সম্পর্ক রক্ষা না করার পরিণাম ভয়াবহ
সমাজে সম্পর্কহীনতা বাড়ছে। বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা। মানুষ সংযোগহীন হয়ে পড়ছে আপন মানুষ থেকে। পরস্পর মুখ দেখা হয় না। কথা বন্ধ দীর্ঘদিন। ঝগড়া-কলহ ও বিবাদ-বিরাগে বিদ্বেষপ্রসূত কার্যক্রম মানুষকে শুধু মানুষ থেকেই বিচ্ছিন্ন করছে না, বিচ্ছিন্ন করছে মহান আল্লাহ থেকেও।
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা মানুষের মাঝে নানাভাবে বন্ধন স্থাপন করেছেন। তিনি মানুষের মাঝে স্থাপিত বন্ধনকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘(হে বন্ধন!) যে ব্যক্তি তোমাকে সংযুক্ত রাখবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব। আর যে ব্যক্তি তোমাকে বিচ্ছিন্ন করবে আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করব।’ -সহিহ বোখারি
অনেক সময় সামান্য মান-অভিমানে পরস্পরে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায়শই দেখা যায়- ভাই ভাইয়ের সঙ্গে, বোন ভাইয়ের সঙ্গে, সন্তান পিতা-মাতার সঙ্গে, বন্ধু বন্ধুর সঙ্গে কিংবা সহকর্মী সহকর্মীর সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। শরিয়তে গ্রহণীয় কারণ ছাড়া কোনো মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের সঙ্গে এভাবে তিন দিনের বেশি কথাবার্তা বন্ধ রাখা বৈধ নয়। এতে হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায় এবং উভয় জগতে বয়ে আনে ভয়াবহ পরিণাম।
শরিয়ত মান্যতা দেয়, এমন কারণ থাকলে তিন দিনের বেশি কথাবার্তা বন্ধ রাখা যাবে। উদাহরণস্বরূপ- কোনো ব্যক্তি লাগাতার কবিরা গোনাহে লিপ্ত হলো কিংবা একেবারেই নামাজ, রোজা বা ইসলামের মৌলিক কোনো বিষয় পরিত্যাগ করল, তাহলে এমন ব্যক্তিকে শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী বুঝাতে হবে। যদি সে এই বিষয়ে নিজেকে সংশোধন না করে তাহলে সংশ্লিষ্ট কারণে তার সঙ্গে তিন দিনের বেশি কথাবার্তা বন্ধ রাখা বৈধ। এমন কারণ ব্যতিত তিন দিনের বেশি কথাবার্তা বন্ধ রাখা বৈধ নয়।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর সম্পর্ক ছিন্ন করো না, একে অন্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, তোমরা ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলমানের জন্য তার অপর মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের অধিক কথাবার্তা বন্ধ রাখা বৈধ নয়।’ -সহিহ মুসলিম
পরস্পর সম্পর্ক নষ্ট করার মাধ্যমে মানুষ কেবল নিজের ক্ষতিই করে। নিজের আখেরাত কলঙ্কিত করে। এতে আল্লাহর সঙ্গে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় তাতে পরকালের প্রাপ্তির খাতা থাকে সওয়াবশূন্য। কেননা সম্পর্ক ছিন্নকারীর নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ কোনো নেক আমলই মহান আল্লাহ গ্রহণ করেন না। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে আল্লাহর নিকট উপস্থাপন করা হয়। তখন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না।’ -সহিহ বোখারি
হাদিসের অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘এমন লোকদের আমলসমূহকে অপেক্ষমান রাখা হয়। যদি তারা পারস্পরিক সম্পর্ক সংশোধন করে নেয় তাহলে তা গ্রহণ করা হয়।’ উদাহরণস্বরূপ- কারো সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ রাখা কিংবা সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপ্তি যদি পঁচিশ বছর দীর্ঘ হয় তাহলে এই পঁচিশ বছরে আদায়কৃত কোনো ইবাদতই মহান আল্লাহর কাছে কবুল হয়নি। যদি পঁচিশ বছর পর তাদের সম্পর্ক সংশোধন করে মিলমিশ হয়ে যায় তাহলে আল্লাহতায়ালা পঁচিশ বছরের সব ইবাদত কবুল করে নেবেন।
সম্পর্ক ছিন্নকারীর শাস্তি সম্পর্কে মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালা দুটি অপরাধের শাস্তি দুনিয়াতেই দেবেন। উপরন্তু আখেরাতের শাস্তি তো থাকবেই। অপরাধ দুটি হলো- অত্যাচার ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা।’
মানুষে মানুষে যে রক্তের বন্ধন ও আত্মার সংযোগ তা ছিন্ন করলে পরাক্রমশালী আল্লাহর অভিসম্পাত অবধারিত। বধিরতা ও দৃষ্টিহীনতা এ অপরাধের ঘোষিত দণ্ড। আর পরকালে থাকবে অগ্নিকুণ্ডে অঙ্গার হওয়ার যন্ত্রণা।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে সম্ভবত দুনিয়াতে তোমরা বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ তাদেরকেই করেন অভিশপ্ত, বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন।’ -সুরা মুহাম্মদ : ২২-২৩
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘তাদের জন্যই রয়েছে মন্দ আবাস (জাহান্নাম)।’ -সুরা রাদ : ২৫
আল্লাহতায়ালার অভিসম্পাত থেকে বাঁচতে, দুনিয়ার ইবাদত-বন্দেগিকে ফলপ্রসূ করতে এবং পরকালের শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে আত্মীয়তার বন্ধন ও পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা আবশ্যক। কেউ যদি সম্পর্ক রক্ষা না করে তবুও তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সালাম দেওয়ার মাধ্যমে হলেও তোমরা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো।’ -সহিহ বোখারি
তাই পরস্পর দেখা হলে কমপক্ষে সালাম প্রদান করে কুশল বিনিময় করতে হবে। তাহলে এমন ব্যক্তি সম্পর্ক রক্ষাকারী হিসেবে গণ্য হবে। অপর ব্যক্তি সালামের উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকলে এবং কুশল বিনিময়ে সাড়া না দিলে তার ইহকালের বন্দেগি বৃথা যাবে। পরকাল পণ্ড হবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি সম্পর্ক রক্ষাকারী হিসেবে গণ্য হবে না, যার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা হলে সেও সম্পর্ক রক্ষা করে। বরং ওই ব্যক্তি সম্পর্ক রক্ষাকারী হিসেবে গণ্য হবে, যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হলেও সে সম্পর্ক রক্ষা করে।’ -সহিহ বোখারি
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রভূত কল্যাণ। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রিজিকের প্রশস্ততা ও আয়ূ বৃদ্ধি করতে চায়, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।’ -সহিহ বোখারি
অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘একজন ব্যক্তি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহর ইবাদত করো, তার সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করো না, ভালোভাবে নামাজ আদায় করো, জাকাত দাও এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো।’ -সহিহ বোখারি
নিকটতম ও ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে সামান্য অভিমানের কারণে যে নীরব দূরত্ব তৈরি হয়, তা দ্রুত দূর করতে না পারলে দিন দিন দূরত্বের পরিধি আরও বাড়ে। এক সময়ের সামান্য অভিমান বেড়ে হয়ে যায় ক্ষোভের পাহাড়। পরকাল বিবেচনায় এটা ভীষণ ভারী। মানুষ এই ভারী পাহাড় নিয়ে দুনিয়াতে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। একটুও কম্পিত হয় না। অথচ পাহাড়সম এই ক্ষোভ মানুষকে পরকালে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে! নিকটাত্মীয়দের দূরত্ব যদি কারো মনে ভাঙচুর না ঘটায়, সম্পর্ক সংশোধন করতে না ভাবায়- তাহলে এমন মানসিকতা মানুষকে পরকালে গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে।
দূরত্বের দুটো কাজ। দূরত্ব হয়তো সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে অথবা আরো দূরে ঠেলে দেয়। আমাদের নিকটাত্মীয়দের দূরত্ব যেন পরস্পর সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে। যেন পরস্পর খোঁজ-খবর রাখা যায়। তবে তা দুনিয়ার জীবনে প্রশস্ততা আনবে এবং পরকালে মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভে সহায়ক হবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট