ইসলামের বিধানে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান

  • ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ইসলামের বিধানে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান

ইসলামের বিধানে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান

জন্মের পরপর জীবন্ত নবজাতককে রাস্তায় বা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো নবজাতক শিয়াল-কুকুরের খাবারে পরিণত হচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে বিয়েবহির্ভূত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। ফলে এই নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়ে গেছে, তেমনি বেড়ে গেছে জীবন্ত নবজাতককে ফেলে দিয়ে সব দায় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ঘটনা।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত ৬ বছরে ২১০ জন নবজাতককে পরিত্যক্ত ও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এরমধ্যে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম ১০ দিনেই উদ্ধার করা হয় ২০ নবজাতকের মরদেহ। জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করা হয় বলে ফোরাম জানিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে ছয়টি ছোটমণি নিবাসে ২০১৭ হতে ২০২১ পর্যন্ত চার বছরে ১০ হাজার ৮৯৮ জন পরিত্যক্ত শিশু আশ্রয় পায়। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি পরিত্যক্ত শিশু পাওয়া যায় চট্টগ্রামে ৩ হাজার ১৬২ জন। তারপর সিলেটে ২ হাজার ৪৭৪ জন। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা ১ হাজার ৫৩৬ জন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, করোনাকালে পরিত্যক্ত শিশুপ্রাপ্তি চট্টগ্রামে ২১ শতাংশ, সিলেটে ১৯ শতাংশ এবং ঢাকাতে ২৫ শতাংশ বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ আধুনিকতার দিকে যতই যাচ্ছে ততই বাড়ছে এ ধরনের ঘটনা। কারণ আধুনিকতা গতিশীল হলেও দেশে নেই তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। তাই কারা শিশুদের ফেলে দিচ্ছে তা খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। শুধু বাংলাদেশ নয়, বর্তমান বিশ্বে এজন চিত্র ক্রমাগত বেড়ে চলছে। নারী-পুরুষের অবৈধ মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম হয়, মার্জিত ভাষায় ওই সন্তানকে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান বলে আখ্যা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে ইসলাম কী বলে? ইসলামে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের স্বীকৃতি, লালন-পালন ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে বিস্তারিত বিধান রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সন্তানের বৈধতার ভিত্তি
শরিয়তে সন্তানের বৈধতার মূল ভিত্তি হলো- স্বামী-স্ত্রীর বৈধ বিয়ে। বিয়ের সঙ্গে মানুষের বংশপরম্পরার সম্পর্কের উৎস নির্ধারিত। তাই অমুসলিমদের সন্তানও তাদের ধর্মমতে বৈধ বিয়ের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করলে তাকে বৈধ সন্তান আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মুসলিমদের জন্যই শুধু ইসলামিক পদ্ধতিতে বৈধ বিয়ে হওয়া শর্ত, অমুসলিমদের জন্য ইসলামি পদ্ধতিতে বিয়ে জরুরি নয়। এখানে আমরা দেখতে পাই, ইসলামে মানবসন্তানের বংশ সংরক্ষণের প্রতি সবিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে যে অমুসলিমদের নিজ নিজ ধর্মীয় বিয়েকেও ইসলাম বৈধতার সনদ দেয়। -মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : ১৩২৭৩, রদ্দুল মুহতার : ৩/১৮৪

বিয়ের কমপক্ষে ছয় মাস পর বাচ্চা জন্ম নিলে তা ওই স্বামী-স্ত্রীর বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হবে। তাই বিয়ের ছয় মাস পর বাচ্চা জন্ম নিলে স্বামী ওই সন্তান অস্বীকার করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে তাদের মিলন হয়েছে কি না বা কখন হয়েছে, এর হিসাবের ওপর নির্ভর করা হয়নি। কেননা তা গোপনীয় ব্যাপার। -মাবসুতে সারাখসি : ১৭/১৫৫

এমনকি বিয়ের পর যদি স্বামী ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে স্ত্রীর অবৈধ মিলনে কোনো সন্তান জন্ম হয়, ওই সন্তানের পিতৃত্বের সম্পর্কও স্ত্রীর বৈধ স্বামীর সঙ্গেই হবে। ওই মহিলার স্বামীই সন্তানের বৈধ বাবা হবে, ব্যভিচারী নয়। এ ক্ষেত্রে তাকে অবৈধ সন্তান বলা যাবে না। হাদিস শরিফে এসেছে, সন্তান বৈধ স্বামীরই গণ্য হবে, আর ব্যভিচারী বঞ্চিত হবে। -সহিহ বোখারি : ২০৫৩

ইসলাম মানবসন্তানের বংশ সংরক্ষণ ও তাকে অসম্মানের তিলক থেকে বাঁচাতে সর্বাধিক চেষ্টা করেছে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সম্ভাবনায় বৈধতা দেওয়া যায়, তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অতএব, কারো বৈধ স্বামী থাকলে ওই সন্তানকে বৈধতা দেওয়া হবে এবং ওই সন্তান বৈধ স্বামীর বলেই গণ্য হবে।

অবৈধ সন্তানের সাধারণ বিধান
সাধারণত অবৈধ সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিপালন ও ধর্মবিষয়ক প্রায় অনেক বিধান বৈধ সন্তানের অনুরূপ। কেননা, এখানে সন্তানের কোনো দোষ নেই; বরং দোষ তার মা-বাবার, তাই তার বৈধ অধিকার ইসলামে সাব্যস্ত রয়েছে। তবে কিছু কিছু বিধানে সবার চেয়ে পার্থক্যও রয়েছে।

অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের বংশ
অনাকাঙ্ক্ষিত তথা অবৈধ সন্তানের বংশ মায়ের থেকে সাব্যস্ত হবে। যেহেতু বাবা অবৈধ, তাই অবৈধ বাবার সঙ্গে সম্পর্কিত হবে না। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘সন্তান বৈধ স্বামীরই গণ্য হবে, আর ব্যভিচারী বঞ্চিত হবে।’ –সহিহ বোখারি : ২০৫৩

ভরণ-পোষণ ও লালন-পালন
লালন-পালনের অধিকারী হবে সন্তানের মা। মায়ের পক্ষ সন্তানের ভরণ-পোষণ বহন করবে। অর্থাৎ তার মায়ের ভরণ-পোষণ যাঁর দায়িত্বে, তার ভরণ-পোষণও তিনিই দেবেন।

আকিকা
মায়ের পক্ষ সন্তানের আকিকা করবে। অর্থাৎ তার মায়ের ভরণ-পোষণ যার দায়িত্বে, তার আকিকা তিনিই করবেন। তবে এসব সন্তানের আকিকার ক্ষেত্রে গোপনীয়তা উত্তম, যাতে সন্তানের মর্যাদা ক্ষুণ্ন না হয়। -হাশিয়াতুশ শারবিনি আলা তুহফাতিল মুহতাজ : ৩/৩১১

উত্তরাধিকারের বিধান
ওই সন্তানের বংশ যেহেতু মায়ের থেকে সাব্যস্ত, তাই সে মা ও মায়ের নিকটাত্মীয়দের উত্তরাধিকারী হবে। -রদ্দুল মুহতার : ৬/৭৭৬

অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের সাক্ষ্যদান
অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান যদি ন্যায়পরায়ণ হয়, তখন অন্যদের মতো তাদের সাক্ষীও ইসলামে গ্রহণযোগ্য। -তাবঈনুল হাক্বায়েক : ৪/২২৬

অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের ধর্ম
যদি অবৈধ শিশুসন্তানের মা-বাবা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের হয়, তখন উভয়ের মধ্যে যার ধর্ম উৎকৃষ্ট হবে, সন্তান তারই ধর্তব্য হবে। যেহেতু শিশুসন্তান অবুঝ, তাই মা-বাবার মধ্যে যে উৎকৃষ্ট ধর্মাবলম্বী হবে, তারই অনুসারী হবে। অতএব, যদি মা-বাবার কোনো একজন মুসলিম হয়, অপরজন অমুসলিম হয়, তাহলে সন্তান মুসলিম ধর্তব্য হবে, চাই সে মা হোক বা বাবা। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘সব সন্তান স্বভাবধর্ম ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার মা-বাবার ভুল দীক্ষায় সে ইহুদি, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজক ইত্যাদি হয়।’ –সহিহ বোখারি : ১৩৫৮

অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানকে ব্যভিচারী বলে গালি দেওয়া বৈধ নয়
অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানকে ব্যভিচারী বলে গালি দেওয়া বৈধ নয়। এমনকি কেউ যদি তাকে ব্যভিচারী বলে গালি দেয়, তাকে অপবাদ দেওয়ার শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। কেননা তার মা-বাবা অন্যায়কারী হলেও সে ওই অন্যায়ে অংশীদার নয়। -মাবসুতে সারাখসি : ৯/১২৭

মহান আল্লাহ বলেন, ‘কারো অন্যায়ের বোঝা অন্য ব্যক্তি বহন করবে না।’ -সুরা আনআম : ১৬৪

রাষ্ট্রের দায়িত্ব
সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসনের ব্যতয় ঘটে তখন অন্যায়, জুলুম, পাপাচার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে ক্ষমতাসীনরা যে ফন্দি করে তার ছিটে ফোটাও যদি ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠায় করা হতো তাহলে নবজাতক শিশুদের এভাবে ময়লার স্তূপে পড়ে থাকতে হতো না। এ ধরনের নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে রাষ্ট্র কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।