মুসলিম জনসংখ্যায় শীর্ষ পাঁচ দেশ
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলাম। প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মানুষ এক আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষী দেয়, এক আল্লাহকে সিজদা করে। মুসলমানদের ৬৬ শতাংশই এশিয়ায় বসবাস করেন। জনসংখ্যা হিসেবে এখানে শীর্ষ পাঁচ দেশের নাম উল্লেখ করা হলো-
ইন্দোনেশিয়া
প্রায় সাড়ে সতেরো শ’ দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়ায় ২৫৭ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। নিজেদের ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে তিন শতাধিক আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন রয়েছে দেশটিতে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ দেশের শতভাগ মানুষ এক ও একত্ববাদের সেতুবন্ধনে আবদ্ধ। সকাল-সন্ধ্যায় চার লক্ষাধিক মসজিদ থেকে সমস্বরে গুঞ্জরিত হয় একত্ববাদের ডাক, রেসালাতের পয়গাম। ৩০ হাজার মুসল্লি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এশিয়ার সর্ববৃহৎ মসজিদ ‘বাইতুর রহমান’ এখানেই অবস্থিত। আল ইরশাদুল ইসলামি, ইকরা এবং জমিয়াতুল খাইর নামে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কারিকুলামে প্রায় ৫০ মিলিয়ন তালিবুল ইলম সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইলমে দ্বীন শিক্ষা করে।
গরিষ্ঠসংখ্যক মুসলমান শাফেয়ি মাজহাবের অনুসারী হওয়ায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাফেয়ি মাজহাবের বইপত্রের চর্চা করা হয়। খ্রিস্টীয় ১৩ শতকে ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের বিকাশ ঘটে। যা এখন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ।
গোটা পৃথিবীর মুসলিম জনসংখ্যার শীর্ষস্থানে থেকে প্রায় ১২ শতাংশ মুসলমানকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে দেশটি। যা গড়ে ২২৯ মিলিয়নের কাছাকাছি। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ইসলামি চিন্তা-চেতনা লালন করে এমন বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠন সক্রিয় ভূমিকায় রয়েছে মুসলমানদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। যাদের মধ্যে নদওয়াতুল উলামা ইন্দোনেশিয়া, কনসালটেটিভ কাউন্সিল অব ইন্দোনেশিয়া মুসলিমস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পাকিস্তান
পাকিস্তানে প্রায় ২০ কোটি লোকের বসবাস। যার প্রায় ৯৭ শতাংশ মুসলমান। বেশিরভাগই সুন্নি মুসলমান। তবে অন্যান্য মুসলিম দেশের বিচারে শিয়াদের সংখ্যাও কম নয়। জানা যায়, ইরানের পর সব থেকে বেশিসংখ্যক শিয়ার অবস্থান পাকিস্তানেই। এ ছাড়া আহমদিয়া মুসলিম জামাত এবং বেশ কিছু সুফিবাদী ধর্মতত্ত্বের অনুসারীও রয়েছে। ভারত বিভক্তির মধ্য দিয়েই মূলত পাকিস্তানে মুসলমানদের উত্থান ঘটে। ২৫ লাখ মসজিদে পরিবেষ্টিত এই দেশকে মসজিদের দেশ বলা হয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট মতে, ২০০৯ সালে পাকিস্তানে সরকারি নিবন্ধিত মাদরাসার সংখ্যা ছিল ১২ হাজার এবং চলতি বছর এপ্রিলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পক্ষ থেকে সরকারি খরচে ৩০ হাজার মাদরাসা করার ঘোষণা করা হয়। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া পাকিস্তানের আওতাধীন এই মাদরাসাগুলোতে দেওবন্দি কারিকুলামে মাজহাবে হানাফিভিত্তিক পাঠদান করানো হয়। যার মধ্যে দারুল উলুম হক্কানিয়া, দারুল উলুম করাচি, জামিয়া আশরাফিয়া, জামিয়াতু উলুমিল ইসলামিয়া বিন্নুরি টাউন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশ্বব্যাপী গোটা মুসলিম জনসংখ্যার ১১ শতাংশ মুসলমানের বসবাস এই ভূমিতে, যা প্রায় ২০০ মিলিয়নের কাছাকাছি।
ভারত
জনসংখ্যার বিচারে চীনের পর সব থেকে বেশি মানুষের বসবাস ভারতে। পাহাড়, নদী, সাগর পরিবেষ্টিত এই অনন্য সুন্দর লীলাভূমিতে প্রায় ১.৪০ মিলিয়ন মানুষের বসবাস। যার প্রায় ১৬ শতাংশ মুসলমান। ১৫ হিজরিতে হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে হিন্দুস্তানের বাতাসে পবিত্র কালেমার সুরের মূর্ছনা তুলতে থাকে একত্ববাদের ঝাণ্ডাবাহীরা। পরবর্তী সময়ে ১৭ বছরের ইমানি চেতনায় উজ্জীবিত যুবক মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে এই পুণ্যভূমি মুসলমানদের হস্তাধীন হয়। তিন লক্ষাধিক মসজিদের মিনার ‘আশহাদুআল্লাইলাহা’র ধ্বনিতে দৈনিক পাঁচবার ধ্বনিত হয়। প্রাচীন মুসলিম ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য মুসলিম স্থাপনা। যার মধ্যে দিল্লি জাসে মসজিদ দিল্লি, হায়াত বকশি হায়দারাবাদ এবং আগ্রার তাজমহল অন্যতম।
বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দসহ অসংখ্য ইসলামি শিক্ষার অনন্য সাধারণ পুষ্পকানুনগুলো বিশ্ব মুসলমানের কাছে তাদের ধর্মীয় আস্থার প্রতীক। পৃথিবীর অর্ধশতাধিক দেশে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি-আদর্শের অনুকরণে দেওবন্দি কারিকুলামে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় অনুশাসন না থাকলেও শাস্ত্রীয় চর্চা এবং আধ্যাত্মিকতার বিকাশে হিন্দুস্তানের মুসলমানদের অবস্থান অনেক মুসলিম দেশকে ছাড়িয়ে আছে। একথা দাবি করলেও অমূলক হবে না যে, পুরো উপমহাদেশের প্রধান প্রধান ধর্মীয় কার্যক্রমগুলো যেমন- তালিম, তাবলিগ, তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধির মেহনতের নির্মল প্রস্রবণ ধারা হিন্দুস্তানের এই পুণ্যভূমি থেকেই প্রবাহিত। এছাড়া এমনসব বরেণ্য ইসলামি মনীষীর স্বাক্ষর আঁকা রয়েছে এ মাটিতে, যার একজনও ভারতের ইসলামি গৌরব রক্ষার যথার্থ উপমা হতে পারেন।
বিশ্ব মুসলিম জনসংখ্যার ১১ শতাংশ মুসলমানের আবাস ভারতে। যা প্রায় ১৮৯ মিলিয়নের কাছাকাছি। পিও রিচার্স সেন্টারের গবেষণা মতে, সম্ভাবনাময় মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভারত রয়েছে দুই নম্বরে। ২০৬০ সাল নাগাদ ভারতের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী হতে পারে মুসলমান।
বাংলাদেশ
বিশ্ব মুসলিম পরিবারের বৃহৎসখ্যক মুসলমান যেসব দেশে বসবাস করছে তার চার নম্বরে রয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি মানুষের বসবাস। যার ৯২ শতাংশ মুসলমান। হজরত শাহজাহান, শাহ পরান ও হাজি শরীয়াতুল্লাহর সময় এ দেশে ৬২০ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের সূর্য উদিত হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক টানাপড়েনের পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়।
দেশব্যাপী দুই লাখ ৫০ হাজারের বেশি মসজিদের মধ্যে শুধু ঢাকা শহরে রয়েছে পাঁচ হাজার ৭৭৬টি মসজিদ। যাকে মসজিদের শহর বলা হয়। ষাট গম্বুজ, বাঘা মসজিদসহ অন্য ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো এ দেশের প্রাচীনতম মুসলিম ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন।
ধর্মীয় শিক্ষার বৃহত্তর অংশ পরিচালিত হয় দেওবন্দি কারিকুলামে, কওমি মাদরাসাভিত্তিক পাঠ্যসূচির মাধ্যমে। দেশের সর্ববৃহৎ কওমি শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের অধীন ১০ সহস্রাধিক মাদরাসা রয়েছে। এর আগে কওমি শিক্ষাব্যবস্থার কোনো সরকারি স্বীকৃতি না থাকলেও বর্তমান সরকার একে মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি দান করেছে। এছাড়া সরকারি আলিয়া মাদরাসা ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি রয়েছে বেশ কয়েকটি।
বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামাতের বার্ষিক বিশ্ব ইজতেমা এ দেশেই টঙ্গিতে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া বেশ কিছু অরাজনৈতিক ইসলামি সংগঠন মুসলমানদের ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও মূল্যবোধের বিকাশে তৎপর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পৃথিবীর গোটা মুসলিম পরিসংখ্যানের ৯.২ শতাংশ মুসলমানের বসবাস ছোট্ট এই দেশটিতে। যা গড়ে ১৫৩.৭ মিলিয়নের কাছাকাছি।
নাইজেরিয়া
পৃথিবীর জনবহুল ১০ দেশের তালিকার সাত নম্বরে রয়েছে নাইজেরিয়া। পৃথিবীর একাদশতম সুদীর্ঘ নাইজার নদীর নামকরণে এ দেশের নাম নাইজেরিয়া রাখা হয়। জাত-প্রজাত বৈচিত্র্যে প্রায় ২৫০ ধরনের আদিবাসীর বসবাস আফ্রিকার সর্ববৃহৎ দেশ নাইজেরিয়ায়।
পাঁচ শতাধিক আঞ্চলিক ভাষায় এ দেশের মানুষ নিজেদের ভাব আদান-প্রদান করে। দেশের টোটাল জনসংখ্যা ১৯৪ মিলিয়ন। খ্রিস্টান একাদশ শতাব্দীতে হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফত আমলে আফ্রিকা বিজয়ী উকবা বিন নাফে (রা.)-এর হাত ধরে এ দেশে ইসলামের প্রভাত রবি উদিত হয়, যা এখন দেশের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীর হৃদয়ের স্পন্দন।
ধর্মীয় চর্চার স্বতন্ত্র কোনো শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন না থাকলেও মিশ্র শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এর ঘাটতি কিছুটা পূরণ হয়। তবে তাতে ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতির উপস্থিতি খুবই কম। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল, অব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতাও এর অন্যতম কারণ হতে পারে। বিশ্ব মুসলিম পরিবারের ৫ শতাংশ মুসলমান এ দেশেই রয়েছে, যা প্রায় ১০০ মিলিয়নের কাছাকাছি।