অস্তিত্বে জড়ানো আল আকসা ও ফিলিস্তিন
কয়েকদিন আগে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিন বিষয়ে ‘হুরমতে আকসা’ কনফারেন্সে শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমানী খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি বিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন-
... কখনও এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন হিম্মত ও সাহসিকতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হয় এবং ত্যাগের সর্বোচ্চ পারাকাষ্ঠা দেখিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগুতে হয়। যদি সেই সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া না হয়, তাহলে শত শত বছর তার জন্য কঠিন মাশুল দিতে হয়।
আমি মনে করি, এখন সেই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণ আমরা অতিক্রম করছি। আপনারা সকলে অবগত আছেন যে, সমগ্র ইসলামি বিশ্ব, মরক্কো থেকে নিয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পশ্চিমা দাসবৃত্তির শিকার। আমরা যে গোলামী জীবনযাপন করছি; এটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? সর্বক্ষেত্রেই চলছে এ গোলামী; অর্থনীতি বলেন আর সমরনীতি কিংবা রাজনীতি; সবখানেই। এ গোলামীর শেষ কোথায়? অথচ মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম এলাকায় আল্লাহতায়ালা যে প্রাকৃতিক সম্পদ দান করেছেন, তা আর কাউকে দেননি। তাছাড়া মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। তাদের হাতে সেসব বিস্তৃত মরুঅঞ্চল রয়েছে, তা দ্বারা তারা সমগ্র দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। সুয়েজ খাল তাদের হাতে। এডেন উপসাগর তাদের হাতে। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি তরল সোনা তথা তেলসম্পদ তাদের হাতে। তারপরেও কেন তাদেরকে গোলামির জীবন কাটাতে হবে? এর কারণ কি?
কারণ একটিই, যা নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, মুসলমান অধিক হওয়ার পরেও খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। কারণ, তারা জীবনকে বেশি ভালোবাসবে, মৃত্যুকে ভয় করবে এবং জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহকে পরিত্যাগ করবে। আজ আমাদের সুরতহাল সেটাই জানান দিচ্ছে।
দুই. বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন সবাই অবগত আছেন যে, এই সময়ে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর কী পরিমাণ অমানবিকতা চলছে! সেখানে নারী, শিশু এমনকি আহত ও অসুস্থ লোকেরাও নির্বিচারে দখলদার ইসরায়েলি জালেমদের আক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছে। জালেমরা কোনো বাচবিচার ছাড়াই যেখানে-সেখানে বোমা ফেলছে। এমনকি হাসপাতাল, তাঁবু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, উপাসনালয় ও আশ্রয়কেন্দ্র কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না; বরং সব কিছুই জালেমদের তাণ্ডবের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। যা পৃথিবীর সব আইনে মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ হওয়া সত্বেও জালেমরা তার কোনো পরোয়া করছে না।
তাদের এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে পৃথিবীর বিবেকবানরা জোড়ালো প্রতিবাদ অব্যাহত রাখলেও তারা এই জঘন্য অপরাধ কর্ম থেকে বিরত হচ্ছে না। যদিও আমরা বিশ্বাস করি এটা জালেমদেরকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে বিশ্ববাসীর সামনে যা পরিস্কার হতে চলেছে, তা হলো- জালেম ইসরায়েলিদের ধ্বংস খুব একটা দূরে নয়। কারণ চলমান যুদ্ধ বিশ্ব জনমতকে ইসরায়েলের প্রতিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এবং বিশ্ববাসী এই জালেম দখলদার বাহিনী ও তাদের মদদদাতা আমেরিকার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠছে; এটা অব্যাহত থাকলে একসময় জালেমরা সামান্য আশ্রয়ের জায়গা খুঁজে পাবে না- ইনশাআল্লাহ।
গত সাত অক্টোবর থেকে দখলদার ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি মুজাহিদদের মধ্যে চলমান সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হয়। চলমান এই যুদ্ধ বিশ্ব পরিস্থিতিকে সম্পুর্ণ উলট-পালট করে দেয়।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ায় এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখে। অপরদিকে মজলুম ফিলিস্তিনিদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি! আরব রাষ্ট্রগুলো মৌখিকভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বললেও সরাসরি সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি কেউ। জাতিসংঘ নামের গোয়ালঘর থেকে ইসরায়েলের পাশবিকতার বিরুদ্ধে কিছু আওয়াজ আসলেও কার্যত কোনো পদক্ষেপ এখনও আসেনি। এরপরও ফিলিস্তিনের মজলুম মানুষের জন্য গাজার মুজাহিদরা সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন এবং আল্লাহর সাহায্যে এখনও তারা দুর্বার প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জালেম ইসরায়েলিরা নিরীহ সাধারণ মানুষদেরকে নির্বিচারে হত্যা করছে তবে গাজার মুজাহিদরা ইসরায়েলি জালেম বাহিনীকে একের পর এক জাহান্নামে নিক্ষেপ করছে। মুজাহিদরা সুযোগ পাওয়া সত্বেও একজন নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করেনি এবং করবেও না।
এসব চিত্র সামনে আসার কারণে বিশ্ববাসীর সামনে চলমান এই যুদ্ধ পরিস্কার করে দিয়েছে; আমেরিকা ও পশ্চিমাদের মুখে মানবতার বুলি শুধু প্রতারণা। কারণ তারা সত্যিকার অর্থে মানবিক হলে কখনও এই ইসরায়েলি অমানবিকতার পক্ষ নিতো না। সুতরাং বিশ্ববাসীর উচিত হলো, জালেম ইসরায়েলি বাহিনী এবং তাদের মদদদাতাদের বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার হওয়া।
এই যুদ্ধ আরও পরিস্কার করে দিয়েছে যে, আরবের শাসকরা তাদের ক্ষমতা ও বিলাসিতার মোহে নিজেদের আত্মমর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে, তাদের কাছে আর মুসলমানদের জান-মাল ও ইসলামের নিদর্শনগুলো নিরাপদ নয়। তারা মুসলিম জনপদ শাসন করার যোগ্যতা রাখে না। তাছাড়া এই যুদ্ধ বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা খাঁটি মুমিন আর কপট মুনাফেকদের আলাদা করে দিয়েছে।
বিশ্ব মুসলিমের সামনে আজকে পরিস্কার হয়ে গিয়েছে যে, মজলুম মুসলমানদের মুক্তি একমাত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শে পরিচালিত জেহাদের মধ্যে নিহিত। কারণ, দখলদার ইসরায়েলি জালেমদের সামনে অস্ত্রের ভাষা ছাড়া কোনো ভাষাই কার্যকর নয়।
চলমান যুদ্ধে বিশ্বের মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর উপর সবচেয়ে নৈতিক দায়িত্ব ছিল, ফিলিস্তিনের মুজাহিদদের সাহায্য করা; কিন্তু তারা রহস্যজনক নিরব ভূমিকা পালন করছে! এহেন পরিস্থিতিতে মুসলিম জনসাধারণের ওপর দ্বায়িত্ব হলো, তারা যেন শাসকগোষ্ঠীকে চাপ দিয়ে মজলুম ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে বাধ্য করে।
তিন. মসজিদে আকসা আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফিলিস্তিন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। আকসার পবিত্র ভূমি একমাত্র মুমিনদের জন্য সংরক্ষিত। আল্লাহর দুশমন অভিশপ্ত জায়নবাদী ইহুদিদের হাত থেকে মসজিদে আকসা ও তার পবিত্র ভূমিকে রক্ষা করা আমাদের ঈমানি দ্বায়িত্ব। সেই দ্বায়িত্ব আদায়ে সচেষ্ট ফিলিস্তিনের মুসলমান ও মুজাহিদদেরকে আমরা আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। আমরা আমাদের সাধ্য থেকে তাদের পাশে দাঁড়ানোকে নৈতিক ও ঈমানি দ্বায়িত্ব মনে করি।
দোয়া করি, আল্লাহতায়ালা যেন তাদেরকে গায়েবি সাহায্য দান করেন এবং বিশ্ব মুসলিমকে তাদের পাশে একত্রিত করে দেন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক, জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা, সিলেট।