহর রশিকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরো ও বিভক্ত না হও এবং তোমরা যেনো তাদের শুভকামনা করো; যাদের হাতে আল্লাহ তোমাদের বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।’ -সহিহ মুসলিম
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসুলের আনুগত্য করো, আরও আনুগত্য করো তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত করো আল্লাহ ও রাসুলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাকো। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।’ -সুরা আন নিসা : ৫৯
ইসলাম যেসব বিষয়ে সতর্ক করেছে তার অন্যতম হলো, জিহ্বার স্খলন ও ধ্বংসাত্মক কথাবার্তা। কেননা কোনো কোনো কথা বা লিখনি ঐক্যে ফাটল ধরায়, বিভাজন তৈরি করে, মতবিরোধ সৃষ্টি করে, হৃদয়কে বিভক্ত করে, সত্য থেকে বিচ্যুত করে এবং বিরোধকে তীব্রতর করে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
যখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ফেতনা-ফাসাদ থেকে সতর্ক করেছেন, তখন তিনি একাধিকবার বর্ণনা করেছেন যে, মিথ্যা ও বাতিল কথাবার্তায় ধ্বংস অনিবার্য। হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘... জিহ্বার ব্যবহার তখন তরবারির আঘাতের চেয়েও মারাত্মক হবে।’ -সুনানে আবু দাউদ
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘...সে সময় মুখে কিছু বলা তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ন্যায় মারাত্মক হবে।’ -সুনানে আবু দাউদ
কাজেই উম্মতের ওপর দয়া, দ্বীনের হেফাজত ও ফেতনা নিবারণ করতে আপনারা মাওলার ইবাদত করুন ও হারাম বর্জন করে তার নৈকট্য লাভের মাধ্যমে শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির নেয়ামতকে ধরে রাখুন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতএব, তারা ইবাদত করুক এ ঘরের রবের; যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় খাদ্য দিয়েছেন এবং ভীতি থেকে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন।’ -সুরা কোরাইশ : ৩-৪