আল আকসা রক্ষার লড়াই মুসলিম উম্মাহর

  • মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আল-আকসা মসজিদে জুমা আদায়ে বাধা পেয়ে রাস্তায় নামাজ পড়ছে মুসলমানরা

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আল-আকসা মসজিদে জুমা আদায়ে বাধা পেয়ে রাস্তায় নামাজ পড়ছে মুসলমানরা

গত সাত দশক ধরে শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্মম নিপীড়ন চালাচ্ছে দখলদার ইসরায়েল। ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন হামাস গাজা উপত্যকার নেতৃত্ব দিচ্ছে। সেখানে রয়েছে ইসলামিক জিহাদ নামের আরেকটি স্বাধীনতাকামী দল। তাদেরও লক্ষ্য, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। গাজার মুসলমানদে এ দাবীকে নস্যাৎ করে, ইসরায়েল তাদের বসতি স্থাপনে অবৈধভাবে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করছে প্রতিনিয়ত, তাদের কার্যক্রমে বাধা দিলে ইসরায়েল উন্মাদের মতো নির্বিচার হামলা করে মুসলমানদে শহীদ করে এলাকার পর এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।

সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এ বিরোধ থামানোর উদ্যোগ নেওয়ার পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরের মতোই ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে থাকে। যার পরিণাম ধ্বংস আর রক্তপাত। রক্তাক্ত মধ্যপ্রাচ্য।

বিজ্ঞাপন

দখলদার ইসরায়েল ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। বিরামহীনভাবে চলছে হামলা-নির্যাতন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফিলিস্তিনিকে ঘর থেকে বের করে তার ঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারো ভিটেমাটি কারো বা ফসলের জমি কেড়ে নিচ্ছে। তবে এবারের বর্বরোচিত হামলা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

ফিলিস্তিনের জাতীয় দুর্যোগের ইতিহাস সুদীর্ঘ। একসময় এটা ছিলো রোম সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ। দশম শতকে আরব ভূগোলবিশারদরা একে বলতেন ফিলিস্তিন। তখন ফিলিস্তিন ছিলো- সিরিয়ার একটি প্রদেশ। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিলো- অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছে এটি ছিলো- পবিত্র স্থান। জেরুজালেম, হেবরন, বেথেলহেম ও নাজারেত ছিলো- ফিলিস্তিনের পবিত্র সব নগরী। অটোম্যান সাম্রাজ্যের শেষ সময়ে ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ছিলো ৬ লাখ ৫০ হাজার। তাদের ব্যাপক অংশ ছিলো আরব। এ আরবদের ১০ শতাংশ খ্রিস্টান, বাকিরা মুসলমান। তবে ৭৫ হাজার ইহুদিও ছিলো।

বিজ্ঞাপন

ফিলিস্তিনের আত্মপরিচয়ের উদ্ভব ঘটে দুটি প্রধান রাজনৈতিক ঘটনার ফলে। এর প্রথমটি হলো- এ অঞ্চলে ইউরোপের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ। এর ফলে প্রধান প্রধান ইউরোপীয় শক্তি বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় মধ্যপ্রাচ্য। ফিলিস্তিন লীগ অব নেশনসের ম্যান্ডেটে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পাশ্চাত্যের এ আগ্রাসনের ফলে এ অঞ্চলে আরব জাতীয়তাবাদ এবং নিখিল আরব জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে যে মানচিত্র রচিত হয়, সেই মানচিত্রই এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম সূত্র।

ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের বিকাশের পেছনে যে সাংস্কৃতিক কারণটি কাজ করেছে সেটি হল ইহুদিবাদী আন্দোলন। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের সহায়তায় ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি সৃষ্টি করা। ফিলিস্তিনে অটোম্যান সাম্রাজ্যের আমল থেকেই ক্ষুদ্র আকারে ইহুদি বসতি শুরু হয়েছিলো। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের আবাসভূমি নীতির আশ্রয়ে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসন, বসতি স্থাপন এবং জমি দখল সহজতর হয়। ইহুদিবাদের লক্ষ্য হিসেবে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আবাসভূমি স্থাপনের নীতি গ্রহণ করা হয়। ফলে আরব জনগণের আশা-আকাঙ্খা পদদলিত হয়। অভিবাসনের ফলে ফিলিস্তিনে ১৯২২ সালে ইহুদির সংখ্যা ১১ শতাংশ থেকে ১৯৪৪ সালে এসে ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়। তখন ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ছিলো ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৬২৪। এসব কারণে ফিলিস্তিনে আরব জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয় অনিবার্য হয়ে ওঠে।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি পৃথক ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রে ভাগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আরবরা এ উদ্যোগের বিরোধিতা করে। এর ফলে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে যুদ্ধের সূচনা হয়। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ইহুদিরা গায়ের জোরে জাতিসংঘ নির্দেশিত এলাকার বাইরেও তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ১৯৪৮-১৯৪৯-এর যুদ্ধে নবগঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্র ফিলিস্তিন বাহিনী এবং প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে। রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন মুছে যায়।

ইসরায়েলের বোমায় দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকা এভাবেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়

 

ইসরায়েল বিরাট এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। জর্দান পশ্চিম তীরের ওপর এবং মিসর গাজা অঞ্চলের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করে। ফিলিস্তিনের আরব জনগণের মধ্যে ৭ লাখ মানুষ যুদ্ধ থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। তাদের নিজ আবাসভূমিতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে পশ্চিম তীর, গাজা এবং পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোয়- বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া ও জর্দানে আশ্রয় গ্রহণ করে। খোদ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ১৯৫০ সালে ১ লাখ ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি থেকে গিয়েছিল।

১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর মসজিদুল আকসাসহ পুরো জেরুজালেম ইসরায়েল দখল করে নেয়। আন্তর্জাতিক আইনে অধিকৃত ভূমি হিসেবে বিবেচিত হলেও ইসরায়েল শহরটিকে একীভূত করে নেয় এবং অখণ্ড জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। বিভিন্ন সময় শহরটিতে থাকা ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে ইসরায়েল ইহুদিদের শহরে আবাসনের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।

এরপর যুদ্ধ ও কূটনীতির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এর সামান্য সাফল্য হলো- গাজা ও পশ্চিম তীরে প্যালেস্টাইন স্টেট অথোরিটি প্রতিষ্ঠা। তাছাড়া মসজিদে আকসাকে মুসলমানদের পবিত্র স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর পাস করা এক প্রস্তাবনায় বলা হয়, জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদের ওপর ইসরায়েলের কোনো অধিকার নেই, আল আকসা মুসলমানদের পবিত্র স্থান।

হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি জাতিকে কীভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়, তাদের গৃহহারা করা যায়, তাদের পরিচয় মুছে দেওয়ার জঘন্য চেষ্টা করা হয়, ফিলিস্তিন তার এক অন্ধকারাচ্ছন্ন দৃষ্টান্ত। ফিলিস্তিনিদের জীবন হারাতে হয়েছে নিজ দেশে এবং প্রবাসী হিসেবে অন্যদেশে। যেমন জর্দানের শাতিলা ক্যাম্পে তাদের রীতিমতো জবাই করা হয়েছে। যারা জবাই করেছে, তারাও আরব ও মুসলিম। একবিংশ শতাব্দীতে ইতিহাসের ট্রাজেডি যদি কোথাও থাকে তা আছে ফিলিস্তিনে।

ফিলিস্তিনিরা রক্ত দিচ্ছে। কোনো রক্তই বৃথা যায় না। আজ হোক কাল হোক, ফিলিস্তিনের বিজয় হবে- ইনশাআল্লাহ। সাম্প্রদায়িক ইহুদিবাদের মৃত্যু ঘটবেই। তবে ভুলে গেলে চলবে না মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসা রক্ষার এই সংগ্রাম শুধু ফিলিস্তিনিদের একার সংগ্রাম না, এই সংগ্রাম গোটা মুসলিম উম্মাহর সংগ্রাম।

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক