ফিলিস্তিনের জন্য বিশ্ব মুসলিমের করণীয়
বিশ্ব মানচিত্রে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এক রাষ্ট্রের নাম ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিন বিশ্বের আর দশটা রাষ্ট্রের মতো সাধারণ কোনো রাষ্ট্র নয়, বরং মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মাকদিস ধারণকারী পবিত্র ভূমি। অসংখ্য নবী-রাসুল, আর হাজারো সাহাবিদের পদধূলিত এক পূণ্যভূমি।
ফিলিস্তিন সেই মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ মসজিদের দেশ, যেখানে মেরাজ রজনীতে সমস্ত নবী-রাসুলরা শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইমামতিতে নামাজ আদায় করেন।
তাই সঙ্গতকারণেই ফিলিস্তিন কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়রাজ্যে আবেগ ও ভালোবাসা শীর্ষে অবস্থান করে। এ কারণে ফিলিস্তিনের যুদ্ধ ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এমতাবস্থায় বিশ্ব মুসলিমের করণীয় প্রসঙ্গে আলোচনা করা হলো-
ঘৃণা প্রকাশ : দখলদার ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হাঁটে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে ঐক্যবদ্ধভাবে বলিষ্ঠকন্ঠে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করা। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী মজলুম জনতার পক্ষে সংহতি ও জোড়ালো সমর্থন প্রকাশ করা। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিসে উল্লেখ করা যেতে পারে। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনরা পরস্পর পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা দয়া-মায়া, মমতার দৃষ্টান্তে একটি দেহের মতো, যখন দেহের কোনো অঙ্গ পীড়িত হয়, তখন তার জন্য সারাদেহ অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ -সহিহ বোখারি : ৬০১১
বর্ণিত হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তরে কোনো মুসলমান আক্রান্ত হলে; অপর মুসলমান ভাই তার জন্য ব্যাথিত হবে এবং তার ব্যথা উপশম ও মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা সাধনা করবে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা: ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী ভাই-বোনদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থনৈতিক ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসা। ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের পার্থিব জীবনের বহু দুঃখ-কষ্টের মধ্য হতে একটি দূর করবে, আল্লাহতায়ালা সেই ব্যক্তির কেয়ামতের বিভীষিকাময় বহু দুঃখ-কষ্টের মধ্য হতে একটি দূর করবেন।’ -সহিহ মুসলিম : ৭০২৮
আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকে।’ -সুনানে ইবনে মাজা : ২২৫
প্রকৃত অর্থে মুমিন হওয়া : নিঃসন্দেহে মুসলমানরা আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ও পছন্দনীয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট (গ্রহণযোগ্য) দ্বীন কেবল ইসলাম।’ -সুরা আলে ইমরান : ১৯
ইসলাম সর্বশেষ নবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) কর্তৃক আনিত দ্বীন ও শরিয়ত। যা পরিপূর্ণ, সার্বজনীন ও কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী ধর্ম। অথচ মুসলমানরা তাদের জীবনে গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয় দ্বীনের অনুসারী হয়েও মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার জন্য দুটি কাজ করা।
এক. জীবনের সবক্ষেত্রে ইসলামের বিধি-বিধান ও অনুশাসন মেনে চলা। দুই. উন্নতির বাহ্যিক উপায়-উপকরণ ও উপাদান সংগ্রহ করা।
এ দুই জিনিসের মাঝে মুসলমানদের উন্নতি ও সাফল্যের রহস্য লুকায়িত। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর প্রস্তুত করো তাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতে পারো নিজের শক্তি সামর্থ্যের মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের ওপর এবং তোমাদের শত্রুদের ওপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের ওপর ও যাদেরকে তোমরা জানো না; আল্লাহ তাদেরকে চেনেন। বস্তুতঃ যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাস্তায়, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোনো হক অপূর্ণ থাকবে না।’ -সুরা আনফাল : ৬০
বর্ণিত আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, মুসলিম উম্মাহর প্রতি এটা এক স্থায়ী নির্দেশ। তারা যেন ইসলাম ও মুসলিমদের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত রাখার লক্ষে সবরকম প্রতিরক্ষা শক্তি গড়ে তোলে। কোরআন মাজিদে সাধারণভাবে ‘শক্তি’ শব্দ ব্যবহার করে বোঝাচ্ছে যে, রণ প্রস্তুতি বিশেষ কোনো অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং যখন যে ধরনের প্রতিরক্ষা শক্তি কাজে আসে, তখন সেরকম শক্তি অর্জন করা মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
ইসলামি স্কলাররা বলেন, যখন মুসলমানরা উল্লিখিত দুই নির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তখনই শুরু হয়েছে পরাজয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারী অবলম্বন করতো, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানি ও পার্থিব নেয়ামতসমূহ উম্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের বদলাতে।’ -সুরা আরাফ : ৯৬
কুনুতে নাজেলার আমল : প্রতিদিন ফজরের নামাজে কুনুতে নাজেলার আমল করা। কুনুতে নাজেলা হলো- মুসলমানদের ওপর কোনো বিপদ-আপদ আসলে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে হেদায়েত কিংবা বদদোয়ার নিয়তে করা আমল বিশেষ। এটি একটি সুন্নত আমল।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) (ফজরের নামাজে) সর্বদা কুনুত (নাজেলা) পড়তেন না, শুধু পড়তেন কোনো জাতির জন্য দোয়া করতে কিংবা বদদোয়ার প্রয়োজন হলে। তিনি কুনুত পড়তেন যখন ফজর নামাজের দ্বিতীয় রাকাতের রুকু থেকে মাথা উঠাতেন। -সহিহ ইবনে খুজাইমা : ১০৯৭
দোয়া করা : ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীরের অত্যাচারিত ভাই-বোনদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজেরত আবু দারদা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যখন কোনো মুসলমান নর-নারী, তার ভাইয়ের জন্য পেছনে দোয়া করে, তখনই তার (মাথার ওপর নিযুক্ত) ফেরেশতা বলেন, আর তোমার জন্যও অনুরূপ।’ -সহিহ মুসলিম : ২৭৩২
বর্তমান পরিস্থিতিতে আল্লাহমুখী হওয়া ভীষণ জরুরি, এর কোনো বিকল্প নেই। উম্মাহর সম্পর্ক আল্লাহর সঙ্গে যত বাড়বে, আল্লাহতায়ালা তার নজর, দয়া ও রহমত আমাদের দিকে তত প্রসারিত করবেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রতি রহম করুন। দয়া করুন, সর্বাত্মক সাহায্য করুন। আমিন।