গণিত চর্চায় মুসলিমদের অবদান

  • মুফতি শরিফুল আজম, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি, ছবি : সংগৃহীত

মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি, ছবি : সংগৃহীত

মুসলিমদের সোনালি যুগে গণিতের ওপর যে ব্যাপক কাজ হয়, তা মানব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। গণিতই হলো বিজ্ঞানের সব শাখার মূল সূত্রধর। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, মহাকাশ বিজ্ঞান, ভূগোলসহ বিজ্ঞানের সব শাখায় গণিত অপরিহার্য একটি উপাদান। সোনালি যুগের মুসলিম বিজ্ঞানীরা গণিতকে শুধু বিজ্ঞান নয়, বরং পবিত্র জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করতেন। তারা মনে করতেন, গণিতকে ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারলে পৃথিবী ও বিশ্বজগৎ পরিচালনার যাবতীয় সংখ্যাতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা সম্ভব।

আজকের দিনে যারা পদার্থবিদ্যায় পড়েছেন বা পড়ছেন, তারা সত্যিই ধারণা করতে পারেন যে, মহাকাশে কীভাবে এক একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেই যুগে আজকের মতো সব তথ্য সহজলভ্য ছিল না। তাই মহাকাশ তাদের কাছে তখন পর্যন্ত রহস্যময়ই ছিল। তখনকার সময়ের বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, জাদুকরী কিছু গাণিতিক সূত্রানুযায়ীই মহাকাশ চলছে। এটা বুঝতে পারার পর আল্লাহর অসীম ক্ষমতা এবং সৃষ্টিকূলের প্রতি তার ভালোবাসাকে মুসলিম বিজ্ঞানীরা নতুনভাবে উপলব্ধি করেন। তাই তারা গণিতচর্চাকে ধর্মচর্চার মতোই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতেন।

বিজ্ঞাপন

ইসলামের সে সোনালি যুগের গণিতবিদদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি। তিনি ছিলেন একজন পারসিয়ান। ৭৮০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৫০ সালে ইন্তেকাল করেন। বায়তুল হিকমায় যারা কাজ করেছিলেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একেবারে প্রথম সময়ের। তাই পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান ও গণিতে যে ব্যাপক কাজ হয়, তার ভিত্তি তিনিই গড়ে দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি প্রথম ভারতীয় গাণিতিক পদ্ধতিকে আরবি ভাষায় প্রচলন করেন। এর আগে আরবরা রোমান সংখ্যা ব্যবহার করত, কিন্তু তার অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। বিশেষ করে অপূর্ণাঙ্গ সংখ্যার অঙ্কগুলো রোমান সংখ্যায় লেখা কঠিন ছিল। কিন্তু ভারতীয় গাণিতিক সংখ্যায় ১, ২, ৩, ৪ দিয়ে যেকোনো অঙ্ক লেখা যেত। ফলে অংক নিয়ে যে সংকটটা ছিল, সেটা তার অবদানের মাধ্যমে সমাধান হয়। খাওয়ারিজমি শুধু ভারত থেকে এই সংখ্যার হিসেবটাই নেননি, এর সঙ্গে ‘শূন্য’ সংখ্যাটিকে যোগ করেছেন- যা গাণিতিক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি শূন্যকে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করে যেতে পারেননি। তবে তিনি এর সফল ব্যবহার ও প্রয়োগ করেন এবং এই গাণিতিক সংখ্যাগুলোর মাধ্যমে নতুন আরও অনেকগুলো চমকপ্রদ বিষয় ও সূত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হন।

বিজ্ঞাপন

দশম শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের মধ্যে ক্যাথলিক পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার গণিত চর্চার প্রচলন শুরু করেন। অথচ তিনি এই জ্ঞান মুসলিমদের কাছ থেকে পান। মুসলিম স্পেনে ও উত্তর আফ্রিকায় পড়াশোনা করার সময় সিলভেস্টার গণিত শিক্ষা লাভ করেন। খুব সম্ভবত আল খাওয়ারিজমির সবচেয়ে বড়ো অবদান হলো- বীজগণিত। কীভাবে অ্যালজেবরা বা বীজগাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে সম্পদের উত্তরাধিকার ইস্যু থেকে শুরু করে ভূগোল পর্যন্ত দৈনন্দিন সব বিষয়কে সমাধান করা যায়, তা তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাবুল মুখতাসার ফি হিসাবিল জাবর ওয়াল মুকাবালাতে অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।

আরেক বিশ্বখ্যাত গণিতজ্ঞ হলেন উমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১)। যদিও আধ্যাত্মিকতা এবং ভালোবাসার ওপর কবিতা লিখে তিনি বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। মূলত তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ গণিত বিশারদ। গণিতকে তিনি অগ্রজদের মতো সীমিত পরিসরে রাখতে চাননি, বরং তাদের রেখে যাওয়া সব সীমানাকে সচেতনভাবেই ভাঙতে চেয়েছেন। কিউবিক সমীকরণসংক্রান্ত সমাধান করার জন্য বীজগাণিতিক কিছু সূচক বের করেন, যেখানে এগুলোকে তিনগুণ বাড়িয়ে বিবেচনা করা হয়। তিনি প্রথম না হলেও প্রথম যুগেরই একজন গণিতজ্ঞ, যিনি অংকের দ্বিপদী তত্ত্বগুলো প্রণয়ন করেন। এর ফলে বীজগণিতের মাধ্যমে যোগ করার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। যদিও এসব আবিষ্কারকে নিতান্তই তাত্ত্বিক ঘরানার এবং মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রদের উপযোগী বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হলো, এগুলোর ওপর ভর করেই পরবর্তী স্তরের বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি ও ক্যালকুলাসের ভিত্তি গড়ে ওঠে।