আল্লাহর ভয় ও নৈতিকতার অনুশীলনই পারে দুর্নীতি কমাতে
ইসলাম নৈতিকতার ধর্ম। এখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতি দমনে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব বাণী উচ্চারণ করেছেন, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে তা বাস্তবায়ন করতে পারলে বিদ্যমান দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ সম্ভব। ইসলামের দৃষ্টিতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সুদ, ঘুষ, জুয়া তথা যেকোনো হারাম পন্থা অবলম্বন, ক্ষমতা ও পেশিশক্তির অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতারণা, আইনের অসৎ ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল এবং দেশ, জাতি ও সাধারণ নাগরিকের অধিকার ও স্বার্থ হরণের নাম দুর্নীতি।
এ কারণেই ইসলাম অপরাধী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শাস্তি দিতে স্বচ্ছআইন এবং তা দ্রুত কার্যকরের বিধান প্রণয়ন করেছে। এ ছাড়া ইসলামে অপরাধ ও দণ্ডবিধি মওকুফ করার অধিকার রাষ্ট্রপ্রধানকে দেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে নবী কারিম (সা.)-এর হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমা চুরি করলেও আমি তার হাত কেটে দেওয়ার নির্দেশ দেব।’-সহিহ বোখারি
ইসলাম মনে করে, অসৎ ও হারাম উপায়ে উপার্জনের প্রবণতা থেকেই মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতি দমনের মূলনীতি হিসেবে ইসলাম হালাল-হারামের পার্থক্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। সেই সঙ্গে হালালের উপকারিতা এবং হারামের অপকারিতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানুষ! পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’-সুরা বাকারা : ১৬৮
আমরা জানি, দুনিয়ায় অপরাধের শাস্তি হোক বা না হোক, আখেরাতে সব অপরাধের বিচার হবে। দুনিয়ায় মানুষের চোখ ফাঁকি দেওয়া গেলেও আখেরাতে আল্লাহর দরবারে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না; বরং সব কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। সেখানে কোনো বিষয়ে দুর্নীতি, ব্যক্তি বা জাতির হক আত্মসাৎ প্রমাণিত হলে তার জবাবদিহি করতে হবে এবং পরিণামে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। তা থেকে বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। সেদিন হাত, পা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব, তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।’-সুরা ইয়াসিন: ৬৫
আল্লাহর সামনে হিসাব দিতেই হবে- এই মানসিকতা জনসাধারণের মধ্যে সৃষ্টি হলে দুর্নীতি ও অপরাধ কমে আসবে। দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তাই প্রত্যেক মা-বাবার উচিত- সন্তানকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামি অনুশাসনের পূর্ণ অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলার সুব্যবস্থা করা।
এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সৎ, যোগ্য ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির জন্য ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনের লক্ষ্যে ইসলামি মূল্যবোধ ও তাকওয়ার ব্যাপক অনুশীলন হওয়া প্রয়োজন। ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবাইকে সজাগ থাকা। কোথাও দুর্নীতি হতে দেখলে সাধ্যমতো প্রতিবাদ করা। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় হতে দেখে, সে যেন সম্ভব হলে তা হাত দিয়ে রুখে দেয়। আর তা সম্ভব না হলে প্রতিবাদী ভাষা দিয়ে যেন তা প্রতিহত করে। আর তাও না পারলে সে যেন ওই অপকর্মকে হৃদয় দিয়ে বন্ধ করার পরিকল্পনা করে (মনে মনে ঘৃণা করে), এটি দুর্বল ইমানের পরিচায়ক।’-সুনানে তিরমিজি
দুর্নীতি দমনে প্রথম পর্যায়ে ইসলামি কর্মধারার লক্ষ্য হলো, প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়কে দুর্নীতিবিরোধী প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তোলা এবং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। সে লক্ষ্যে সম্পদ ও ঐশ্বর্যের কুফল, হারাম উপার্জনের ভয়াবহ পরিণতির কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে ইসলাম দিয়েছে অত্যন্ত কঠোর দণ্ডের বিধান এবং তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির ধরণ, প্রকৃতি ও গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে ইসলামি আইনে দণ্ড নির্ধারিত হয়ে থাকে। হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকাল ছিল দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে ইসলামি ব্যবস্থাপনার বাস্তব উদাহরণ। তিনি যোগ্যতর ব্যক্তিদের প্রজাতন্ত্রের পদগুলোতে নিয়োগ দান করতেন। তাদের জন্য উপযুক্ত বেতন নির্ধারণ করে দিতেন, তাদের সম্পদের তালিকা সংরক্ষণ করতেন এবং চৌকস গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন, যাতে কোনো সরকারি কর্মচারী দুর্নীতিপরায়ণ হতে না পারে। তার পরও যদি কারো দুর্নীতি প্রমাণিত হতো, তাহলে তার ওপর কঠিন শাস্তি কার্যকর করা হতো।
দুর্নীতি মানবচরিত্রের সহজাত প্রবৃত্তি, তাই পৃথিবীতে মানুষ যত দিন থাকবে, দুর্নীতিও তত দিন থাকবে। সমাজকে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিমুক্ত করা আদৌ সম্ভব না হলেও তা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে সেটি একমাত্র ইসলামি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই সম্ভব। যেমন হয়েছিল রাসুলে কারিম (সা.)-এর যুগে ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে। পরকালে জবাবদিহির ভয় মানুষের মনে যত বেশি কাজ করবে, সমাজের দুর্নীতি তত কমে আসবে। তাই অনিয়ম দুর্নীতি যেই করুক, প্রশ্ন তুলতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারিবারিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধের চর্চাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শের চর্চার মাধ্যমেই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।