গৃহকর্মীদের প্রতি আচরণ বিষয়ে ইসলাম যা বলে
গৃহকর্ম পৃথিবীর প্রাচীন পেশাসমূহের একটি। বিশাল জনগোষ্ঠী গৃহাভ্যন্তরে তাদের শ্রম বিনিয়োগ করে। তাদের অনেকেই গৃহকর্তা কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়। পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গৃহশ্রমিক নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। সরকারি উচ্চপর্যায়েরর কর্মকর্তা, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তা, ডাক্তার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, এনজিও কর্মী, খেলোয়াড় এবং চিত্রনায়িকার বাড়িতেও ঘটেছে গৃহকর্মী নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার পায় না ভুক্তভোগী দরিদ্র-অসহায় পরিবার।
অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গৃহশ্রমের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়- গৃহশ্রমিককে সার্বক্ষণিক বিভিন্ন প্রকৃতির শ্রম দিতে হয়। ফলে শ্রমিককে কাজ করতে গৃহ মালিকের বাড়িতেই অবস্থান করতে হয়; গৃহকর্মীদের ঘুমানোর জন্য (গৃহ মালিকের বাড়িতে) কোনো নিরাপদ নির্ধারিত স্থান থাকে না। গৃহশ্রমিকের মালিকের ঘরের মেঝেতে বা পরিত্যক্ত কোনো অরক্ষিত ঘরে বা ঘরের অনিরাপদ বারান্দায় থাকার ব্যবস্থা হয়। এক্ষেত্রে তাদের মানবিক মর্যাদার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হয় না; গৃহ মালিক কর্তৃক পুরনো থালা বাসন গ্লাসে সর্বশেষ ও নিম্নমানের কম পরিমাণ খাবার দেওয়া হয়; গৃহ শিশু শ্রমিককে শোয়ার বিছানা, চাদর, পরিধানের বস্ত্র পুরনো, অপরিচ্ছন্ন, পরিত্যক্ত ও অপরিষ্কার খাবার দেওয়া হয়। শ্রমে বা কাজে যোগ দেওয়ার অধিকার থাকলেও শ্রম থেকে অব্যাহতি পাওয়ার অধিকার থাকে না।
মালিকের বাড়িতে অসুবিধা হলে শ্রমিককে পালিয়ে গিয়ে অব্যাহতি নিতে হয়। গৃহ মালিকের পরিবারের সদস্যগণের নিকট থেকে গৃহকর্মীরা সাধারণত মানবিক আচরণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়; কোনো অনুষ্ঠান, ধর্মীয় বা সামাজিক পর্বে নিম্নমানের নতুন কাপড় দেওয়া হয়; গৃহকর্মে শিশুদের নিয়োগে গৃহকর্তাদের বিশেষ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। কারণ শিশু শ্রমিকরা বাধ্য ও অনুগত থাকে এবং পরিবারের সকলের নির্দেশ নির্বিবাদে ও প্রতিবাদহীনভাবে পালন করে; বিশ্রাম, বিনোদন, অবসরযাপনের সুযোগের অভাব এবং গৃহ মালিকের শিশুসন্তানদের সঙ্গে মুক্তভাবে খেলাধুলা করার অনুমতি সীমিত; সবার পরে ঘুমাতে দেওয়া হয় এবং সবার আগে ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য করা হয়।
গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি নামে একটি নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে সরকারের মন্ত্রিসভা। এর ফলে গৃহকর্ম শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এবং সবেতনে চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছাড়া ও অন্যান্য ছুটি ভোগ করতে পারবেন গৃহকর্মীরা। এ নীতিমালা অনুমোদন পাওয়ায় শ্রম আইন অনুযায়ী গৃহকর্মীরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবেন। নীতিমালায় গৃহকর্মীদের বিশ্রামের পাশাপাশি বিনোদনের সময় দেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গৃহকর্মীদের শ্রমঘণ্টা এবং বেতন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পক্ষ ঠিক করবে।
শ্রমঘণ্টা, বিশ্রাম ও বিনোদন সম্পর্কে নীতিমালার অনুচ্ছেদ ৭.৪ এ বলা হয়েছে, প্রত্যেক গৃহকর্মীর কর্মঘণ্টা এমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে, যাতে তিনি পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন ও প্রয়োজনীয় ছুটির সুযোগ পান। গৃহকর্মীর ঘুম ও বিশ্রামের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্থান নিশ্চিত করতে হবে। গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর অনুমতি নিয়ে গৃহকর্মী সবেতনে ছুটি ভোগ করতে পারবেন।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গৃহকর্মীর মজুরি নির্ধারিত হবে। পূর্ণকালীন গৃহকর্মীর মজুরি যাতে তার পরিবারসহ সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের উপযোগী হয়, নিয়োগকারীকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে গৃহকর্মীর ভরণপোষণ, পোশাক-পরিচ্ছেদ দেওয়া হলে তা মজুরির অতিরিক্ত বলে গণ্য হবে। তবে ১২ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী রাখতে হলে তার আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতিতে নিয়োগকারীকে আলোচনা করতে হবে। তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে এই আলোচনা, চুক্তি, সমঝোতা বা ঐকমত্যের সময় নিয়োগের ধরন, তারিখ, মজুরি, বিশ্রামের সময় ও ছুটি, কাজের ধরন, থাকা-খাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছেদ এবং গৃহকর্মীর বাধ্যবাধকতা এসব বিষয়ের উল্লেখ রাখতে বলা হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, অসুস্থ অবস্থায় কোনো গৃহকর্মীকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। নিয়োগকারীকেই নিজের অর্থে গৃহকর্মীর চিকিৎসা করাতে হবে। এছাড়া গৃহকর্মীকে তার নিজের ধর্ম পালনের সুযোগ দিতে হবে। কর্মরত অবস্থায় কোনো গৃহকর্মী দুর্ঘটনার শিকার হলে চিকিৎসাসহ ক্ষয়ক্ষতির ধরণ অনুযায়ী নিয়োগকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ইসলামে গৃহকর্মীদের অধিকার ও মর্যাদা কতটুকু, তা আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের আগে দেওয়া শেষ উপদেশ থেকেই বুঝে আসে। নবীজি (সা.) যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন উম্মতকে সতর্ক করে বলে গিয়েছিলেন, ‘তোমরা তোমাদের গৃহকর্মীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করো। কেননা তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার দুর্ভাগ্যের কারণ।’ -সুনানে আবু দাউদ
ইসলামি শরিয়তের চাহিদা হলো, কাজ-কর্মে গৃহকর্মীদের সঙ্গে কঠোরতা প্রদর্শন না করে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা। হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি ১০ বছর যাবৎ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেবা করেছি। আল্লাহর কসম! তিনি কখনো আমার বেলায় ‘উহ’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি (অসন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ করেননি)। অথবা কখনো আমাকে কোনো কাজের জন্য এতটুকুও বলেননি যে, কেন এমনটা করেছ? কেন এমন করনি?’ -সহিহ মুসলিম
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার এক ব্যক্তি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি আমার গৃহকর্মীকে কতবার ক্ষমা করব? নবী কারিম (সা.) তার প্রশ্নে চুপ থাকলে সে আবারও একই প্রশ্ন করে। তখনো তিনি চুপ থাকেন। লোকটি তৃতীয়বার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, তোমরা তাদের প্রতিদিন সত্তর বার ক্ষমা করবে।’ -সুনানে আবু দাউদ
শান্তির ধর্ম ইসলামে গৃহকর্মীর (চাকর ও কর্মচারী) অধিকার সংরক্ষিত। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। তাই গৃহকর্মী ও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের হক যথাযথভাবে আদায় করা আমাদের সবার দায়িত্ব।