ইতিহাস বদলে দেওয়া বীর সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স
সহস্র বছরের ইসলামের গৌরবের ইতিহাসে যে সব অকুতোভয় বীরদের নাম আমরা শুনি, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- মিসরের সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স আল জাহির। যাকে বলা হয় মামলুক সালতানাতের আক্ষরিক প্রতিষ্ঠাতা। ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে যখন মোঙ্গলদের চাবুকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত বর্তমান কাজাখস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠী, তখন সেই অবরুদ্ধ জনপদে জন্মগ্রহণ করেন রুকনুদ্দিন বাইবার্স।
নীল চোখের অধিকারী সেই বালককে ৮ বছর বয়সে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হয় দামেস্কের বাজারে। আলাউদ্দিন আল তাকিন নামের এক ব্যক্তি মাত্র ৮০০ দিরহামের বিনিময়ে বাইবার্সকে ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করেন। কিশোর বয়সেই বাইবার্স রণবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ১২৪৮ সালে ফ্রান্সের রাজা নবম লুইয়ের নেতৃত্বে সপ্তম ক্রুসেড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ক্রুসেডারদের লক্ষ্য ছিল মিসরের কায়রো শহর দখল করা। ক্রুসেডারদের মোকাবেলার জন্য সুলতান আল সালিহ তৈরি করেন এক বিশাল ফৌজ। বাইবার্স সেই ফৌজের এক দুঃসাহসী সৈন্য ছিলেন। চার বছরের সেই যুদ্ধে ১২৫০ সালে মুসলিম সেনাপতি নিহত হলে নেতৃত্বশূন্য মুসলিম সৈন্যদলের সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন বাইবার্স। তিনি রাজা নবম লুইকে পরাজিত করে ক্রুসেডারদের দম্ভ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন।
কিন্তু দমানো যায়নি দুর্বৃত্ত মোঙ্গল জাতিকে, যারা মাত্র ১০০ বছরে প্রায় অর্ধেক পৃথিবীকে নিজেদের করায়ত্ত করেছিলেন। ১২৫৮ সালে মোঙ্গল অজেয় বীর হালাকু খানের হাতে আব্বাসীয় খলিফা আল মুস্তাাসিম বিল্লাহ নিহত হন। যার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্ব খলিফা শূন্য হয়ে পড়ে। অগণিত মুসলমানদেরকে হত্যা করে ইতিহাসে চরম মুসলিম বিদ্বেষী খ্যাত হালাকু খান। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় মুসলিম জনপদগুলোতে। এ ঘটনায় প্রচণ্ডভাবে ব্যথিত হন সেনাপতি রুকনুদ্দিন বাইবার্স। আপোষহীন বাইবার্স ১২৬০ সালে আইন জালুত যুদ্ধে মোঙ্গলদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।
আইন জালুত যুদ্ধ বিশ্বের রণযুদ্ধের ইতিহাসে মুসলমানদের জন্য এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। যার মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক মোঙ্গল শক্তির বিশ্ব কর্তৃত্বের স্বপ্নভঙ্গ হয়। এই যুদ্ধ আফ্রিকা ও ইউরোপে ইসলামি সভ্যতার শির উঁচু করে। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের পর বাইবার্স ১২৬০ সালের শেষার্ধে মিসরের সিংহাসনে আরোহন করেন। তারপর মাত্র দুই বছরের মধ্যে সুলতান বাইবার্স আব্বাসীয় খেলাফত পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। যা বিশ্বের মুসলিম ঐক্যকে আরো সমুন্নত করে। প্রতিশোধপরায়ণ হালাকু খান ১২৬২ সালে দামেস্কের অদূরে সৈন্য সমাবেশ করে। রণদক্ষ সুলতান বাইবার্স তা জানতে পেরে তার সৈন্যদলকে প্রস্তুত করেন। হালাকু খান আক্রমণ করলে বাইবার্সের রণ নৈপূণ্যের কাছে পুণরায় শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। এমনকি ১২৭৭ সালে মামলুকের যুদ্ধেও মোঙ্গলরা বাইবার্সের কাছে পর্যদুস্ত হয়। যা ছিলো এই মহাবীরের জীবনের শেষ যুদ্ধ। দিগ্বিজয়ী ইসলামি বীর বারকে খানের পর বাইবার্সের হাতেই সর্বাধিক সংখ্যক মোঙ্গল নিহত হয়।
১২৬৩ সালে বাইবার্স জেরুজালেমের পার্শ্ববর্তী হাইফা ও কায়সারিয়া শহর দুটি দখল করেন। ১২৬৫ সালে সুলতান বাইবার্সের গাজায় সুবিশাল সৈন্যসমাবেশ দেখে পালিয়ে যান জাফা নগরের ক্রুসেডাররা। ১২৬৬ সালে বাইবার্সের ফৌজ সাফেদ ও রামাল্লা শহর দখল করেন। যার ফলে ছোট ছোট ক্রুসেড রাজ্যগুলো বাইবার্সের বশ্যতা স্বীকার করেন।
আর্মেনিয়া সাম্রাজ্য দখল, হাশাশীনদের মূলোৎপাটন ও খ্রিস্ট ঘাঁটি এন্টিয়ক দখল করেন সুলতান বাইবার্স। লক্ষাধিক ক্রুসেডারদের বন্দী করে ইসলামি ভূখণ্ডকে নিরাপদ করেন। দুর্ধর্ষ মোঙ্গল ক্রুসেডার ও গুপ্ত ঘাতকদের পরাজিত করে পরবর্তী ২৫০ বছরের জন্য মামলুক সালতানাতকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখেন। ক্রুসেডের ইতিহাসে আক্ষরিক অর্থে সবচেয়ে সফল বাইবার্সকে দ্বিতীয় সালাউদ্দিন বলা হয়। তার শাসনামলেই উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা মুসলমানদের করায়ত্বে চলে আসে। দক্ষতার সঙ্গে সৈন্য, নৌ ও নিরাপত্তা বাহিনি পরিচালনা ও ন্যায়ভিত্তিক বিচারকার্য পরিচালনায় বাইবার্স ছিলেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। স্থাপত্য শিল্পে অনুরাগী সুলতান বাইবার্স দূর্গ সংস্কার, স্থাপনা সংস্কার ও নতুন স্থাপনা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৭ সালে দামেস্কে মৃত্যুবরণ করা সুলতান রকনুদ্দিন বাইবার্স আল জাহির ইসলামের ইতিহাসে এক অনুপ্রেরণার নাম।