মানুষের যেসব গুণ আল্লাহ পছন্দ করেন

  • মাওলানা আবদুল হালিম, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন

নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন

হজরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন আল্লাহতায়ালা তার কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তিনি তখন ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.) ডেকে পাঠান এবং বলেন, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসি তাই তুমিও তাকে ভালোবেসো। এরপর থেকে হজরত জিবরাইল (আ.) সেই বান্দাকে ভালোবাসতে শুরু করে। তারপর হজরত জিবরাইল (আ.) যখন অন্য সব ফেরেশতাকে জানিয়ে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন সব ফেরেশতা সেই বান্দাকে ভালোবাসতে শুরু করে। পৃথিবীর মানুষদের মাঝেও ওই বান্দার জন্য ভালোবাসা তৈরি করে দেওয়া হয়।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম

প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানই ভয়, ভালোবাসা, তাকওয়া এবং আশার জায়গা থেকে মহান আল্লাহর ইবাদত করেন। আল্লাহর অসন্তোষ এবং রাগকে ভয় পান। বরং তার করুণা, রহমত এবং ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা রাখেন। আল্লাহতায়ালা মানুষকে যে অগণিত নেয়ামত দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন, তার জন্যও আমরা তাকে ভালোবাসি। আল্লাহকে ভালোবাসা ঈমানের দাবি। শুধু তাই নয়, আমরা তাই ভালোবাসি যা আল্লাহ ভালোবাসেন। আর তিনি যা অপছন্দ করেন, আমরা তাই অপছন্দ করি। আমরা প্রতিনিয়ত আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টা করি। এমন সব গুণাবলি আমাদের ধারণ করা উচিত, যেগুলো আল্লাহ ভালোবাসেন। কেননা তার ভালোবাসার বদৌলতেই আমরা সফলতা ও নেয়ামত লাভ করতে পারব। এখানে সংক্ষেপে কিছু মানবিক গুণাবলিকে নিয়ে আলোচনা করা হলো, যেগুলো আল্লাহতায়ালা নিজেও অত্যধিক ভালোবাসেন।

বিজ্ঞাপন

অনুতপ্ত হওয়া ও তওবা করা
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন।’ –সুরা আল বাকারা : ২২২

আল্লাহতায়ালা সবসময় সেই বান্দাদেরকে ভালোবাসেন যারা অনুশোচনায় ভোগে এবং যারা নিয়মিত তওবা করে। ভুল করেও যারা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট প্রত্যাবর্তন করে তারাই আল্লাহর পছন্দের বান্দা। কেননা, আল্লাহতায়ালা ক্ষমাশীল এবং তিনি ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। কে কতবার অন্যায় করলো, তার পাপের গভীরতা কতটুকু আল্লাহ তা বিবেচনা করেন না। বান্দা যদি গোনাহ করার পর অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর নিকট একনিষ্ঠতার সঙ্গে ফিরে আসে, তাহলেই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।

বিজ্ঞাপন

হাদিসে আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি কেউ একটি গোনাহ করে এবং তারপর আল্লাহর কাছে বলে, হে আমার খোদা, আমি পাপ করেছি, আমায় মাফ করে দাও। তাহলে আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা এতটুকু অন্তত জানে যে, একজন খোদা আছে যে গোনাহ মাফ করে আর মাফ না চাইলে গোনাহের জন্য শাস্তি দেয়। যেহেতু সে তার রবের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, তাই আমি তাকে মাফ করে দিলাম। তারপর সেই বান্দা কিছু সময় গোনাহ থেকে বিরত থাকার পর এরপর আবার গোনাহ করে। তারপর আবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে, হে আমার রব, আমি আবারও গোনাহ করে ফেলেছি। দয়া করে আমায় মাফ করে দিন। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা যেহেতু জানে যে, একজন খোদা আছে যে গোনাহ মাফ করে আর মাফ না চাইলে গোনাহের জন্য শাস্তি দেয়। যেহেতু সে তার রবের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, তাই আমি তাকে মাফ করে দিলাম। তারপর সেই বান্দা কিছু সময় গোনাহ থেকে বিরত থাকার পর এরপর আবার গোনাহ করে। তারপর আবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে, হে আমার রব, আমি আবারও গোনাহ করে ফেলেছি। দয়া করে আমায় মাফ করে দিন। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা জানে যে, তার গোনাহ মাফ করার জন্য একজন খোদা আছে। তাই সে তার রবের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, তাই আমি তাকে মাফ করে দিলাম। তার যা পছন্দ সে তাই করতে পারে।’ –সহিহ বোখারি

স্বাভাবিকভাবে, একজন মানুষ গোনাহ করতেই পারে। এরপর তার উচিত হলো- আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া এবং নেক আমলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া। কেননা, নেক আমল দিয়েই তার যাবতীয় পাপাচার ধুয়ে মুছে যাবে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়ে কেউ যেন ক্লান্ত না হয়ে যায়। মানুষকে নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর দরবারে ক্ষমার আবেদন করতে হবে।

বিশুদ্ধতা
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে বেশি ভালোবাসেন যারা নিয়মিতভাবে তওবা করে এবং নিজেদেরকে বিশুদ্ধ রাখার চেষ্টা করে।’ –সুরা আল বাকারা : ২২২

আল্লাহতায়ালা সেই বান্দাকে বেশি পছন্দ করেন, যিনি অপবিত্র বা খারাপ কোনো বিষয় থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। যিনি বড় ও ছোট সব ধরনের গোনাহ থেকে নিজেকে পবিত্র রাখেন। নিজেকে শুদ্ধ রাখার আরেকটি উপায় হলো- শিরক ও অন্যন্য পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখা।

ন্যায়নিষ্ঠতা ও তাকওয়া
‘অবশ্যই আল্লাহ সাবধানীদের ও ন্যায়নিষ্ঠ বান্দাদেরকে পছন্দ করেন।’ -সুরা তওবা : ৪

এই গুণটিকে আমরা কখনও খোদাভীরুতা, কখনও পুণ্যময় কাজ হিসেবে অভিহিত করি। তাকওয়া হলো- সেই মানবিক গুণাবলি, যা বান্দাকে আল্লাহর পছন্দনীয় কাজ করতে এবং অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। তাকওয়া এভাবেই মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে হেফাজত করে।

আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন

 

সততা এবং নিজের ভালো কাজগুলোকে নিখুঁত করা
‘যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে। বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন।’ –সুরা আলে ইমরান : ১৩৪
বর্ণিত আয়াতে আমরা চারটি কাজের সন্ধান পাই। যেগুলো আল্লাহপাক খুবই পছন্দ করেন। এগুলো হলো-

ক. অনুকূল সময়ে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা।
খ. প্রতিকূল অবস্থাতেও আল্লাহর পথে ব্যয় করা
গ. রাগ দমন করা। একবার হজরত সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ আল সাকাফি (রা.) হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন কিছু বলুন, যার দ্বারা আমি উপকৃত হবো। যা আমাকে আরও বেশি কার্যকর ও শক্তিশালী করবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন, রেগে যেও না। তাহলেই তুমি জান্নাতে যাওয়ার পথ খুঁজে পাবে।’ -আল তাবারানি
ঘ. মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়া। আমরা মানুষের ভুল-ত্রুটিগুলোকে অগ্রাহ্য করার মাধ্যমে মানুষকে ক্ষমা করতে পারি। ক্ষমা করা পরোক্ষভাবে রাগ দমনের সঙ্গে সম্পর্কিত। রাগ সংযত করা উত্তম। তার চেয়েও উত্তম হলো, মানুষকে ক্ষমা করা এবং তার জন্য কল্যাণ কামনা করা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সবচেয়ে উত্তম হলো- তারাই যারা মানুষের জন্য উপকারী ও কল্যাণকামী। -আল মুজাম আল আওসাত

আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা
‘অতঃপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসা করুন। আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।’ –সুরা আলে ইমরান : ১৫৯

হজরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহর ওপর সঠিকভাবে ভরসা রাখতে পারো, তাহলে তিনি তোমাদেরকে সেভাবেই তার প্রতিদান দেবেন; যেভাবে তিনি সেই পাখিটিকে প্রদান করেন। যে সকালবেলা খালি মুখে বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যায় ভরা খাবার নিয়ে নীড়ে ফিরে আসে।’ -তিরমিজি

ন্যায়বিচার
‘যদি ফয়সালা করেন, তবে ন্যায়নিষ্ঠভাবে ফয়সালা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন।’ –সুরা আল মায়েদা : ৪২

ইসলাম সবার প্রতি সুবিচার করার তাগিদ দিয়েছে। মুসলিম-অমুসলিম কেউ যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়, ইসলাম তা নিশ্চিত করেছে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, জাত নির্বিশেষে সকলেরই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

ধৈর্য
‘আর যারা সবর করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৪৬
ধৈর্যের অনেকগুলো রূপ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো-

প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্যধারণ
কোনো ব্যক্তি কোনো বাজে অবস্থায় পড়লেই তার অভিযোগ করা বা হতাশ হওয়া উচিত নয়। বরং তার উচিত আল্লাহর ফায়সালাকে মেনে নেওয়া এবং কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সবরের মাধ্যমে মোকাবেলা করা।

আল্লাহর হুকুম পালনে ধৈর্যধারণ
নামাজ পড়ার সময়, রোজা পালনের সময় তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। অস্থিরতাও কাম্য নয়। ঠিক একইভাবে জাকাত আদায় করা বা হজ পালনের সময়ও মাথা ঠাণ্ডা রাখা খুব প্রয়োজন। এভাবে প্রতিটি ইবাদতের সময়ই অস্থিরতা, উত্তেজনা ও তাড়াহুড়োকে পরিহার করে বরং ধৈর্যধারণে তৎপর হওয়া দরকার।

পাপ থেকে বিরত থাকতেও ধৈর্য প্রয়োজন
মদ, জুয়াসহ নানাবিধ পাপাচার কিংবা অন্য অনেক খারাপ ও নিষিদ্ধ কাজ করার সুযোগ আমাদের সামনে আসবে। এগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখার জন্য ধৈর্য প্রয়োজন।

এ রকম আরও অনেক গুণাবলি আছে যা ঈমানদার হিসেবে আমাদের অর্জন করার জন্য প্রতিনিয়তই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত।