যেসব কারণে মক্কা-মদিনা মর্যাদাবান
বিশ্বের প্রথম নগরীদ্বয় পবিত্র মক্কা ও মদিনা হলো- অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্মানের অধিকারী। এ সম্মান সে এমনিতেই পায়নি। আল্লাহতায়ালা মক্কার হারাম শরীফকে সম্মানিত তথা মর্যাদাবান ঘোষণা করেছেন বলেই মক্কার হেরেমের এ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মক্কার এ অবস্থান সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘এ কথা নিঃসন্দেহ যে, মক্কায় অবস্থিত ঘরখানাকেই মানুষের ইবাদতের ঘর হিসেবে সর্বপ্রথম তৈরি করা হয়েছে।’ -সুরা আলে ইমরান : ৯৬
মহান রাব্বুল আলামিনের এ ঘোষণা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, মক্কায় অবস্থিত মানুষের প্রথম ইবাদতখানা হওয়ার কারণেই তার এত মর্যাদা। এ ঘরের মর্যাদা ও গুরুত্ব বর্ণনা করে আল্লাহতায়ালা আরো ঘোষণা করেন, ‘উহাকে কল্যাণ ও মঙ্গলময় করে দেওয়া হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াত লাভের কেন্দ্র বানানো হয়েছিল উহাতে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ রয়েছে।’ -সুরা আলে ইমরান : ৯৭
আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীর খলিফা বা প্রতিনিধি করে সৃষ্টি করেছেন। এ মানুষ আল্লাহর দাসত্ব মেনে তার দেওয়া বিধান বাস্তবায়ন করবে এটাই হলো- আল্লাহর ইবাদত বা দাসত্ব। আল্লাহর ইবাদতের কর্মকেন্দ্র হলো কাবাগৃহ বা বায়তুল হারাম। যেখানে এ বায়তুল হারামের অবস্থান সেটাই হেরেম শরিফ যার মর্যাদার কথা স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করেছেন। মক্কার হেরেমের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা নবী কারিম (সা.)-এর উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘হে রাসুল! তুমি তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আমাকে এ নির্দেশই দেওয়া হয়েছে যে, এ শহরের রবের দাসত্ব করবো যিনি একে হেরেম বা মহিমান্বিত করেছেন, তিনি সব জিনিসের মালিকও বটে, আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন আমি মুসলমান হয়ে জীবন যাপন করি।’ -সুরা নমল : ৯১
এ মক্কা ভূমির হেরেমকে সেখানকার লোকদের জন্য শান্তিময় ও নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। একমাত্র হেরেমের অধিবাসীর অধিকারের জন্য সারাবিশ্বে তাদের মান মর্যাদা ছিল অজস্র। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা (কাফেররা) বলে, আমরা যদি তোমাদের সঙ্গে এ হেদায়েতের আনুগত্য স্বীকার করে নিই, তাহলে স্বদেশভূমি থেকে অকস্মাৎ বহিষ্কৃত হবো, কিন্তু এটা কি বাস্তব ঘটনা নয় যে, আমি একটি নিরাপদ ও শান্তিময় হেরেমকে তাদের অবস্থানস্থল করেছি যেখানে সব রকমের ফলফলাদি আমার পক্ষ থেকে রিজিক হিসেবে প্রতিনিয়ত এসে জমা হচ্ছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোক এটা অবহিত নয়।’ -সুরা কাসাস : ৫৭
দয়াময় আল্লাহতায়ালা মক্কার ঊষর মরু অঞ্চলে বিচিত্রময় রিজিকের চিত্র উত্থাপন করেছেন। যেখানে পাহাড় পর্বতবেষ্টিত মরুময় অত্যন্ত রুক্ষ একটি জনপদের অবস্থান সেখানে বিভিন্ন রকমের খাদ্যসামগ্রী, ফল-ফলাদি ও জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভারের এমন সমারোহের কথা কল্পনাও করা যায় না। অথচ মহান রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমত বরকতে সেখানে অব্যাহতভাবে এসব নেয়ামতের পর্যাপ্ত আমদানি হয়ে থাকে। মক্কার হেরেমের এটাও যে একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই বর্ণনা করেছেন।
এ হেরেম বা বায়তুল্লাহ শরিফে আল্লাহর বান্দা পৃথিবীর সকল মুসলমানের সমানভাবে প্রবেশাধিকার রয়েছে। এখানে ধনী-গরিব, কালো-সাদা, উঁচু-নিচু, ফকির-বাদশা, মালিক-শ্রমিক, পুরুষ ও নারীর প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ নেই। যারা এ হেরেমে প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করে মূলত তারাই যে বিশ্বে শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গকারী, মানবতাবিরোধী ও সন্ত্রাসী জনসমষ্টি তাতে আর সন্দেহের কী থাকতে পারে? যে ব্যক্তি আল্লাহকে একমাত্র রব ও মহানবীকে তার রাসুল হিসেবে মেনে নেবে তিনিই হেরেমে প্রবেশের অধিকার লাভ করবেন। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা কুফরি করেছে এবং আল্লাহর পথে চলতে বাধা দিচ্ছে এবং মসজিদে হারামে যাবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে মসজিদে হারামকে আমি সকল মানুষের জন্য তৈরি করছি এবং যেখানে স্থানীয় ও বহিরাগত লোকের অধিকার সমান, তাদের আচরণ নিশ্চিতভাবেই শাস্তি প্রদানের মত আচরণ, এতে (মসজিদে হারামে) সেই সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে জুলুমের পথ ধরবে, আমি তাকে কঠিন শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করাবো।’ -সুরা হজ : ২৫
মক্কা তথা পবিত্র হেরেম শুধু মানুষের জন্য নিরাপদ নয় এটা প্রতিটি প্রাণীর জন্যই নিরাপদ কেবলমাত্র মানুষকে কষ্ট দেয় এমন পাঁচটি জীব ব্যতিরেকে। এ প্রসঙ্গে একাধিক হাদিস বর্ণিত আছে। একটি হাদিস এ রকম- ‘হজরত হাফসা (রা.) থেকে বর্ণিত হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- (হেরেমে) কাক, চিল, ইঁদুর, বিচ্ছু ও ক্ষেপা কুকুর এ পাঁচ প্রকারের জন্তুকে কেউ হত্যা করলে কোনো দোষ নেই। -সহিহ বোখারি : ১৬৯৬
আল্লাহতায়ালা মক্কা তথা হেরেমকে এমনই সম্মানিত করেছেন সেখানে উপর্যুক্ত পাঁচ প্রকারের জীব ব্যতীত শুধু মানুষ নয় সকল জীব এমনকি অনেক উদ্ভিদের জন্যও নিরাপদ করেছেন। এ মর্মে একটি হাদিস এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেছেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন বলেছিলেন- এ শহরকে আল্লাহ মহিমান্বিত ও মর্যাদাসম্পন্ন করেছেন। এর কাঁটা (গাছকে)ও কাটা যাবে না, শিকার তাড়া করা যাবে না, রাস্তায় পড়ে থাকা জিনিসকে যে ব্যক্তি তার বলে প্রচার করবে সে ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ কুড়িয়ে নিতে পারবে না। -সহিহ বোখারি : ১৪৮৩
পবিত্র মক্কার এ মর্যাদা আল্লাহর দান, তারই বিশেষ অনুগ্রহ ও পরিকল্পনায় মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর দোয়ার কারণেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘ওই সময়ের কথা স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম এ বলে দোয়া করেছিল, হে আমার রব! এ শহরকে (মক্কা) তুমি নিরাপত্তার শহর বানাও আর আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখ। হে প্রভু! ওই সব মূর্তি বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেছে। সুতরাং তাদের মধ্যে যে আমার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করবে সে আমার পথ অনুসরণকারী হবে। যদি কেউ অমান্য করে তাহলে তুমি তো ক্ষমাশীল ও মেহেরবান। প্রভু হে! আমি একটি ঊষর মরু প্রান্তরে আমার সন্তানদের এক অংশকে তোমার মহিমান্বিত ঘরের পাশে এনে রেখে যাচ্ছি। হে রব! যাতে তারা এখানে সালাত কায়েম করে, সুতরাং ওদের প্রতি মানুষের মন আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফলমূলের খাদ্য দান করো তারা তোমার শোকরগোজার (কৃতজ্ঞ) বান্দা হতে পারে।’ -সুরা ইবরাহিম : ২৪-২৭
পবিত্র কোরআনের এ বর্ণনা থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, আল্লাহর ইচ্ছায় একটি জনমানবহীন মরুময় এলাকায় মানববসতির সূচনাসহ আল্লাহর ঘরের পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে যাবতীয় ইসলামি কর্মকান্ডের কর্মকেন্দ্র চালু করাই হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মূল লক্ষ্য ছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বহুবিধ কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তার বংশধরদের অনুকরণ ও অনুসরণের ধারাবাহিকতায় মক্কায় কাবাগৃহ ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল হেরেম বা সংরক্ষিত সম্মানিত এলাকা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। এটা আল্লাহর নির্দেশক্রমে হজরত ইবরাহিম (আ.) করেছিলেন যা অদ্যাবধি বলবত রয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এ হেরেমের সম্মানিত হবার মূল টার্গেট হলো- আল্লাহর ঘর যেখানে অবস্থিত সেখানে তার হুকুম বাস্তবায়নের কেন্দ্র হবে এবং সেখানে যেমন যাবতীয় অবৈধ কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে তেমনি এখান থেকে একমাত্র আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা তার বান্দাগণ লাভ করে তা বিশ্বময় প্রচার প্রসারের ব্রত গ্রহণ করবে।
আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর দেওয়া সে দায়িত্বেরই পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে গিয়ে অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেও শেষ পর্যন্ত জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় স্বীয় কর্মকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব সুসম্পন্ন করেন। যে জায়গাটি আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের কর্মকেন্দ্র হয় তার মর্যাদা যে পৃথিবীর সকল স্থানের চেয়ে অনেক বেশি হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এ দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় মদিনাতুল মোনাওয়ারার মর্যাদাকে আল্লাহতায়ালা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এ মর্মে নবী কারিম (সা.)-এর একটি হাদিস এভাবে এসেছে, ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, হজরত ইবরাহিম (আ.) মক্কাকে সম্মানিত ঘোষণা করেছিলেন এবং এর জন্য দোয়া করেছিলেন, সুতরাং হজরত ইবরাহিম (আ.) যেমন মক্কাকে সম্মানিত ঘোষণা করেছিলেন আমিও অনুরূপ মদিনাকে সম্মানিত ঘোষণা করলাম এবং মুদ ও সায়ের জন্য দোয়া করলাম যেমন হজরত ইবরাহিম (আ.) মক্কার জন্য করেছিলেন।’ -সহিহ বোখারি : ১৯৮১
নির্ভরযোগ্য হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, কেয়ামতের আগ মুহূর্তে দাজ্জালের ফেতনা থেকেও এ দুই নগরী মুক্ত থাকবে। ওই সময় ফেরেশতারা এই দুই নগরীর পাহারায় নিয়োজিত থাকবেন, ফলে দাজ্জাল সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না।