আল আকসার প্রতি ভালোবাসা ইমানের অংশ

  • মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আল আকসা কমপ্লেক্সে অবস্থিত ডোম অব রকের সোনালী গম্বুজ

আল আকসা কমপ্লেক্সে অবস্থিত ডোম অব রকের সোনালী গম্বুজ

ফিলিস্তিনে অবস্থিত বায়তুল মোকাদ্দাস বা মসজিদে আকসা মুসলমানদের প্রথম কেবলা। এটি ইসরা ও মিরাজের স্মৃতি বিজরিত পূণ্যভূমি। আল আকসার প্রতি ভালোবাসা স্থাপন ইমানের অংশ, ইবাদতের অংশ। এই মসজিদের কথা পবিত্র কোরআনে আলোচনা করা হয়েছে। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় মসজিদ। তা কোরআন মাজিদে বর্ণিত (আরদে মোকাদ্দাসসহ) বিশেষ পবিত্র জমিনে অবস্থিত। এই মসজিদের আশেপাশে অনেক নবীদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। অনেক নবী হিজরত করেছেন এই এলাকায়। এমনকি এই মসজিদে অনেক নবী ইমামতি করেছেন। বিশেষত হজরত জাকারিয়া (আ.)।

পবিত্র মেরাজের রাতে সব নবী-রাসুলদের আল্লাহতায়ালা বায়তুল মোকাদ্দাসে একত্রিত করেন কুদরতিভাবে। নবী কারিম (সা.) তখন দুই রাকাত নামাজের ইমামতি করেন।

বিজ্ঞাপন

হাশরের কেন্দ্রস্থল হবে মসজিদে আকসা ও তার আশপাশ এলাকা। এই মসজিদে প্রতি রাকাত নামাজে ২৫০ রাকাতের সওয়াব পাওয়া যায়। যেসব মসজিদে বিশেষ সওয়াবের আশায় সফর করা জায়েজ, এই মসজিদ তার একটি। এই মসজিদ ও তার চতুর্পাশ বরকতময়। এই মসজিদে দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না। এই মসজিদে নামাজ পড়লে তার গোনাহ এমনভাবে মাফ হয়, যেমন সদ্য জন্মলাভকৃত শিশু।

সেই বায়তুল মোকাদ্দাসকে বুকে ধারণ করা ফিলিস্তিন প্রায় সাত-আট দশক ধরে ইহুদিদের দ্বারা দখল হয়ে আছে। দখলদার ইসরাইলিদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে বুলেট ও মিসাইল ব্যবহার, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের কোনো তোয়াক্কা না করে দখলকৃত ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন, ফিলিস্তিনিদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ, ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও ক্ষেত-খামার ধ্বংস করা, জাতিসঙ্ঘের অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ধারাবাহিক উপেক্ষা, ইত্যাদি ঘটনা ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে। ফলে স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসসহ অন্যান্য সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ সশস্ত্র প্রতিরোধের রূপ নেয়। যা বর্তমানে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

বিজ্ঞাপন

অথচ এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষে দেওয়া প্রস্তাবে আরব পিস ইনিশিয়েটিভ (এপিআই) বা সৌদি ইনিশিয়েটিভ হতে পারে একমাত্র সমাধানের উপায়। এটি মূলত আরব-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধ করতে তৎকালীন সৌদি যুবরাজ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ কর্তৃক উত্থাপিত কিছু দাবি। ২০০২ সালের ২৭-২৮ মার্চ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে আরব লিগের ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনে এর অনুমোদন দেওয়া হয়। শীর্ষ সম্মেলনের পর অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’ শিরোনামে আরব লিগের তৎকালীন মহাসচিব আমর মুসা তা পাঠ করে শোনান।

পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, গোলান ভূমি ও লেবাননের ভূমিসহ ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত স্থান পুরোপুরি প্রত্যাহার, জাতিসংঘের ১৯৪তম ধারা মতে ফিলিস্তিন শরণার্থী সমস্যার ‘ন্যায্য নিষ্পত্তি’ ও পশ্চিম জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করাই পিস ইনিশিয়েটিভের মূলকথা। দাবিগুলো পূরণ হলে আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরিতে আর কোনো বাধা থাকবে না বলে তাতে মন্তব্য করা হয়। তবে ইসরায়েলকে ১৯৬৭ সালের সীমানায় ফিরতে বলায় তৎকালীন ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন উদ্যোগটিকে ‘নন স্টার্টার’ অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। ২০০৭ সালে আরব লিগ পিস ইনিশিয়েটিভকে আবার অনুমোদন দিলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট পরিকল্পনাকে কৌশলে স্বাগত জানান।

২০০৯ সালে ইসরায়েলের প্রতি আরব রাষ্ট্রের শান্তি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন হলে আনন্দ প্রকাশ করেন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ। তখন তিনি এ কথাও বলেন, ‘এই ইনিশিয়েটিভ প্রস্তুতকালে ইসরায়েল এর অংশীদার ছিল না। তাই এর সব শব্দের সঙ্গে একমত পোষণ আবশ্যক নয়।’

দক্ষিণ গাজা উপত্যকার রাফা শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের জানাজায় শোকার্তদের ভিড় 

 

২০১৫ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু উদ্যোগকে সমর্থন করলেও ২০১৮ সালে ফিলিস্তিনের সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনার ভিত্তি হিসেবে এটিকে প্রত্যাখ্যান করেন।

ফিলিস্তিনের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের পর মাহমুদ আব্বাসও এটি সমর্থন করেন। ফিলিস্তিনের হামাসসহ অনেক দল ইনিশিয়েটিভ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। পরবর্তী সময়ে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ৫৭টি রাষ্ট্র এবং বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও তা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। বেশ কিছু দিন আগে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব আমিরাতের স্বাভাবিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আরব পিস ইনিশিয়েটিভের আলোকে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। এর পর থেকে আবারও তা মুসলিম বিশ্বের আলোচনায় আসে। নিম্নে আরব পিস ইনিশিয়েটিভের মূলকথা তুলে ধরা হলো।

কাউন্সিল অব দ্য লিগ অব আরব স্টেটের ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনের সাধারণ অধিবেশনে উত্থাপিত ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’-এ বলা হয়, ১৯৯৬ সালের জুন মাসে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আরব শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরব রাষ্ট্রের কৌশলগত বিকল্প হিসেবে পুনর্বিবেচনা করা হয়। আর তা আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে বাস্তবায়ন সম্ভব। এতে ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি পূরণে সহায়ক ভূমিকা থাকতে হবে।

সৌদি আরবের যুবরাজ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ কর্তৃক উত্থাপিত ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’ বা শান্তি উদ্যোগে ১৯৬৭ সালের জুন মাস থেকে ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত আরব ভূমি পুরোপুরি প্রত্যাহারের কথা বলা হয়। যা ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলনে অনুমোদিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ ও ৩৩৮ ধারা বাস্তবায়ন ও শান্তির বিনিময়ে ভূমি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, পশ্চিম জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ইসরায়েলের স্বীকৃতিদানের বিনিময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যাপক শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করা হবে।

মোটকথা, সংঘাতের মাধ্যমে সামরিক সমাধান কখনো শান্তি বয়ে আনবে না কিংবা কোনো পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করার বিষয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর একাত্মতা পোষণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই অধিবেশন প্রত্যাশা করে-

এক. ইসরায়েল যেন নিজেদের নীতিগুলো পুনর্বিবেচনা করে এবং এ ঘোষণা দেয় যে ন্যায়সংগত শান্তি তাদের কৌশলগত বিকল্প নীতি।

দুই. ইসরায়েলের প্রতি আরো অনুরোধ থাকবে- ক. তারা যেন ১৯৬৭ সালের ৪ জুন থেকে সিরিয়ার গোলান ভূমিসহ ’৬৭ সালের পর থেকে দখলকৃত ভূমি পুরোপুরি প্রত্যাহার করবে। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের দখলকৃত ভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে, খ. ফিলিস্তিন শরণার্থী সমস্যার ন্যায্য সমাধান করতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ১৯৪তম ধারার প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করতে হবে, গ. ১৯৬৭ সালের ৪ জুন থেকে ফিলিস্তিনের দখলকৃত পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকায় পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তিন. ওপরের দাবিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আরব রাষ্ট্রগুলো নিম্নের বিষয়াবলি নিশ্চিত করবে- ক. আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পরিসমাপ্তি এবং এই অঞ্চলের সব রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলো শান্তিচুক্তি সম্পাদন করবে, খ. সর্বাঙ্গীণ শান্তির প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে।

চার. আয়োজক আরব রাষ্ট্রগুলোর বিশেষ পরিস্থিতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ফিলিস্তিনের সব ধরনের জাতীয়তাবোধ প্রত্যাখ্যানের নিশ্চয়তা প্রদান করবে।

পাঁচ. শান্তির সম্ভাব্য পথ অবলম্বনে রক্তপাত বন্ধে করতে ইসরায়েল সরকার ও ইসরায়েলবাসীকে কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগটি গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়। এতে আরব রাষ্ট্রগুলো ও ইসরায়েল নিরাপদে ও উত্তম প্রতিবেশী হয়ে বসবাস করতে পারবে এবং পরবর্তী প্রজম্মকে নিরাপদ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ প্রদান করতে পারবে।

ছয়. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সব রাষ্ট্র ও সংস্থাকে এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

সাত. এই শীর্ষ সম্মেলনের সভাপতির কাছে আবেদন করা হয়, যেন তিনি আগ্রহী সদস্য রাষ্ট্র ও আরব লিগ মহাসচিবের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেন, যারা জাতিসংঘ, নিরাপত্তা পরিষদ, যুক্তরাষ্ট্র, রুশ ফেডারেশন, মুসলিম রাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ অন্যদের কাছ থেকে এই উদ্যোগের সব রকম সমর্থন আদায়ে জরুরি যোগাযোগ সম্পন্ন করবে।